- মতামত
- নিরাপত্তা ও নজরদারির অভাব
নিরাপত্তা ও নজরদারির অভাব
রাজধানীতে বাস্তবায়নাধীন ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পে প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা আমাদের দাঁড় করাইয়া দিয়াছে একাধিক প্রশ্নের সম্মুখে। ব্যস্ত ও জনবহুল এলাকায় নির্মাণাধীন বৃহৎ স্থাপনাগুলির নিরাপত্তা ব্যবস্থা কি যথেষ্ট মনোযোগ পাইতেছে না? বিভিন্ন প্রকল্প এলাকায় একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটিবার পরও সতর্কতায় কেন ঘাটতি থাকিয়া যাইতেছে? এই দফায় সোমবার স্থাপনাটির মহাখালী অংশে ‘ভায়াডাক্ট’ অর্থাৎ উপরিকাঠামো হইতে ‘রড’ তথা লৌহশলাকা জনৈক কিশোরের মস্তকের উপরে পতিত হইয়া যেইভাবে মর্মান্তিক মৃত্যুর কারণ হইয়াছে, উহা অভিনব সন্দেহ নাই। কিন্তু স্মরণে রাখিতে হইবে, প্রতিবারই এইরূপ ‘অভিনব’ দুর্ঘটনা ঘটিতেছে। তাহা হইলে কি দুর্ঘটনার সম্ভাব্য কারণসমূহ যথাযথভাবে নিরূপিত হইতেছে না? এক একটি দুর্ঘটনা ঘটিবে আর বিষয়টি কেবল সংবাদমাধ্যমের আলোচনা-সমালোচনাতেই ফুরাইয়া যাইবে? আমাদের স্মরণে রহিয়াছে, গত বৎসর আগস্ট মাসে রাজধানীর উত্তরায় বাস্তবায়নাধীন বাস র্যাপিড ট্রানজিট-বিআরটি প্রকল্পে বক্স গার্ডার ক্রেন হইতে ছুটিয়া চলন্ত প্রাইভেটকারের উপর পড়িলে পাঁচজন প্রাণ হারাইয়াছিলেন। উহার এক মাস পূর্বে গাজীপুরে একই প্রকল্পের গার্ডারের নিচে চাপা পড়িয়া একজন নিরাপত্তাকর্মী প্রাণ হারান। ২০২১ সালের মার্চ মাসেও বিমানবন্দর স্টেশনের সম্মুখে বিআরটি প্রকল্পের রোডওয়ে স্ল্যাব লঞ্চার ভাঙিয়া পড়িয়াছিল। মন্দের ভালো বলিতে হইবে, ঐ দুর্ঘটনায় প্রকল্পেরই দুই চীনা কর্মীসহ চারজন গুরুতর আহত হইলেও কাহারো প্রাণহানি ঘটে নাই।
বিআরটি প্রকল্পে সংঘটিত বিয়োগান্ত ঘটনার পর আমরা এই সম্পাদকীয় স্তম্ভে বাস্তবায়নাধীন সরকারি-বেসরকারি সকল প্রকল্পে যথাযথ নজরদারি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করিবার আহ্বান জানাইয়াছিলাম। কিন্তু সোমবারের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ঘটনা প্রমাণ করিল, সকলই অরণ্যে রোদন মাত্র। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কর্তৃপক্ষ বলিতেছে, প্রকল্পে কর্মরত কতিপয় অসাধু শ্রমিকের রড চুরিতে সহায়তা করিতে গিয়া উক্ত কিশোর প্রাণ হারাইয়াছে। সমকালে বুধবার প্রকাশিত প্রতিবেদনমতে, এই ঘটনার সহিত সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে গ্রেপ্তারকৃত প্রকল্পের শ্রমিকও অভিন্ন বক্তব্য দিয়াছেন। নিহত কিশোর বস্তিবাসী বলিয়াই তাঁহার উপর চৌর্যবৃত্তির দায় চাপানো হইতেছে কিনা খতাইয়া দেখা জরুরি। কর্তৃপক্ষের বক্তব্য সত্য ধরিয়া লইলেও অঘটনটি নিশ্চিতভাবে প্রকল্পে নজরদারি ও নিরাপত্তার দুর্বলতা তুলিয়া ধরে। আর কোনো অজুহাতেই প্রাণহানির দায় পরিহারের অবকাশ নাই। কিশোরের পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং ঔদাসীন্য ও দায়িত্বে অবহেলার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা লইতেই হইবে। সমকাল প্রতিবেদক দুর্ঘটনাস্থলে গিয়াও দেখিতে পাইয়াছেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ২৮৬-২৮৭ পিলারের মধ্যখানে ওয়েট জয়েন্টের যেই ছিদ্র দিয়া রড নিম্নে ফেলা হয় বলিয়া দাবি করা হইতেছে; সেইগুলির অবস্থান রেললাইনের উপরে। কর্তৃপক্ষের দাবি সত্য হইলে এই প্রকার নজরদারিহীনতা কমলাপুর-বিমানবন্দর লাইনে যাতায়াতকারী ট্রেনেও দুর্ঘটনা ঘটাইতে পারে।
নির্মাণাধীন ভবন হইতে নির্মাণসামগ্রী পড়িয়া পথচারীর মৃত্যু অথবা উপযুক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় কর্মরত শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনা রাজধানীসহ দেশের অন্যত্র প্রায়শ দৃশ্যমান। এই সকল দুর্ঘটনার মূল কারণ নির্মাণকার্যের জন্য প্রণীত সরকারি নির্দেশনাবলির লঙ্ঘন। কিন্তু একই প্রকার নিরাপত্তা নির্দেশনাবলির লঙ্ঘন যখন সরকারি প্রকল্পেও ঘটে, তখন হতাশা দ্বিগুণ মাত্রা পায়। কারণ নিজের নির্দেশনাবলি নিজেই লঙ্ঘন করিবার পর অন্যকে একই অপরাধে শাস্তি দিবার নৈতিক দৃঢ়তা কর্তৃপক্ষের থাকিতে পারে না। হইতে পারে বৃহৎ প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়ন করিতেছে বিদেশি ঠিকাদার। সেই ক্ষেত্রে এই প্রশ্নও উঠিবে– প্রকল্পের নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে তাহাদের ঔদাসীন্য অন্যান্য কাজেও মানহীনতা নির্দেশ করিতে পারে কিনা। আর প্রকল্প বাস্তবায়নে নিরাপত্তাজনিতা ব্যত্যয়সহ যেই কোনো প্রকার ব্যত্যয় ঘটিলে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার কর্তৃপক্ষের নিকট জবাবদিহি করিতে বাধ্য। দুঃখজনক হইল, অদ্যাবধি কোনো প্রকল্পেই আমরা কর্তৃপক্ষকে এহেন ভূমিকায় অবতীর্ণ হইতে দেখি নাই। আমরা মনে করি, বাস্তবায়নাধীন বৃহৎ প্রকল্পগুলিতে সংঘটিত প্রথম দুর্ঘটনাটিতেই যদি সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারেরর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হইত, তাহা হইলে হয়তো সর্বশেষ দুর্ঘটনাটি ঘটিত না এবং কিশোরটির প্রাণপ্রদীপ নিভিত না।
মন্তব্য করুন