শুরুর কথা
২৪ মার্চ ১৯৭১। লন্ডন আইটিএন-এর রাতের খবর ‘নিউজ অ্যাট টেন’। টেলিভিশনের পর্দায় হঠাৎ আবির্ভূত হলেন সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় সংসদ ও প্রাদেশিক পরিষদের প্রায় সকল নির্বাচনী এলাকায় বিজয়ী পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ নেতা পূর্ব পাকিস্তানের প্রাণপুরুষ শেখ মুজিবুর রহমান। সুঠাম, দীর্ঘ দেহ, উন্নত শির, চোখেমুখে দৃঢ় প্রত্যয় কিন্তু চিন্তিত। ঢাকার হোটেল ইন্টার-কন্টিনেন্টালের ফটকে দাঁড়ানো, ঠোঁটের কোনায় চেপে রাখা ধূমপানের পাইপ।
‘মিস্টার রহমান, আপনার কি পাকিস্তানিদের হাতে মারা যাবার ভয় নেই?’
তাৎক্ষণিক উত্তর দিলেন বঙ্গবন্ধু– ‘না, আমাকে মারলে তাদেরকে তাদের সবচেয়ে বড় শত্রু কমিউনিস্টদের মুখোমুখি হতে হবে।’
উল্লেখ্য, সত্তরের দশকে পশ্চিমা দেশসমূহ বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কমিউনিস্ট অভ্যুত্থানের শঙ্কায় ছিল ভয়ানক চিন্তিত ও তাড়িত। ভারতে কমিউনিস্ট নেতা চারু মজুমদার অনেককে নির্ঘুম করে দিয়েছিলেন। কয়েক মুহূর্ত পরেই, উচ্চৈঃস্বরে গম্ভীর গলায় শেখ মুজিব ইংরেজিতে বললেন, ‘সাত কোটি বাঙালিকে হত্যার জন্য কি পাকিস্তানিদের পর্যাপ্ত গুলি আছে?’ চমকিত হলাম বীরের সাহসী বক্তব্যে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংসতার খবর প্রকাশ পেল ২৭ মার্চ ১৯৭১ বিবিসি সংবাদে। ঢাকায় ইন্টার-কন্টিনেন্টাল হোটেলের ছাদে লুকিয়ে-থাকা বিবিসি সাংবাদিক মাইকেল ক্লেটন তথ্য ও ছবি প্রকাশ করলেন। একই দিন জেনারেল ইয়াহিয়ার পাকিস্তানিদের উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণ উদ্ধৃত করে করাচি থেকে কেনেথ ক্লার্ক লিখলেন, ‘জিন্নাহর একতার স্বপ্ন রক্তে ধুয়ে-মুছে গেছে।’ ২৭ মার্চ ১৯৭১ তারিখের লন্ডনের টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত হলো তরুণ বাঙালি মেজর জিয়ার পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি শেখ মুজিবের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা। শেখ মুজিবুরের তুলনায় খর্বকায় কিন্তু সাহস ও দৃঢ়তার চিহ্ন মুখমণ্ডলে। তাঁর উচ্চারিত দুই শব্দ– We Revolt. শুনে চমকিত হলেন বিলেতের বাম রাজনৈতিক কর্মীরা। দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাল, পাকিস্তানের আয়ু শেষ হয়ে গেছে। নতুন দেশ স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান নয়, স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম আসন্ন। সঙ্গে সঙ্গে আমি ফোন করলাম মিডলসবরোতে আমার বন্ধু ডা. মাহমুদুর রহমান বাবলু ও তার স্ত্রী ডা. সাবেরাকে। বাবলুর মা মিসেস জহুরা রহমান খুবই সংবেদনশীল মহিলা এবং সুগায়িকা, বাবলুর বাবা অধ্যাপক লুৎফর রহমান ছিলেন বক্ষব্যাধি হাসপাতালের পরিচালক এবং প্রখ্যাত যক্ষ্মা বিশেষজ্ঞ, অতীব নিরীহ ভদ্রলোক বাবলুর মার বিপরীত। তাঁরা উভয়ে আমাকে সন্তানসম স্নেহ করতেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৭২ সালে সাভারে তাঁদের পুরো জমি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র স্থাপনের জন্য দান করেছিলেন।
দ্রুত যোগাযোগ করলাম ডা. মসিহুজ্জমানের সঙ্গে। মসিহ খুব ভালো ছাত্র ছিল। মসিহ ও আমি একই দিনে একই সঙ্গে বিলেতে গিয়েছিলাম। মসিহর বাবা পুলিশ ইন্সপেক্টর আখতারুজ্জামান আমার পাকিস্তানি পাসপোর্টের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। তাঁর সিদ্ধেশ্বরীর টিনের বাড়িতে বেশ কিছুদিন ভবিষ্যতের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে বসবাস করেছেন।
মসিহর ছোট ভাই কর্নেল খাইরুজ্জামান ফিলিপাইন ও মিয়ানমারে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছেন। আমি পূর্ব পাকিস্তানের ডাক্তারদের সঙ্গে প্রতিদিন রাত ১২টা পর্যন্ত ফোনে বিষয়টির আলাপ অব্যাহত রাখলাম। সবাই চিন্তিত, উৎকণ্ঠিত।
১৯৭১ সালে এক হাজারের বেশি বাঙালি ডাক্তার আয়ারল্যান্ড, ওয়েলস, স্কটল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের বিভিন্ন কাউন্টিতে কর্মরত ছিলেন, মূলত উচ্চশিক্ষার জন্য ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যে আগত। এ ছাড়া এক লাখের অধিক বাঙালি ছিলেন বিভিন্ন পেশার ও হোটেল রেস্টুরেন্টের কর্মচারী; যাঁদের অধিকাংশই সিলেটের। বিভিন্ন বিষয়ে অধ্যয়নরত ছাত্র ছিল কয়েক হাজার। বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন তাঁদের অন্যতম।
লন্ডন, গ্লাসগো, এডিনবরা, ম্যানচেস্টার, বার্মিংহাম, কভেন্ট্রি, লিডস, নিউক্যাসল, অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ ও অন্যান্য ছোট-বড় শহরে শনি-রোববারে পূর্ব পাকিস্তানের চিকিৎসক ছাত্র ও অন্য পেশাজীবীরা জড়ো হতে থাকলেন শহরের বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে।
সম্ভবত ২৭ মার্চ ৭১ ছিল শনিবার। লন্ডনে সবচেয়ে বেশি ভিড় হতে থাকল পুরোনো কমিউনিস্ট কর্মী তাসাদ্দুক হোসেনের ‘দি গ্যানজেস রেস্টুরেন্টে’। এটা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের বুদ্ধিদীপ্ত ছাত্রদের আড্ডাখানা। এখানে শুক্রবার সন্ধ্যা ও শনি-রোববারে বহু ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য সপরিবারে ভারতীয় খাবারের স্বাদ নিতে আসতেন।
৩০ মার্চ ১৯৭১ তারিখে ডেইলি টেলিগ্রাফ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে পুরান ঢাকার সর্বত্র পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্মমতার চিত্র প্রকাশ করল তাদের রিপোর্টার সাইমন ড্রিংয়ের বরাতে, পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় বড় শিরোনামে।
পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ঢাকা শহরকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করার পূর্বে ইয়াহিয়া ভুট্টো ও শেখ মুজিবের আলোচনা পর্যবেক্ষণের জন্য আগত বিভিন্ন দেশের মিডিয়া ও সাংবাদিকদের ঢাকা ত্যাগের নির্দেশ দেয়। হোটেল ইন্টার-কন্টিনেন্টালের ছাদে লুকিয়ে থাকেন ঢাকার ইংরেজি দৈনিক দ্য পিপলের সম্পাদক আবিদুর রহমানের পরামর্শে। বিবিসির সাংবাদিক মাইকেল ক্লেটন ও ডেইলি টেলিগ্রাফের সাংবাদিক সাইমন ড্রিং পরে অ্যাসোসিয়েট প্রেসের ফটোগ্রাফার মিশেল লরেন্টকে নিয়ে সাইমন ড্রিং ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ২৫ মার্চ রাতে বর্বরতা ও নির্মমতার চিত্র ধারণ করে পরের দিন সুকৌশলে ব্যাংকক পৌঁছে সেখান থেকে ডিসপ্যাচ পাঠান। সেটি ৩০ মার্চ ৭১ তারিখে ডেইলি টেলিগ্রাফে প্রকাশিত হয় প্রথম পৃষ্ঠায় বড় শিরোনামে। বহুল প্রচারিত রক্ষণশীল দৈনিক টেলিগ্রাফের সংবাদে ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যস্থ পূর্ব পাকিস্তানিরা স্তম্ভিত ও বেদনায় নীল হয়ে যায়। পরিচিত ও নিকটজনের চিন্তায়-শঙ্কায় সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে।
স্মরণ করা প্রয়োজন যে, শেখ মুজিবের ১৯৭১-এর ৭ মার্চের বিখ্যাত ভাষণ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম,’ ৯ মার্চ পল্টন ময়দানের জনসভায় মওলানা ভাসানীর ‘স্বাধীনতার দাবিতে আপসহীন’ থাকার আহ্বান এবং ১২ মার্চ ময়মনসিংহে কৃষক সম্মেলনে মওলানা ভাসানীর স্বাধীনতার সপক্ষে অবিচল থাকার পুনঃ আহ্বানকে বিলেতের বাঙালি পেশাজীবী ও ছাত্ররা তেমন একটা গুরুত্ব দেয়নি। এমনকি ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে মওলানা ভাসানীর পাকিস্তানকে ‘আস্সালামু আলাইকুম’ খুব বেশি উত্তাপ সৃষ্টি করেনি। এসব বক্তব্যকে তাঁরা দরকষাকষির রাজনৈতিক কৌশল বলে ধরে নিয়েছিলেন। তবে এবার প্রবাসী বাঙালিরা ধাক্কা খেলেন আইটিএন, বিবিসি এবং টাইমস ও টেলিগ্রাফের সচিত্র সংবাদে।
অধিকতর সংবাদ জানার প্রত্যাশায় তাঁরা জড়ো হতে থাকেন সপ্তাহ শেষে শনি-রোববার ৩ ও ৪ এপ্রিল লন্ডনের হাইড পার্ক চত্বরে। জমে ওঠে প্রতিবাদী বক্তৃতা ও পাকিস্তানিদের প্রতি ধিক্কার। অধিকতর সংবাদ সংগ্রহ ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে লন্ডনের পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র-শিক্ষক ও রাজনৈতিক কর্মীদের ধারণা ও চিন্তার তথ্য জানার জন্য স্কটল্যান্ডের ল্যাঙ্কাশায়ার থেকে ‘ল’ হাসপাতালের ডা. এম এ মবিন ও আরও অনেকে এসে যোগ দেন হাইড পার্কের সমাবেশে। মবিন ঢাকার ছেলে কিন্তু পাস করেছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে।
প্রতিবাদের আবেগের আতিশয্যে হাইড পার্কে কয়েকজন বাঙালি পাসপোর্ট ছিঁড়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। আমিও তাদের অনুসরণ করি। আমরা রাষ্ট্রবিহীন নাগরিকে পরিণত হয়ে যাই।
ব্রিটেনে প্রথম বাংলাদেশি সংগঠন
১৯৭১ সালের এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে সম্ভবত ১০ তারিখে ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন স্থানের প্রায় ১০০ পূর্ব পাকিস্তানি বাঙালি চিকিৎসক লন্ডনের কিংস ক্রসের কাছে এক কমিউনিটি হলে মিলিত হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সাহায্য-সহযোগিতার উদ্দেশ্যে ‘বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন’ গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ব্রিটিশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সংক্ষিপ্ত নাম ‘বিএমএ’ বিধায় নবগঠিত বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সংক্ষিপ্ত নাম ঠিক করা হয় ‘বিডিএমএ’। পাঁচ সদস্যের একটি আহ্বায়ক কমিটি মনোনীত হয়। কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন লন্ডনের উপকণ্ঠে কর্মরত চক্ষু চিকিৎসক আবু হেনা সাইদুর রহমান, যিনি ‘খসরু ভাই’ নামে বেশি পরিচিত।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করা, আমার কয়েক বছর সিনিয়র পূর্ব লন্ডনে কর্মরত রংপুরের এম. এ. হাকিম, এমআরসিপি সহসভাপতি। রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ছাত্র-সংসদের সহসভাপতি আলতাফুর রহমান যুগ্ম সম্পাদক। আলতাফ নিকটবর্তী ল্যাঙ্কাশায়ারের একটি শহরে ডাক্তারি করতেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ঐ শহরের মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। আলতাফই ব্রিটেনে নির্বাচিত প্রথম বাংলাদেশি মেয়র।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন গঠনের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি উদ্যোগী ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র-সংসদের প্রাক্তন সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পাদক ডা. মোয়াজ্জেম হোসেন মোস্তফা ও তাঁর স্ত্রী ডা. মমতাজ বেগম কহিনুর। তাঁরা স্কটল্যান্ডে থাকতেন। প্রয়াত ডা. মোয়াজ্জেম মোস্তফা ছিলেন অ্যানেসথেসিয়ায় পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম এফএফএ। ডা. মমতাজ ছিলেন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ। অপর একজন উদ্যোগী ছিলেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে পাস-করা চিকিৎসক কাজী কামরুজ্জমান উলভার হ্যাম্পটনে অ্যানেসথেসিয়ায় প্রশিক্ষণরত। সদস্য নির্বাচিত হন ডা. এম এ মবিন। আমাকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। আমি ইয়র্ক শহরে জেনারেল ও ভাসকুলার সার্জারির রেজিস্ট্রারের চাকরি ছেড়ে দিয়ে লন্ডনে এসেছি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য সার্বক্ষণিক কাজ করার উদ্দেশ্যে। আস্তানা গেড়েছি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্সির ছাত্র রকি নুরুল আলম, লুৎফি জাহান চৌধুরী ও মাহবুবদের সঙ্গে, তাঁদের উত্তর লন্ডনের ক্রিকলউডের বাসায়। স্থির হয় প্রত্যেক সাধারণ সদস্য