মেঘ ও রোদ্দুর মাথায় নিয়ে এক সময় ঘুরে বেড়াতাম পাথারিয়া থেকে রাজকান্দি হয়ে কালেঙ্গা বন। কালেঞ্জি পাহাড়ে খাসি কবিরাজ নসিফ পথমি একদিন এক মায়াবী কচুগাছ দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দেন। কচুটির খাসি নাম নিয়াংসোয়াত। খাসি ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসায় এটি ব্যবহৃত হয়। কচুটি প্রথম খুঁজে পাই ২০০০ সালে। পরে ২০০৫ সালে বিখ্যাত কচু বিশেষজ্ঞ হোসনে আরা, উদ্ভিদবিজ্ঞানী আবুল হোসেন ও আমি কচুটিকে ‘এগালোনেমা মডেস্টাম’ হিসেবে শনাক্ত করে দেশে প্রথমবারের মতো নথিভুক্ত করি। কিন্তু নিদারুণ বিষয় হলো, কচুটিকে বুনো পরিবেশে পরে খুব কম খুঁজে পাওয়া গেছে। হারিয়ে গেছে কিনা জানি না। করোনাকালে লাউয়াছড়া থেকে হারিয়ে গেল জানামতে দেশের সর্বশেষ আফ্রিকান টিক ওক গাছটি। চোখের সামনে একের পর এক প্রশ্নহীনভাবে বহু প্রজাতির হারিয়ে যাওয়া শরীর ও মনে নিদারুণ দাগ রেখে যায়। রেখে যায় ক্ষত ও ক্ষরণ।

 সম্প্রতি আইইউসিএন দেশে বিলুপ্ত ও বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদের লাল তালিকা করেছে। দেশের চার সহস্রাধিক উদ্ভিদ প্রজাতির ভেতর থেকে এক হাজার প্রজাতি নিয়ে এই জরিপ করা হয়েছে। জরিপে দেখা যায়, ৩৯ শতাংশ উদ্ভিদই বিপদাপন্ন। এর ভেতর ৭টি বিলুপ্ত, ৫টি মহাবিপন্ন, ১২৭টি বিপন্ন, ২৬২টি সংকটাপন্ন, ৬৯টি প্রায় সংকটাপন্ন, ২৭১টি প্রকৃতিতে টিকে আছে এবং ২৫৮টি প্রজাতির ক্ষেত্রে তথ্য ঘাটতি আছে।

ফিতা চাঁপা, কুড়াজিরি, ভানু দেয়পাত, গোলা অঞ্জন, সাত সারিলা, থার্মা জাম ও মাইট্রাসিস উদ্ভিদ প্রজাতিকে দেশ থেকে বিলুপ্ত হিসেবে দেখিয়েছে উল্লিখিত জরিপ। বাঁশপাতা, বনখেজুর, বালবোরপ, লম্বা ট্রায়াস অর্কিড ও বলগাছ মহাবিপন্ন। কেবল প্রাকৃতিক বনভূমি বা গ্রামীণ বন নয়, নগরের শেষ সবুজ বলয় আর সড়কে উন্নয়নের নামে যেভাবে গাছ হত্যা শুরু হয়েছে, তাতে আগামীতে উদ্ভিদের কতগুলো প্রজাতি টিকে থাকবে, তা আন্দাজ করা মুশকিল।

কেবল উদ্ভিদ নয়, বন্যপ্রাণীর বেঁচে থাকাও আজ বেসামাল হয়ে পড়েছে। খুদে মৌমাছি থেকে বৃহৎ হাতি, এমনকি তিমিও আজ নিখোঁজ হচ্ছে বেশুমার। করোনা মহামারির প্রথম বছর যখন আমরা লকডাউনে আটকা পড়ি তখন তিন মাসে দেশে বন্যপ্রাণী খুনের একটা হিসাব করেছিলাম। মূলত দৈনিক ও অনলাইনে প্রকাশিত খবর বিশ্লেষণ করে এবং কিছু তথ্য নিয়েছিলাম বন্যপ্রাণী নিয়ে কর্মরত কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী দল ও পরিচিতজনের কাছ থেকে। দেখতে পাই, ২০২০ সালের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা শনাক্তের পর থেকে মধ্য জুন পর্যন্ত বাংলাদেশে ২৮৮টি বন্যপ্রাণী হত্যা করে মানুষ।

এভাবে প্রাণ-প্রজাতির প্রশ্নহীন বিলুপ্তি ঘটছে কেন? আমরা রাষ্ট্রীয় ও বৈশ্বিক পর্যায়ে বহু অঙ্গীকার করেছিলাম। সেসব অঙ্গীকারের কী হলো? প্রাণ-প্রজাতি সুরক্ষায় আমরা আমাদের অঙ্গীকারগুলোকে বারবার কেন দাবিয়ে রাখছি?

