জীবমাত্রেই মৃত্যু অনিবার্য। বিষয়টি মেনে নিয়েই সভ্যতার বিবর্তনে মানব জাতি মৃত্যুকে মহিমান্বিত করে আসছে। সেপটিক ট্যাঙ্কের মধ্যে পূতিগন্ধময় পরিবেশে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ তাই কারও দুঃস্বপ্নেও কাম্য হতে পারে না। অথচ সেটাই দিনের পর দিন এ দেশে চলছে। রোববারও রাজধানীর উত্তরখানে নির্মাণাধীন ভবনের সেপটিক ট্যাঙ্কের শাটারিং খুলতে গিয়ে আটকে পড়ে মারা গেছেন মো. সামাদ (৫৫) ও মধু মিয়া (৪২)। 

নিজের সৃষ্ট অমর চরিত্র দেবদাসের মৃত্যু নিয়ে শরৎচন্দ্র লিখেছিলেন– ‘মরণে ক্ষতি নাই...মরিবার সময় যেন কাহারও এক ফোঁটা চোখের জল দেখিয়া সে মরিতে পারে।’ মৃত্যুকালে অশ্রু মোচন দূরে থাক; মধু ও সামাদের ক্ষেত্রে গাইবান্ধায় থাকা স্বজনরা হয়তো জানেনও না, জীবিকার তাগিদে ঢাকায় গিয়ে তাঁরা কী কাজ করেন। বিদেশে শ্রমিক রপ্তানির কল্যাণে ‘অড জব’ কথাটা আজকাল দেশেও চালু হয়েছে? এই ‘অড জব’ কি বিশ্বের কোথাও টিকে আছে? প্রতিবেশী ভারতেও ২০১৩ সালে কায়িক শ্রমে সেপটিক ট্যাঙ্ক পরিষ্কার নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

উত্তরখানের এ ‘দুর্ঘটনা’ আমাদের চোখে আরেকবার আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল– মনুষ্যবর্জ্য ব্যবস্থাপনা খাতের নিরাপত্তা নিয়ে আমরা কতটা উদাসীন! তার চেয়েও বেশি উদাসীন সম্ভবত খেটে খাওয়া মানুষের জীবনের মূল্য নিয়ে। মে মাসেই, প্রথম সপ্তাহে খুলনার খালিশপুর এলাকায় নির্মাণাধীন ভবনের সেপটিক ট্যাঙ্কের বিষাক্ত গ্যাসে দুই শ্রমিক নাজির সরদার (২৫) ও সাদ্দাম হোসেনের (২৫) মৃত্যু হয়েছে। একটি পরিসংখ্যান দেখেছিলাম, দেশে বছরে কমবেশি ৩০০ মানুষের মৃত্যু হয় সেপটিক ট্যাঙ্কে। সংখ্যা দূরে থাক, প্রাণহানির ধরন হিসেবেও কোনো সভ্য সমাজে চিন্তা করা যায়?

প্রায়ই সেপটিক ট্যাঙ্কে মৃত্যুর খবর দেখে দেখে এর একটি ‘ধ্রুপদি’ চিত্র তৈরি হয়ে গেছে। নিছক একটি রশি ভরসা করে এক বা একাধিক শ্রমিক অন্ধকার গর্তে নামে। বদ্ধ ট্যাঙ্কগুলো যেহেতু বিষাক্ত গ্যাসে ভর্তি বা অক্সিজেনশূন্য অবস্থায় থাকে, তাই চেতনা বা প্রাণ হারানোর ঝুঁকি প্রবল।  ওপরে কেউ নজরদারি করে; কখনও তাও নেই। কখন শ্রমিকরা অচেতন হয় বা হয়ে মারাও যায়, যথাসময়ে জানা যায় না। শুধু ট্যাঙ্ক নয়; খোদ রাজধানীর রাজপথে ভূগর্ভস্থ নর্দমায় নেমে কতজনই জীবিত উঠে আসতে পারে না!

এক সময় নগরের পাকা বাড়ির পেছনে ছোট গর্ত ও সংযুক্ত ‘মেথর গলি’ থাকত। জমা হওয়া মনুষ্যবর্জ্য সেখান দিয়ে পরিবাহিত হতো। প্রতি ইঞ্চি জায়গা যখন মূল্যবান হয়ে উঠেছে, তখন ভবনের নিচেই যথাসম্ভব বড় করে সেপটিক ট্যাঙ্ক নির্মিত হয়। কেবল শহরে নয়; মফস্বল শহর কিংবা গ্রামেও যেসব ভবন উঠছে, সেখানেও অভিন্ন ব্যবস্থা। স্থাপত্যবিদ্যার ধার না ধেরে যে যেভাবে পারছে একেকটি ট্যাঙ্ক তৈরি করছে। যদিও এ ধরনের ট্যাঙ্কের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, নির্দিষ্ট সময়ের জন্য মনুষ্যবর্জ্য সেখানে জমা হবে এবং তরল ও কঠিন আলাদা হবে। পরে স্বয়ংক্রিয়ভাব কঠিন চলে যাবে ‘ট্রিটমেন্ট প্লান্টে’। কিন্তু আমাদের দেশে সেই যে সংযোগহীন গর্ত খোঁড়া হয়, তারপর না ভরা পর্যন্ত পরিষ্কার করার চিন্তা নেই। এ জন্য খুঁজে আনা হয় অদক্ষ শ্রমিক। ‘দক্ষ’ শ্রমিক এই কাজে আসবেই বা কেন?   

দুর্ভাগ্যের বিষয়, সেপটিক ট্যাঙ্কের এই সকরুণ মৃত্যুকে ‘দুর্ঘটনা’ হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার একটি রেওয়াজ আমাদের দেশে গড়ে উঠেছে। জেনেবুঝে মানুষকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেওয়ার এই আয়োজন ‘দুর্ঘটনা’ হয় কীভাবে? আরও দুর্ভাগ্যের বিষয়, সেপটিক ট্যাঙ্কে মৃত্যু সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় ঢেউও তোলে না। প্রাণহানির শিকার ব্যক্তিরা প্রান্তিক মানুষ বলেই কি এমন নির্লিপ্ততা? অথচ বদ্ধ ট্যাঙ্কের বিষাক্ত গ্যাস বা অক্সিজেনশূন্যতা মোকাবিলা কিংবা সেখানে জমা মনুষ্যবর্জ্য পরিষ্কারের জন্য রয়েছে অত্যাধুনিক নানা পদ্ধতি। যদি প্রাণগুলো মূল্যবান মনে হতো, তাহলে আমরা কবেই সেসব পদ্ধতি অনুসরণ করতাম।

শেখ রোকন: সহযোগী সম্পাদক, সমকাল
skrokon@gmail.com