চিকিৎসক মাসে ন্যূনতম দশ পাউন্ড চাঁদা দেবেন ব্যাংক স্ট্যান্ডিং অর্ডারের মাধ্যমে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সাহায্য করার লক্ষ্যে। কয়েকজন অনেক বেশি চাঁদা দিতেন। স্কটল্যান্ডের ডা. কাজী ফজলুল হক এবং সাসেক্সের ডা. এম বখত মাজমাদার তাঁদের অন্যতম। উভয়ের বিদেশি স্ত্রী। ম্যানচেস্টার এলাকার ড. সালেহ আহমদ, নুরুল আলম, জর্জিসুর রহমান, সুশান্ত বিশ্বাস, খুলনার তৈয়বুর রহমান, নজরুল (যিনি ১৯৭২ সালে লন্ডনে শেখ মুজিবুর রহমানের পিত্তথলি অপারেশনে প্রধান সহকারী ছিলেন), চট্টগ্রামের আবদুর রহিম, চক্ষু চিকিৎসক নূর হোসেন ও আরও অনেকে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ব্যাপক উৎসাহ ও সহযোগিতা দেন নিউইয়র্কের চিকিৎসক ডা. খন্দকার মো. আলমগীর; যিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ঢাকা শহরে একটি বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠার জন্য মিরপুরে তাঁর একখণ্ড জমি ও দুই কোটি টাকা গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রকে তিনি দান করেছেন।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের অ্যাকাউন্ট খোলা হয় মিডল্যান্ড ব্যাংকে। পরের সপ্তাহে এক জরুরি বৈঠকে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, যত দ্রুত সম্ভব, মে মাসের মধ্যেই ডা. জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী ও ডা. এম এ মবিন নিজ খরচে কলকাতা যাবেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য।
সকল সদস্যকে অনুরোধ করা হয় বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতার সংগ্রামের বিষয়টি ব্রিটেনের স্থানীয় জনসাধারণকে অবগত করার জন্য এবং ভারতে আশ্রয়প্রাপ্ত বাংলাদেশের উদ্বাস্তুদের কাপড়চোপড় ও ওষুধপত্র দিয়ে সাহায্য করার জন্য। কয়েকটি ভ্যান নিয়ে চিকিৎসকদের চার-পাঁচটি দল প্রতি শুক্রবার সন্ধ্যায় বেরিয়ে পড়তেন জড়ো করা সংগৃহীত সাহায্যসমূহ লন্ডনে নিয়ে এসে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে প্যাকেট করার জন্য। সংগৃহীত ওষুধ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাগ করে প্যাকেট করা হতো। অনেক চিকিৎসকের স্ত্রীরা এ কাজে সহায়তা করতেন।
মুক্তিযুদ্ধ পর্যবেক্ষণে যাত্রা, বিমানবন্দরে পাকিস্তানের হস্তক্ষেপ
হাইড পার্ক চত্বরে পাকিস্তানি পাসপোর্ট ছিঁড়ে পুড়িয়ে দিয়ে রাষ্ট্রবিহীন নাগরিকে পরিণত হওয়ায় যোগাযোগ করি ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্র দপ্তরে। সেখান থেকে আমাদের দেয়া হয় ‘রাষ্ট্রবিহীন নাগরিকের’ একটি এক পৃষ্ঠার প্রত্যয়নপত্র। ওটা দেখিয়ে জরুরি ভিত্তিতে সংগ্রহ করি ভারতীয় ভিসা। নয়াদিল্লির উদ্দেশে যাত্রার পূর্বদিনে হঠাৎ ব্রিটিশ গোয়েন্দা বিভাগ স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড থেকে সাদা পোশাকের এক অফিসার দেখা করে আমাদের সতর্ক থাকতে বললেন এবং জানালেন যে বাংলাদেশের পক্ষে যারা সক্রিয়, তাদের খোঁজখবর নিচ্ছে পাকিস্তান দূতাবাস। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিলেতের ‘হোম’ মিনিস্ট্রিকে অনুরোধ করেছেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত।
সম্ভবত ১৬ মে ১৯৭১ আমরা লন্ডন হিথ্রো বিমানবন্দর থেকে সিরিয়ান এয়ারলাইন্সে ভারতের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করি। প্লেন ছাড়ার পর আমি টানা ঘুম দিলাম। দামেস্ক বিমানবন্দরে এক ঘণ্টার বিরতি। স্বল্প বিরতির কারণে আমরা প্লেন থেকে নামলাম না। এক ঘণ্টার স্থলে চার ঘণ্টা পেরিয়ে গেল, কিন্তু প্লেন ছাড়ছে না। যাত্রীরা সবাই উসখুস, বিরক্ত। আমি বিমানবালাকে ডেকে প্রশ্ন করলাম, ‘দেরি কেন হচ্ছে? প্লেনে কি কোনো যান্ত্রিক বিপত্তি ধরা পড়েছে? আর কতক্ষণ লাগবে?’ নীরস ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বিমানবালা আমাদের দু’জনকে দেখিয়ে জবাব দিলেন, ‘আপনাদের কারণে সিরিয়ান এয়ারলাইন্সের দামেস্ক থেকে নয়াদিল্লি যাত্রা বিঘ্নিত হয়েছে। পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ তাদের দুই নাগরিককে গুরুতর অপরাধের বিচারের জন্য পাকিস্তানে ফেরত নিয়ে যেতে চাইছে।’
দামেস্ক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জানাল, প্লেনে কোনো পাকিস্তানি নাগরিক নেই। পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ দাবি করল, ডা. জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী ও ডা. এম এ মবিন পাকিস্তানি নাগরিক, রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপের বিচারের জন্য সিরিয়া ও পাকিস্তান দুই ভ্রাতৃপ্রতিম দেশের চুক্তি অনুসারে সিরিয়া তাদের দু’জনকে পাকিস্তানের কাছে হস্তান্তর করতে বাধ্য। সিরিয়ার কর্তৃপক্ষ জানাল ব্রিটিশ সরকারের প্রত্যয়ন অনুযায়ী এই দু’জন পাকিস্তানি নন, রাষ্ট্রবিহীন নাগরিক। দ্বিতীয়ত তাঁরা সিরিয়ার ভৌগোলিক এলাকা দামেস্কে অবতরণ করেননি। তাঁরা প্লেনে অবস্থান করছেন; যা আন্তর্জাতিক আইনের অধীন, সিরিয়ার আইনের বহির্ভূত এলাকা; তাই তাঁদের পাকিস্তানের কাছে হস্তান্তর করা হবে আন্তর্জাতিক আইনের বরখেলাপ। শেষ অবধি, পাকিস্তান সিরিয়ার আইন বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য মেনে নিয়ে প্রস্থান করলে বিমান নয়াদিল্লির উদ্দেশে যাত্রার প্রস্তুতি নেয়। আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি।
পরের দিন আমরা দিল্লি পৌঁছি। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতিনিধি আমাদের স্বাগত জানিয়ে বলেন, দামেস্ক বিমানবন্দরে পাকিস্তানি তৎপরতায় তাঁরা উদ্বিগ্ন ছিলেন। সম্ভবত লন্ডনস্থ ভারতীয় দূতাবাস পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে আমাদের সম্পর্কে তথ্য জ্ঞাত করেছিলেন।