রাষ্ট্র হিসেবে প্রাণ-প্রজাতি সুরক্ষায় বাংলাদেশ সাংবিধানিকভাবে সেই অঙ্গীকার করেছে। এমন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকার খুব কম দেশের সংবিধানেই দৃশ্যমান। সংবিধানের ১৮(ক) ধারায় উল্লেখ আছে, ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।’ প্রাণ-প্রজাতি সুরক্ষায় নাগরিক-রাষ্ট্রীয় ও বৈশ্বিক অঙ্গীকারগুলো জোরালো ও সক্রিয় করার আহ্বান জানাই।

যদিও দেখা গেছে, নয়া উদারবাদী ব্যবস্থা কোনোভাবেই প্রাণ ও প্রকৃতির পক্ষে দাঁড়ায়নি। রিও ঘোষণা ২০১২-এর ৪ নম্বর নীতিতে বলা হয়েছে, দায়িত্বশীল উন্নয়ন অর্জন করার ক্ষেত্রে পরিবেশগত সুরক্ষাকে উন্নয়ন প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে এবং একে পৃথক হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না। রিও ঘোষণার ১০ নম্বর নীতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, রাষ্ট্রগুলোকে কার্যকর পরিবেশ আইন প্রণয়ন করতে হবে। যদিও বাংলাদেশ বহু আগেই পরিবেশ আইন, পরিবেশ নীতিমালা, বন্যপ্রাণী আইনসহ প্রাণ-প্রজাতি সুরক্ষায় বহু আইন ও নীতি গ্রহণ করেছে। এমনকি রামসার সনদ, সাইটেস, আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য সনদসহ স্বাক্ষর করেছে বহু বৈশ্বিক অঙ্গীকারে।

১৯৯২ সালের ৫ জুন ব্রাজিলের রাজধানী রিও ডি জেনিরোতে অনুষ্ঠিত ধরিত্রী সম্মেলনে স্বাক্ষরের জন্য প্রাণবৈচিত্র্য সনদটি (সিবিডি ১৯৯২) উন্মুক্ত করা হয়। বাংলাদেশ ১৯৯২ সালের ৫ জুন সনদটি স্বাক্ষর করে এবং ১৯৯৪ সালের ৩ মে অনুসমর্থন দান করে। ওই সনদের আলোকে বাংলাদেশ ১৯৯৮ সালে ‘বায়োডাইভার্সিটি অ্যান্ড কমিউনিটি নলেজ প্রটেকশন অ্যাক্ট’ নামে একটি আইনের খসড়াও তৈরি করে। সিবিডি সুনির্দিষ্টভাবে প্রাণ-প্রজাতি সুরক্ষায় বৈশ্বিক অঙ্গীকারগুলো বিন্যস্ত করেছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষা কিংবা জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বৈশ্বিকভাবে মন্ত্রী পর্যায়ের জাতিসংঘ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, যা কনফারেন্স অব পার্টিস-কপ নামে পরিচিত। প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষায় কপের ১৫তম আসরটি বসেছিল ২০২২ সালে চীন ও কানাডায়। ২০৩০ সালের মধ্যে রাষ্ট্রগুলো বৈশ্বিক প্রাণবৈচিত্র্যের এক-তৃতীয়াংশ সুরক্ষায় ঐকমত্যে পৌঁছে। ওই সম্মেলনে প্রায় ২০০টি দেশ ২৩টি লক্ষ্যমাত্রার অঙ্গীকার নিয়ে ‘কুনমিং-মন্ট্রিয়ল বৈশ্বিক প্রাণবৈচিত্র্য কাঠামো’ চূড়ান্ত করে। ২০২১ সালে গ্লাসগো সম্মেলনে গৃহীত বিশ্বের বৃক্ষ ও বন সুরক্ষা নীতি স্বাক্ষর করেও বাংলাদেশ বৃক্ষ রক্ষায় বৈশ্বিক অঙ্গীকার করেছে।

১৯৭৩ সালের ৩ মার্চ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে বাংলাদেশসহ ২১টি দেশের স্বাক্ষরদানের মধ্য দিয়ে গৃহীত হয় বিপন্ন বন্যপ্রাণী এবং উদ্ভিদ প্রজাতির আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পর্কিত সনদ বা সাইটেস। সাইটেস স্বাক্ষর করলেও রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত দেশের প্রাণবৈচিত্র্যের বহুজাতিক ছিনতাই ও প্রাণ-ডাকাতি বন্ধ করতে পারেনি।

প্রাণ-প্রজাতির নিদারুণ বিলুপ্তির জন্য দায়ী কে বা কারা? এর উত্তর আমাদের চারপাশেই আছে। ক্ষমতা কাঠামোর নিয়ন্ত্রণ, বহুজাতিক কোম্পানির মুনাফা, নয়া উদারবাদী বাণিজ্য ব্যবস্থা, বৈশ্বিক কর্তৃত্ব, বিচারহীন লুটপাট কিংবা কাঠামোগত বৈষম্য প্রতিদিন আমাদের চোখের সামনে খুন করছে অগণিত প্রাণ-প্রজাতি। জবাবদিহি ও ন্যায়বিচারের কাঠামো জোরালো না হওয়ায় প্রাণবৈচিত্র্য হারানোর কোনো যন্ত্রণা বা বিচার রাষ্ট্রের দরবারে হাজির হয় না। অথচ আদিবাসী এমনকি গ্রামীণ জনগণ এখনও নিজের জীবন দিয়ে প্রাণ-প্রজাতির সুরক্ষা দিয়ে চলেছে। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৫ শতাংশ আদিবাসী দুনিয়ার প্রায় ৮০ শতাংশ প্রাণ-প্রজাতি সুরক্ষা করে চলেছে। প্রাণ-প্রজাতি সুরক্ষায় দেশব্যাপী মানুষের অবদানকে স্বীকৃতি দিয়ে রাষ্ট্রকে নিজের অঙ্গীকারগুলো পালনে সক্রিয় হতে হবে। তাহলে হয়তো একটি পাখি, পতঙ্গ বা গাছ হারানোর আহাজারি নিয়ে বারবার আমাদের আত্মগ্লানিতে মুষড়ে পড়তে হবে না। 

পাভেল পার্থ: লেখক ও গবেষক animistbangla@gmail.com