- মতামত
- যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতির পাঁচ তাৎপর্য
সমকালীন প্রসঙ্গ
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতির পাঁচ তাৎপর্য

বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন গত বুধবার এই নীতি সম্পর্কে বলেছেন, এর আওতায় যে কোনো বাংলাদেশি ব্যক্তি যদি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের প্রক্রিয়া ব্যাহত করার জন্য দায়ী হন বা এ রকম চেষ্টা করেছেন বলে প্রতীয়মান হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে ভিসা দেওয়ার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারবে।
যুক্তরাষ্ট্র বলছে, বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণ জাতীয় নির্বাচনকে সমর্থন দিতে যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ন্যাশনালিটি অ্যাক্টের ২১২(এ)(৩)(সি)(৩সি) ধারাবলে এই নতুন নীতিটি তারা ঘোষণা করল। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেছেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সবার দায়িত্ব। বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের সবার প্রতি সমর্থন জানাতে এই নীতি ঘোষণা করা হয়েছে।
নতুন ভিসা নীতি এমন সময়ে পাওয়া গেল যখন দেশের নির্বাচন কমিশন চারটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করেছে। আবার গাজীপুর সিটি নির্বাচনের ঠিক আগের দিন বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন প্রশ্নে এই নতুন ভিসা নীতির কথা ঘোষণা করল দেশটি। আমরা জানি, আগামী কয়েক দিনের মধ্যে আরও তিনটি সিটি করপোরেশনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
অবশ্য ঘোষণার পর জানা গেছে, এই ভিসা নীতি সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র আরও আগেই, গত ৩ মে বাংলাদেশ সরকারকে জানিয়েছিল। যদিও আমাদের সরকার বা পররাষ্ট্র দপ্তরের পক্ষে তখন থেকে নীরবতাই পালন করা হয়েছে। অন্তত আনুষ্ঠানিকভাবে দেশবাসী বা সংবাদমাধ্যমকে কিছু জানানো হয়নি। বিরোধী দলও দৃশ্যত এ বিষয়ে অজ্ঞাতই ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসার পর ক্ষমতাসীন ও বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে নানামুখ প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। আমার মনে হয়, ঊর্ধ্বে উঠে বিষয়টিকে সামগ্রিকভাবে দেখার সুযোগ রয়েছে।
প্রথমত, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের এত দিনের অবস্থান ছিল– অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হতে হবে। কিন্তু এখন নতুন ভিসা নীতির মধ্য দিয়ে দেখা যাচ্ছে, তারা জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের নির্বাচনের কথা বলছে। এর একটি উদাহরণ হতে পারে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন। সেখানে বিএনপির মতো প্রধান বিরোধী দলগুলো অংশগ্রহণ করেনি; কিন্তু জনগণ ভোটে অংশ নিয়েছে।
নতুন ভিসা নীতির দ্বিতীয় তাৎপর্য হচ্ছে, সেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে বিশেষভাবে কিছু বলা হয়নি। বরং সরকারে যারাই থাকুক; নির্বাচন যে সুষ্ঠু, অবাধ ও স্বতঃস্ফূর্ত হতে হবে– সেটাই নির্দেশ করা হয়ছে। বিএনপির যে প্রধান দাবি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং বর্তমান সরকারের ভাষ্যমতে, সংবিধানে যার সুযোগ আর নেই, সেই অচলাবস্থা দূর হওয়ার একটি পথ তৈরি হয়েছে বলা চলে। ক্ষমতাসীন দল এখন যেভাবে বলছে– তারা আগামী নির্বাচনটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অবাধ করতে চায়, সেই ঢালাওভাবে বললে চলবে না। কীভাবে করবে, সেটা ব্যাখ্যা করতে হবে।