ভারতে তৈরি অ্যাম্বাসাডর গাড়িতে করে একটি সরকারি অতিথিশালায় আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো। শুরু হলো বিভিন্ন সচিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ, তাঁদের কেউ কেউ বাঙালি এবং পূর্ব বাংলা থেকে বিভিন্ন সময়ে প্রত্যাগত। দিল্লির রাস্তায় বিদেশি গাড়ির বাহুল্য চোখে পড়েনি। বিপরীতে দেখেছি পাকিস্তানের সকল বড় শহরে বিদেশি গাড়ির ভিড়। দেখা হলো বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম আনুগত্য প্রকাশ-করা দিল্লির পাকিস্তান হাইকমিশন ছেড়ে আসা সাহসী সেকেন্ড সেক্রেটারি শেহাবুদ্দিন ও প্রেস সচিব আমজাদুল হকের সঙ্গে। তাঁদের মনে কোনো ভীতি নেই, শঙ্কা নেই। তাঁদের একমাত্র বাসনা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষ পরামর্শ দিল ভারতীয় পুলিশের অনুমতি ছাড়া কলকাতার বাইরে না যেতে, কলকাতার আইনশৃঙ্খলার অবস্থা ভালো নয়। কিছু ‘দুষ্কৃতকারী’ নকশাল সমস্যা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। আরও বললেন, কয়েকদিন কলকাতায় থেকে ফিরে যেতে, বিলেতে ওষুধপত্র ও কাপড়চোপড় যা সংগৃহীত হবে তা ভারতীয় দূতাবাসে পৌঁছে দিলে তাঁরা ভারতীয় জাহাজে করে এনে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত শরণার্থীদের মধ্যে বিতরণ করে দেবেন, চাইলে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য পৌঁছে দেবেন।
কলকাতায় প্রথম সপ্তাহে যা দেখলাম-জানলাম
দুই দিন পর ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সে রাতে কলকাতা দমদম বিমানবন্দরে পৌঁছলাম। উৎসাহ ও উৎকণ্ঠা নিয়ে ট্যাক্সি করে সোজা চলে গেলাম বাংলাদেশ হাইকমিশনে। ধারণা ছিল যুদ্ধ যখন চলছে তখন নিশ্চয়ই সারা রাত কমিশন খোলা, সবাই ব্যস্ত, কর্মচাঞ্চল্যে ভরপুর। পৌঁছে চমকে দেখলাম হাইকমিশন নীরব নিষ্প্রভ। অনেক চেষ্টার পর খবর পৌঁছালাম পাকিস্তানের সাবেক ডেপুটি হাইকমিশনার এবং বাংলাদেশের প্রতিনিধি হোসেন আলীর কাছে। তিনি আমাদের কথা শুনে বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন, ‘আপনারা কষ্ট করে কেন এসেছেন, থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা নেই। যান, রাতটা লিটন হোটেলে কাটান, তাদের এয়ারকন্ডিশন্ড রুম আছে।’ ধাক্কা খেলাম, এয়ারকন্ডিশন্ড রুমে আরাম-আয়েশে থাকার জন্য তো আমরা লন্ডন থেকে কলকাতায় আসিনি। হাইকমিশনের মেঝেতে শয়নব্যবস্থা করলে বেশি খুশি হতাম। এসি হোটেলে অর্থ ব্যয় না করে, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সে টাকা ব্যয় তো সঠিক কাজ।
পরের দিন অনেকের সঙ্গে দেখা হলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র, রাজনৈতিক কর্মী। সবার একই কথা, তাঁরা ভয়ানক কষ্টে আছেন, আহার বাসস্থানের ব্যবস্থা নেই; একই প্রশ্ন– ‘প্রাণের তাগিদে আমরা দেশ ছেড়েছি, আপনারা কেন এসেছেন?’ কেউ কেউ জানতে চাইলেন বিদেশে যাবার জন্য সাহায্য করতে পারব কিনা।
দেখা হলো ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, আমীর-উল ইসলাম ও প্রবাসী সরকারের পররাষ্ট্র সচিব মাহবুবুল আলম চাষীর সঙ্গে। চাষী আমাদের নিয়ে গেলেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের কার্যালয়ে, ৮নং থিয়েটার রোডে। প্রথমে সাক্ষাৎ করালেন কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানীর সঙ্গে। ছাত্রজীবনে তাঁর সঙ্গে একবার পরিচয় হয়েছিল। ১৯৬২-৬৩ সালে তিনি রাওয়ালপিন্ডি থেকে ঢাকা এসেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানি ছাত্রদের সামরিক বাহিনীতে যোগদানে উৎসাহিত করার জন্য। তিনি সিলেটি ভাষা ভালো বলেন, আলাপনে বাংলার চেয়ে ইংরেজি বেশি ব্যবহার করেন।
আমরা লন্ডন থেকে এসেছি শুনে হাত বাড়িয়ে বললেন, ‘ওয়েলকাম ইয়াংম্যান। হাউ ইজ লন্ডন নাও এ ডেইজ, হাউ ইজ তাসাদ্দুক? গ্যানজেস কেমন চলছে? সিলেটিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন, আমার কথা বলবেন, সব সিলেটবাসী আপনাদের সাহায্য করবে অকাতরে।’ তিনি আমাদের নিয়ে গেলেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কাছে। দেখলাম তিনি গভীর চিন্তায় মগ্ন। বসতে বলেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী কেমন আছেন, বাঙালিদের বিভেদ, দলাদলি কীভাবে সামাল দিচ্ছেন? বাম রাজনৈতিক দলগুলো চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে আছে তো? যুদ্ধ চলছে, দেশ পাকিস্তানি বাহিনীর হাত থেকে পুরো মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চলবে। নিজেরা গিয়ে দেখুন, বিলেতের প্রবাসী বাঙালিদের সংঘবদ্ধভাবে সাহায্য করতে বলবেন। বিলেতের ডাক্তারদের তো অনেক আয়।’
তিনি আরও বললেন, যুদ্ধ চলছে যশোরে, আগরতলা সীমান্তে নিজেরা গিয়ে দেখে আসুন। প্রস্তুতি চলছে গেরিলা যুদ্ধেরও, মুক্তিবাহিনী সত্বর দেশের অভ্যন্তরে আক্রমণ শুরু করবে। তাজউদ্দীন সাহেবের বক্তব্যে আমরা ভীষণ আশান্বিত হলাম। বুঝলাম, যোগ্য লোকের হাতেই নেতৃত্ব আছে। এখানে নিশ্চয় বিলেতের মতো দলাদলি নেই। ভুল অবশ্য ভাঙল কয়েক দিন পরেই।
পরের দিন গেলাম যশোর সীমান্তে। ক্যাপ্টেন হাফিজ যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন, যদিও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রচণ্ড চাপে যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে পিছু হটে ভারতীয় সীমান্তে আশ্রয় নিয়েছেন কিন্তু ক্লান্তি বা হতাশার চিহ্ন নেই। অধিকতর উদ্যমে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত ছাত্র ও শ্রমিকদের রণকৌশল শেখাচ্ছেন। ক্যাপ্টেন হাফিজ নিজের জন্য কিছু চাইলেন না; বললেন, ‘তরুণ গেরিলাদের কাপড়চোপড় ও খাদ্য দিয়ে সাহায্যের চেষ্টা করুন।’
সেখান থেকে ফিরে দেখা হলো কাজী জাফর ও মেননের সঙ্গে। মেননের ভাই সাদেক খান বললেন, ‘যুদ্ধ দেখতে হলে আগরতলা যান, সেখানে খালেদ, জিয়া, সফিউল্লাহর নাগাল পাবেন, দেখবেন বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর ও পুলিশ কীভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে, তরুণ গেরিলারা প্রস্তুতি নিচ্ছে ঢাকা আক্রমণের জন্য।’
সাদেক খান ভালো ছাত্র ছিলেন, ম্যাট্রিক-ইন্টারমিডিয়েটে প্রথম হয়েছিলেন। সার্বক্ষণিক কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী থাকায় অনিয়মের কারণে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হন এবং কয়েক বছর লেখাপড়া বন্ধ রাখেন, পরে কিছুদিন অভিনয়ে ও চলচ্চিত্র নির্মাণের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। পরবর্তী সময়ে ব্যবসায়ে অত্যন্ত সফল হয়েছিলেন।
আমরা বোকার মতো সরল মনে কলকাতা পুলিশের কাছে আগরতলা ও আসাম যাবার আগ্রহ প্রকাশ করি। দুই দিনের মধ্যে অনুমতি পেয়ে যাব আশ্বাস দিলেও চার দিনেও অনুমতিপত্র না পাওয়ায় বিষণ্ন হয়ে পড়ি। আমাদের দুঃখের কথা শুনে সাদেক ভাই বললেন, ‘বোকামি করেছেন, পুলিশের কাছে কেন গিয়েছেন, কখনও তো অনুমতি পাবেন না। নাম বদলিয়ে টিকিট কেটে সোজা আগরতলা চলে যান। সেখানে খালেদ মোশাররফের সাক্ষাৎ পাবেন।’ সাদেক খান এজেন্টের মাধ্যমে মি. জেড চৌধুরী ও মি. মবিন নামে টিকিটের ব্যবস্থা করে দিলেন।
সপ্তম দিনে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সে কলকাতা থেকে আগরতলা পৌঁছাই। পূর্ব পাকিস্তানের মহকুমা শহরের চেয়েও ছোট আগরতলা শহর। হোটেলের সন্ধানে শহরের প্রবেশপথে প্রথম দেখা হলো ছাত্রলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মনির সঙ্গে। ছাত্রজীবনে আমি ছাত্র ইউনিয়ন করতাম বলে মনির সঙ্গে সম্পর্ক ভালো ছিল না। তাই একটু শঙ্কিত হয়ে তাকাতেই মনি বললেন, ‘ডাক্তার, আমি জানতাম আপনি আসবেন, কমিউনিস্টরা লন্ডনে বসে থাকবে না।’ হাসিমুখে ভালো ব্যবহার করলেন। জিজ্ঞেস করলেন কলকাতায় কার কার সঙ্গে দেখা হয়েছে।
‘প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ’ বলার সঙ্গে সঙ্গে ফজলুল হক মনি হঠাৎ রেগে গেলেন। বললেন, ‘কোথাকার প্রধানমন্ত্রী? কে তাকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছে? তাজউদ্দীন, নিজে নিজেকে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেছেন। আওয়ামী লীগের ভেতরে লুকিয়ে থাকা কমিউনিস্ট।’ আমরা হতভম্ব হয়ে গেলাম। ভাবলাম যুদ্ধের সময় যদি এমন বিভেদ থাকে ভবিষ্যতে কী হবে? নিশ্চয়ই তাজউদ্দীন সাহেবের জীবনটা সুখের হবে না। স্বাধীনতা-উত্তরকালে সেই আশঙ্কাই সত্য প্রমাণিত হয়েছিল। ‘কৃতঘ্ন’ শব্দটা বাংলা ভাষায় আছে, অন্য ভাষায় নেই। ষড়যন্ত্র থেমে ছিল না। যুদ্ধের সময় ভারতীয় কর্তৃপক্ষ মনির সহায়তায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অজ্ঞাতে বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ) সৃষ্টি করেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের সমান্তরাল অপর একটি বাহিনী হিসেবে।
দেখা হলো চট্টগ্রামের এম আর সিদ্দিকী সাহেবের সঙ্গে। তিনি ওই রাতের জন্য তাঁদের সঙ্গে আগরতলা সার্কিট হাউসে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। পরের দিন ভোরেই রওনা হলাম দুই নম্বর সেক্টরের উদ্দেশে মেলাঘরের পথে। সাক্ষাৎ হলো মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর জিয়া, মেজর সফিউল্লাহ, মীর শওকত আলী ও অন্যদের সঙ্গে। যুদ্ধে ফিল্ড হাসপাতালের প্রয়োজনীয়তা বুঝিয়ে বলার পর খালেদ বললেন, ‘আমার ডাক্তারের প্রয়োজন নেই। আমার প্রয়োজন অস্ত্র এবং বুলেট অ্যান্ড বুলেটস। আপনারা লন্ডন ফিরে গিয়ে IRA-এর সঙ্গে যোগাযোগ করুন। আমাদের জন্য রাতে দেখা যায়– এমন বাইনোকুলার, ছোট ডুবুরি যান মিডগেট এবং ছোট ছোট অস্ত্র জোগাড় করে পাঠান। চেকোস্লোভাকিয়ায় অল্পমূল্যে স্বয়ংক্রিয় ছোট অস্ত্র পাওয়া যায়।’

l আগামী সংখ্যায় সমাপ্য




কয়েক দিনের মধ্যে আহত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেড়ে গেলে মেজর খালেদ তাঁর মত বদলাতে বাধ্য হন। দুই মাসের মধ্যে গড়ে ওঠে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর দেহরক্ষী হাবুল ব্যানার্জীর আনারস বাগানে ৪৮০ বেডের ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’। প্রবাসী সরকারের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ প্রাথমিকভাবে কিছু অর্থ সাহায্য করেছিলেন। বেশির ভাগ খরচ ও সকল যন্ত্রপাতি পাঠিয়েছিল লন্ডনস্থ বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন। হাসপাতাল তৈরির মূল কৃতিত্ব ডা. মবিনের। এই হাসপাতালে ২২ অক্টোবর তারিখে মাথায় গুলিবিদ্ধ মেজর খালেদ মোশাররফ প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছিলেন, পরে স্থানান্তরিত হয়েছিলেন লক্ষ্ণৌতে ভারতীয় সেন্ট্রাল কমান্ডের মিলিটারি হাসপাতালে।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন থেকে অপর চারজন চিকিৎসক কাজী কামরুজ্জামান, বরকত আলী চৌধুরী, আলতাফুর রহমান ও মাহফুজ অক্টোবর মাসে ভারতে এসে বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবা দেন। বিজয় প্রাক্কালে বিলেত থেকে আসেন ডা. মোশাররফ হোসেন জোয়ারদার, যাঁর ঢাকায় শিশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ ছিল। ডা. বরকত চৌধুরী বর্তমানে অসুস্থ, আলহাইজাইমার রোগে আক্রান্ত; ডা. কাজী কামরুজ্জমান ঢাকায় মগবাজারস্থ কমিউনিটি হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ স্থাপন করেছেন। ডা. মাহফুজ একজন বিশেষজ্ঞ রেডিওলজিস্ট হিসেবে বিলেতে অবসর জীবনযাপন করছেন। তিনি বাংলাদেশের এনআরবি ব্যাংকের একজন উদ্যোক্তা পরিচালক। ডা. আলতাফ লন্ডনে অবসর জীবনযাপন করছেন। মধ্যে মধ্যে বেড়াতে দেশে আসেন।