তৃতীয়ত, নতুন ভিসা নীতির মধ্য দিয়ে ঠিক সরাসরি নিষেধাজ্ঞার কথা বলা হয়নি, যেই নিষেধাজ্ঞা নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের রাজনীতি ও কূটনীতিতে ব্যাপক আলোচনা চলছিল। নির্বাচন পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত আমলা, পুলিশ থেকে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী রাজনৈতিক দল সবার ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য। আমি মনে করি, এতে বিএনপির ওপরেও এক ধরনের চাপ তৈরি হবে। তারা আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে কিনা, সে সিদ্ধান্তটি নিতে হবে। যেহেতু আমেরিকার ভিসা পলিসিতে বলা হয়েছে, নির্বাচন অনুষ্ঠানে বিঘ্ন ঘটানো যাবে না।
আমরা গাজীপুরে দেখলাম, ভোটার উপস্থিতি স্বতঃস্ফূর্ত। কোনো বাধা দেখা যায়নি। কিন্তু খেয়াল করতে হবে, এই নির্বাচনের কাঠামোটি কী? সেখানে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের একজন প্রার্থী ছিলেন। আবার ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীকে হারিয়ে যিনি জিতে এলেন, তিনিও আওয়ামী লীগেরই লোক। এখন, জাতীয় নির্বাচনও যদি এভাবে সম্পন্ন হয়, তাহলে কি আমেরিকার আপত্তি থাকবে না? বিষয়টি এখনও স্পষ্ট নয়। ঘটনাচক্রে মনে হচ্ছে, এই কাঠামোতে নির্বাচন হলে আমেরিকা বিরোধিতা করবে না।
চতুর্থ যে বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে তা হচ্ছে, নতুন ভিসা নীতির ‘অ-রাজনৈতিক’ তাৎপর্য। এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা যেহেতু নেতিবাচক বিষয়, স্বাভাবিকভাবেই আন্তর্জাতিকভাবে এর ব্যাপক প্রচার হয়েছে। এর ফলে বিদেশি বিনিয়োগ, বিশেষ করে যাঁরা পশ্চিমা বিনিয়োগকারী, তাঁরা নিরুৎসাহিত হতে পারেন। বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে তাঁরা অনেক সাবধানী ও সতর্ক হবেন। ফলে নির্বাচনের আগ পর্যন্ত বিদেশি বিনিয়োগ কমে যেতে পারে। অবশ্য পৃথিবী আর গত কয়েক দশকের মতো এককেন্দ্রিক নেই। এখন অনেকাংশে বহুকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। এখন আমেরিকার মতো কোনো বড় দেশ এখানে বিনিয়োগ বন্ধ করলেও সবাই যে বিনিয়োগ ফিরিয়ে নেবে– বিষয়টি এমন নাও ঘটতে পারে। আর মনে রাখতে হবে, শূন্যস্থান সব সময়ই দখল হয়ে যায়। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় যারা যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধী পক্ষ, তারা এগিয়ে আসতে পারে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাম্প্রতিক সময়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে।
নতুন ভিসা নীতির ডামাডোলে পঞ্চম যে বিষয়টি মনে রাখতে হবে, তা হচ্ছে, আমাদের দেশের বিভাজনের রাজনীতিতে ক্ষমতার পালাবদল সহজ নয়। কারণ যাঁরা রাজনীতি করেন, যাঁরা সম্পৃক্ত থাকেন, তাঁদের আরও নানা বিষয়ে বড় ধরনের অংশীদারিত্ব থাকে। ফলে যাঁরা বিজয়ী হন, তাঁরা সব দিক থেকেই বিজয়ী হন। যাঁরা পরাজিত হন, তাঁদের কেবল রাজনৈতিক ক্ষমতা নয়; অনেক কিছু হারাতে হয়। তাই এখানে যুক্তরাষ্ট্রে ভিসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয়েই হঠাৎ ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন– এমন সহজ নয় বিষয়টি।
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে রাতারাতি বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে– এমন ভাবা কঠিন। বাস্তবতা হচ্ছে, রাজনীতিতে পরিবর্তন হয় অভ্যন্তরীণ ফ্যাক্টরের মাধ্যমে। যেমন লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে এলে অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে। সেই পরিস্থিতি কি বাংলাদেশে তৈরি হয়েছে? বোঝার জন্য আরও অপেক্ষা করতে হবে।
অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ: আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
মন্তব্য করুন