ওসমানীর অজ্ঞাতে ভারতের সঙ্গে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের চুক্তি
ফরাসি সাহিত্যিক, রোমান্টিক রাজনীতিবিদ ও ফরাসি সরকারের সংস্কৃতিমন্ত্রী আঁদ্রে মালরো স্প্যানিস সিভিল ওয়ারে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ষাটের দশকে নাইজেরিয়ায় বিয়াফ্রার যুদ্ধে মালরো বিয়াফ্রার বিদ্রোহীদের অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছিলেন। সেই যুদ্ধ হঠাৎ থেমে যাওয়ায় তাঁর কাছে বহু অব্যবহৃত অস্ত্র ছিল। মালরোর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য সেপ্টেম্বর মাসে ওসমানী সাহেব আমাকে ফ্রান্সে যাবার নির্দেশ দেন। ভারত ত্যাগের প্রাক্কালে ভারতীয় পুলিশ আমার ডায়েরিটি এবং কাস্টম কর্তৃপক্ষ দামি ক্যামেরাটা রেখে দিলেন।
প্যারিসের উপকণ্ঠে আঁদ্রে মালরোর প্রাসাদসম বাড়ি। আমার কাছে ছিল ওসমানী সাহেবের একটি চিঠি। চিঠিতে তিনি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে মালরোর সঙ্গে দেখা করতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। চিঠিটি ভারতীয় পুলিশ পরীক্ষার নিমিত্তে রেখে দিয়েছিল। বিষয়টি জেনে লন্ডনস্থ ভারতীয় দূতাবাস চক্রান্ত করে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর ফ্রান্স যাত্রায় বাধার সৃষ্টি করে। আমি একলা আঁদ্রে মালরোর সঙ্গে দেখা করি। সাক্ষাৎ-কাহিনি পরে কখনও লেখার চেষ্টা করব।
প্যারিস থেকে লন্ডন, লন্ডন থেকে কলকাতা ফেরার পরপরই ওসমানী সাহেব আমাকে লক্ষ্ণৌতে গিয়ে মারাত্মকভাবে আহত খালেদ মোশাররফকে দেখে আসতে অনুরোধ করেন। খালেদ মোশাররফ নিজে আমাকে দেখতে চেয়েছেন। খালেদ মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়কের অত্যন্ত প্রিয়জন। কলকাতা থেকে সরাসরি লক্ষ্ণৌর ফ্লাইট না পাওয়ায় দিল্লি হয়ে লক্ষ্ণৌ যাত্রা করি। দিল্লিতে কয়েকজন বিশিষ্ট বাঙালি ব্যবসায়ী ও সরকারি কর্মকর্তা সাক্ষাতে অভিনন্দন জানিয়ে বললেন, ‘সব ঠিক হয়ে গেছে, আপনারা ডিসেম্বরে ঢাকা ফিরতে পারবেন। প্রবাসী সরকারের সঙ্গে ভারতের চুক্তি হয়েছে।’ আশ্চর্য হলাম, ওসমানী সাহেব তো আমাকে কিছুই বলেননি।
লক্ষ্ণৌ সেন্ট্রাল কমান্ড হাসপাতালে খালেদ মোশাররফ আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘আমাকে লন্ডনে নিয়ে চলুন, ভারতীয়রা আমাদেরকে ভুটান-সিকিম বানাবে। তারা আমাদের চাইনিজ অস্ত্র নিয়ে ভারতীয় নিম্নমানের অস্ত্র দিচ্ছে, আমাদেরকে তাদের পদানত করে রাখার জন্য। আমি বললাম, ‘আপনার জন্য টিকিটের ব্যবস্থা তো আমিই করতে পারি, কিন্তু ভারতীয়রা আপনাকে ভারত ছাড়ার অনুমতি দেবে তো? বিষয়টি আমি সর্বাধিনায়ককে জানাব।’
ফেরার পথে একটি আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। দিল্লি-কলকাতার একটা ফ্লাইট লক্ষ্ণৌ হয়ে যায়। প্লেনে উঠে দেখি আমার পাশে আবদুস সামাদ আজাদ এমএনএ। তিনি দিল্লি থেকে উঠেছেন। তাঁর সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। তিনি ন্যাপ-ভাসানী দল করতেন। অনেকটা সময় জেলে ছিলেন। চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এলে, তাঁর পুলিশ গার্ডকে আমাদের ক্যান্টিনে বসিয়ে ভালো করে খাওয়াতাম এবং সামাদ ভাইকে গোপনে তাঁর আগামসি লেনের বাসায় পাঠিয়ে দিতাম। স্ত্রীর সঙ্গে সারাদিন কাটিয়ে বিকেলে জেলে ফেরত যেতেন। তাঁর চিকিৎসাপত্রে পুনরায় পরের সপ্তাহে চিকিৎসার জন্য আসার নির্দেশ লিখে দেবার ব্যবস্থা করতাম। আমি তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র-সংসদের সাধারণ সম্পাদক, আমার দোর্দণ্ড প্রতাপ, আমি সবার প্রিয়। সামাদ ভাই বললেন, ‘তুমি কিন্তু আমাকে দেখোনি। কাউকে বলবে না। এয়ারপোর্টে আমার গাড়ি থাকবে, সেটা নিয়ে তুমি চলে যেও। আমার জন্য অন্য একটি গাড়ি থাকবে। তুমি আমার কথা কাউকে বলো না।’ আমার অনুসন্ধিৎসা বাড়ল, জিজ্ঞেস করলাম, ‘দিল্লিতে কী করলেন? কোনো চুক্তি হয়েছে কি?’ সামাদ ভাই উত্তর দিলেন না। আমার সন্দেহ দৃঢ় হলো। কলকাতা পৌঁছে সোজা থিয়েটার রোডে ওসমানী সাহেবের রুমে। রেগে বললাম, ‘দেশ তো বেচে দিয়েছেন’। তিনি আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন যেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। আমি খালেদ মোশাররফ ও আবদুস সামাদ আজাদের সঙ্গে আমার কথোপকথনের কথা বললাম। আবদুস সামাদ আজাদের নির্দেশ অগ্রাহ্য করে তাঁদের সঙ্গে আলাপের বিস্তারিত তথ্য জানালাম। আরও জানালাম দিল্লির বিশিষ্টজন আমাকে কী বলেছেন। ওসমানী সাহেব সোজা প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন সাহেবের ঘরে ঢুকে উচ্চৈঃস্বরে বললেন, ‘You sold the country, I will not be a party to it.’ তাজউদ্দীন সাহেব কর্নেল ওসমানীকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন, নিচু স্বরে কী বললেন, আমি শুনতে পেলাম না। আমি দরজার বাইরে ছিলাম।
কয়েক দিন পরে উভয়ের মধ্যে পুনরায় বাগ্‌বিতণ্ডা ভারতীয় একটি প্রস্তাবনা নিয়ে। ডিসেম্বরে দেশ স্বাধীন হলে আইনশৃঙ্খলা স্থাপনের জন্য বেশ কয়েকজন ভারতীয় বাঙালি প্রশাসনিক ও পুলিশ অফিসাররা বাংলাদেশের সব বড় শহরে নির্দিষ্ট মেয়াদে অবস্থান নেবেন। ওসমানী সাহেব বললেন, ‘এটা হতে পারে না, আমাদের বহু বাঙালি অফিসার আছেন। কেউ কেউ পাকিস্তানে আটকা পড়েছেন। এরা নিশ্চয়ই ফিরে আসবেন।’
ওসমানী সাহেবের সঙ্গে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীদের মতপার্থক্যের কথা জেনে ভারতীয়রা আরও সতর্ক হলেন। ওসমানী সাহেবকে তাঁরা কড়া নজরে রাখলেন। কাগজে-কলমে যৌথ কমান্ডের কথা থাকলেও বস্তুত তাঁরা ওসমানী সাহেবকে একাকী করে দিলেন। ভারতীয়রা সব কমান্ড নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করলেন। ওসমানী সাহেবের সঙ্গে ভারত কর্তৃপক্ষের সম্পর্কের দ্রুত অবনতি ঘটল।

১৬ ডিসেম্বরের বিমান দুর্ঘটনা, তাৎপর্যটা কী?
পরিকল্পনা মোতাবেক বাংলাদেশি গেরিলাদের সঙ্গে নিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী অতর্কিতে সরাসরি যশোর সীমান্তে আক্রমণ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পর্যুদস্ত করে। যৌথ কমান্ড বাহিনীর অন্যতম এবং মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এম এ জি ওসমানীর যশোর পরিদর্শনে বাধা সৃষ্টি করা হলে তিনি ছাত্রনেতা কে এম ওবায়দুর রহমান ও আমাকে ৫ ডিসেম্বর ১৯৭১ যশোরের অবস্থা দেখে আসার জন্য নির্দেশ দেন। ওই দিনই আমরা যশোর ক্যান্টনমেন্ট পৌঁছে রীতিমতো হতভম্ব হয়ে পড়ি। ভারতীয় সেনারা একের পর এক পাকিস্তানি অফিসারদের বাসস্থানের এসিসহ বিভিন্ন সামগ্রী, অস্ত্রাগার, এমনকি যশোর সিএমএইচের যন্ত্রপাতি লুট করছে। বলছে, ‘বেঙ্গল রেজিমেন্ট এত বৈভব ও আরাম-আয়েশে ছিল, কেন বিদ্রোহ করেছে?’ বিষয়টা ফোনে ওসমানী সাহেবকে জানানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে ৭ ডিসেম্বর আমি কলকাতা ফিরে আসি। ওবায়দুর রহমান তাঁর জেলা ফরিদপুরের পথে অগ্রসর হবার সিদ্ধান্ত নিয়ে যাত্রা শুরু করেন। কলকাতায় পৌঁছে সঙ্গে সঙ্গে আমি পুরো বিষয়টি ওসমানী সাহেবকে জানানোর পর, তিনি আমাকে সঙ্গে নিয়ে তাজউদ্দীন আহমদকে সেটা অবহিত করেন। ভীষণ দুঃখের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘তাহলে পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় সেনাবাহিনীর তফাৎটা কোথায়?’ ওসমানী সাহেব বললেন, ‘বুঝতে পারছেন, ভারতীয়রা আমাকে কেন সরাসরি সমরাঙ্গনে যেতে দিচ্ছে না, তাদের উদ্দেশ্য ভালো না।’
কয়েক দিন অক্লান্ত চেষ্টার পর, কুমিল্লা হয়ে সিলেট পরিদর্শনের জন্য একটি বড় হেলিকপ্টার, সম্ভবত এম-৮ দেওয়া হলো ব্রিগেডিয়ার গুপ্তের তত্ত্বাবধানে। ১৩ ডিসেম্বর বিকেলে আমরা কুমিল্লা পৌঁছি। বিশ্রামের জন্য কুমিল্লা সার্কিট হাউসে পৌঁছে আমরা হতভম্ব হয়ে যাই। ওসমানী সাহেবকে হাত বাড়িয়ে ‘রিসিভ’ করছেন কয়েকজন ভারতীয় বাঙালি। একে একে পরিচয় দিলেন, ‘আমি মুখার্জি IAS, আমি গাঙ্গুলী IPS, ইত্যাদি।’ তাঁরা বললেন, ‘কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে গতকাল এখানে পৌঁছেছি কুমিল্লা মুক্ত হবার সঙ্গে সঙ্গে আমরা শহরের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও নিরাপত্তা দেবার জন্য। অবশ্য এখনও কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে যুদ্ধ চলছে।’ ওসমানী সাহেব ভারতীয় অফিসারদের সঙ্গে সার্কিট হাউসে রাত্রি যাপন করতে রাজি না হওয়ায় আমরা ওয়াপদা গেস্ট হাউসে যাই। পরের দিন ভোরবেলা থেকে ওসমানী সাহেব কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট এলাকা পরিদর্শনে বিভিন্ন পথে গেরিলাদের পাঠান এবং বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর সেনাদের সম্মুখ আক্রমণে উৎসাহ দান করেন। ফলে পাকিস্তানি সেনাদের মনোবল ভেঙে যায়। পরের দিনই তারা আত্মসমর্পণ করে। খবর পাই, ঢাকার পতন আসন্ন। আমরা ঢাকা যাবার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকি।
১৬ ডিসেম্বর সকালে ব্রিগেডিয়ার গুপ্ত জানালেন, আজ ঢাকায় পাকিস্তান সেনারা আত্মসমর্পণ করবে। ভাবলাম নিশ্চয়ই মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়কের কাছে। কিন্তু আশ্চর্য, ওসমানী সাহেব একবারে চুপ, কোনো কথা বলছেন না। খটকা লাগল।
জেনারেল ওসমানীর এডিসি আমাদের প্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বড় ছেলে শেখ কামাল আমাকে বলল, ‘স্যার কখন রওনা হবেন, তা তো বলছেন না। জাফর ভাই, আপনি যান, জিজ্ঞেস করে সময় জেনে নিন। অধীর আগ্রহে আমরা সবাই অপেক্ষা করছি।’ আমি গিয়ে জিজ্ঞেস করায় ওসমানী সাহেব বললেন, ‘I have not yet received PM’s order to move to Dacca.’ আমি বললাম, ‘আপনাকে অর্ডার দেবে কে? আপনি তো মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক।’ ওসমানী বললেন, ‘I decide tactics, my order is final for firing, but I receive orders from the cabinet through PM, Mr. Tajuddin Ahmed.’ কথাগুলো বললেন অত্যন্ত বিষণ্ন কণ্ঠে। পরিষ্কার হলো তিনি আসন্ন ঢাকা পতনের সংবাদ জানেন এবং প্রবাসী সরকারের নির্দেশের অপেক্ষা করছেন। আমাদের অস্থিরতা বাড়ছে আর বাড়ছে। শেখ কামাল বারবার আমাকে চাপ দিচ্ছে পুনরায় ভালো করে বুঝিয়ে বলে ওসমানী সাহেবকে রাজি করাতে ঢাকা রওনা হবার জন্য। ঘণ্টাখানেক সময় পরে, পুনরায় ওসমানী সাহেবের সামনে দাঁড়ানোর পরপরই তিনি অত্যন্ত বেদনার্ত কণ্ঠে যা বললেন তার মর্মার্থ হলো, ‘আমার ঢাকার পথে অগ্রসর হবার নির্দেশ নেই। আমাকে বলা হয়েছে পরে প্রবাসী সরকারের সঙ্গে একযোগে ঢাকা যেতে, দিনক্ষণ তাজউদ্দীন সাহেব জানাবেন। গণতন্ত্রের আচরণে যুদ্ধের সেনাপতি প্রধানমন্ত্রীর অধীন, এটাই সঠিক বিধান।’ মনে হলো, তিনি জেনেশুনে বিষপান করছেন। পরে ব্রিগেডিয়ার গুপ্তকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘সিলেটের কী অবস্থা?’ ব্রিগেডিয়ার গুপ্ত জানালেন ‘সিলেট ইজ ক্লিয়ার’। ওসমানী বললেন, ‘তাহলে চলুন আমরা সিলেট যাই, সেখানে গিয়ে আমার পিতামাতার কবর জিয়ারত করব, শাহজালালের পুণ্য মাজারে আমার পূর্বপুরুষরা আছেন।’ ওসমানী সাহেব শেখ কামালকে ডেকে সবাইকে তৈরি হতে বললেন। আধাঘণ্টার মধ্যে আমাদের আকাশে নিরুপদ্রব যাত্রা। ভারতীয় এম-৮ হেলিকপ্টারে সিলেটের পথে চলেছি। পরিষ্কার আকাশ। হেলিকপ্টারের যাত্রী জেনারেল ওসমানী ও তাঁর এডিসি শেখ কামাল, মুক্তিবাহিনীর চিফ অব স্টাফ জেনারেল এম এ রব এমএনএ, রিপোর্টার আল্লামা, ব্রিগেডিয়ার গুপ্ত, ভারতীয় দুই পাইলট এবং আমি। কেউ কথা বলছেন না, সবাই নীরব।
অতর্কিতে একটি প্লেন এসে চক্কর দিয়ে চলে গেল। হঠাৎ গোলা বিস্ফোরণের আওয়াজ, ভিতরে জেনারেল রবের আর্তনাদ। পাইলট চিৎকার করে বলল, ‘উই হ্যাভ বিন অ্যাটাকড।’ রবের ঊরুতে আঘাতের পরপরই তার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলো। আমি এক্সটার্নাল কার্ডিয়াক ম্যাসাজ দিতে শুরু করি। পাইলট চিৎকার করলেন, ‘অয়েল ট্যাংক হিট হয়েছে, তেল বেরিয়ে যাচ্ছে, আমি বড়জোর ১০ মিনিট উড়তে পারব।’ কো-পাইলট গুনতে শুরু করলেন– ওয়ান, টু, থ্রি... টেন... টুয়েন্টি ... থার্টি ... ফোরটি ... ফিফটি ... নাইন সিক্সটি-ওয়ান মিনিট গন। এভাবে মিনিট গুনছেন উদ্বিগ্ন চিন্তিত কো-পাইলট। অন্য পাইলট ধীরস্থিরভাবে পাইলটের আসনে বসা। ওসমানী সাহেব লাফ দিয়ে ওঠে, অয়েল ট্যাংকের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করলেন, ‘জাফরুল্লাহ্, গিভ মি ইয়োর জ্যাকেট’। আমি আমার জ্যাকেটটা ছুড়ে দিলে, ওসমানী সাহেব সেটা দিয়ে তৈলাধারের ছিদ্র বন্ধের চেষ্টা করতে থাকলেন। বললেন, ‘Do not worry my boys, I know Sylhet like the palm of my hands.’ কার্ডিয়াক ম্যাসাজ দেবার ফাঁকে ফাঁকে আমি ভাবছিলাম, আজ ১৬ ডিসেম্বর, দেশ স্বাধীন হবে। কিন্তু আজ আমরা সবাই কিছুক্ষণের মধ্যে মারা যাব। আগামীকাল পত্রিকায় শোক সংবাদ কলামে কী লেখা হবে? বীরের মৃত্যু, অপঘাতে মৃত্যু? কার গোলাতে এই দুর্ঘটনা? পাকিস্তানের সব বিমান তো কয়েক দিন আগেই ধ্বংস হয়েছে কিংবা গ্রাউন্ডেড করা হয়েছে। তাহলে আক্রমণকারী বিমানটি কাদের? গোলা ছুড়ে সেটি কোথায় চলে গেল? গৌহাটির পথে? চিন্তা বিঘ্নিত হলো ওসমানী সাহেবের চিৎকারে। নিচে একটা জায়গার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, ‘Land here’। আরও বললেন, ‘Let me land first to taste the enemy attack if there is one।’ লাফ দিয়ে তিনি নামলেন, ‘ধরুন’ বলে আমি জেনারেল রবকে ছুড়ে দিলাম, সঙ্গে নামলাম নিজেও। আমার পিছনে পিছনে অন্যরা লাফিয়ে নামলেন। হেলিকপ্টারটা আমাদের চোখের সামনে দাউ দাউ আগুনে পুড়ছে।
হঠাৎ গ্রামবাসী এসে ওসমানী সাহেবকে ঘিরে ধরল, ‘দুশমন আইছে রে বা দুশমন আইছে, দুশমনরে ধর।’ পরপরই ভালো করে তাকিয়ে দেখে হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, ‘আমাদের কর্নেল সাব রে বা।’ তারপর তাঁকে নিয়ে নাচতে শুরু করল।
জনতার বিজয় উল্লাসে যেন জেনারেল রবের ঘুম ভাঙল, তিনি চোখ খুলে তাকালেন, দেখলেন আমার মুখে হাসি। জেনারেল রব সবাইকে বলতেন, ‘ডা. জাফরুল্লাহ্ আমাকে দ্বিতীয় জীবন দিয়েছেন।’ হেলিকপ্টারে ব্রিগেডিয়ার গুপ্ত এবং শেখ কামালও সামান্য আহত হয়েছিলেন।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কখনও এই ঘটনার তদন্ত প্রকাশ করেনি। ভারত সরকার সব সময় এই ঘটনার ব্যাপারে নীরব, নিশ্চুপ।
স্বাধীনতার বিজয় উল্লাসে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারও দুর্ঘটনাটির তদন্তের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব উপলব্ধি করেনি। সবাই উদ্বিগ্ন, প্রাণপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবের দেশে জীবিত প্রত্যাবর্তনের কামনায়।


আবু সাঈদ চৌধুরীর পরিশ্রমের ফসল
একাত্তরের ২৬ মার্চ বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী জেনেভা থেকে লন্ডন পৌঁছান। ঢাকার ধ্বংসযজ্ঞের আরও বিস্তারিত সংবাদ দেখলেন পরের দিন বিবিসি ও লন্ডন টাইমস পত্রিকায়।
আবু সাঈদ চৌধুরীর সাথে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৬২ সালে। তখন তিনি পাকিস্তান হাইকোর্টের নবীন বিচারপতি। আমার ভাইয়ের শ্বশুর বিচারপতি ইমাম হোসেন চৌধুরী তখন হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি। দেশে আইয়ুব খানবিরোধী আন্দোলন চলছে। এরই মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজে রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপিত হচ্ছে। আইয়ুব খান-মোনেম খানের কোনো মন্ত্রীকে প্রধান অতিথি করা যাবে না। প্রধান বিচারপতিকে প্রধান অতিথি করার সিদ্ধান্ত হয়। আমি আপত্তি তুলি। কারণ, বিচারপতি ইমাম হোসেন চৌধুরী অত্যন্ত রক্ষণশীল প্রাচীনপন্থি এবং সামরিক সরকারঘেঁষা। তাই তাঁর পরিবর্তে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর জুনিয়র, পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের স্পিকার টাঙ্গাইলের আব্দুল হামিদ চৌধুরীর পুত্র ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি, ব্যারিস্টার আবু সাঈদ চৌধুরীকে প্রধান অতিথি হবার জন্য অনুরোধ জানাই। তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র-সংসদের রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠানে একটি জ্ঞানগর্ভ ভাষণ দেন; যা খুব প্রশংসিত হয়েছিল।
২৮ মার্চ আমি লন্ডনের বালহাম এলাকায় গিয়ে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। সামান্য পরিচয় দিতেই তিনি আমাকে চিনলেন, বললেন তিনি সত্বর ঢাকা ফিরে যাচ্ছেন। তাঁর ছাত্রদের মারা হচ্ছে, বিহিত করতে হবে। আমি বললাম, ‘সর্বনাশ, এত বড় ভুল করবেন না। ঢাকায় প্রতিবাদ করতে গেলে আপনার জীবননাশের যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। আপনি বরং লন্ডনে থেকে বাংলাদেশের সপক্ষে জনমত গড়ে তুলুন। ব্রিটেনে আপনার উপস্থিতির একান্ত প্রয়োজন রয়েছে। প্রবাসী বাঙালিদের আপনি নেতৃত্ব দিন। প্রবাসী বাঙালিরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, উপদলে বিভক্ত। প্রগতিশীল বাম সংগঠনগুলো বিভিন্ন মতবাদে বিচ্ছিন্ন। আপনি হবেন সম্মিলিত প্রবাসী বাঙালিদের নেতা।’ তিনি হেসে বললেন, ‘গত দু’দিনে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এসেছিলেন এবং তাদের সঙ্গে যোগদানের জন্য অনুরোধ করেছেন। আপনি সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা বলছেন।’ বিচারপতি চৌধুরী ওই দিনই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংস হত্যার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে ইস্তফা দেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের স্বার্থে সক্রিয়ভাবে সব প্রবাসী বাঙালিকে একত্রিত হওয়ার মূল দায়িত্ব পালন শুরু করেন। তাঁর জীবনের সাধনা দাঁড়াল বাংলাদেশের পক্ষে ব্রিটেন, ইউরোপ ও আমেরিকায় জনমত সৃষ্টি এবং আমাদের নেতা বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন বাঁচানো।
এপ্রিল থেকে জুলাই– চার মাস বিচারপতি চৌধুরী অক্লান্ত পরিশ্রম করে চরকির মতো এক শহর থেকে অন্য শহরে ঘুরলেন, দেখা করলেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর, ডিন এবং বিচারপতিদের সঙ্গে। কয়েকবার হাজির হলেন ব্রিটিশ পার্লামেন্টে, সাক্ষাৎ করলেন মন্ত্রী ও ছায়া-মন্ত্রীদের সঙ্গে, দীর্ঘ আলোচনা করলেন রক্ষণশীল দলের নেতা স্যার জেরাল্ড নবারো, রেভারেন্ড ইয়ান পেইসলি এবং বামপন্থিদের কণ্ঠস্বর ইয়ান মির্কাডো ও এন্ড্রু ফাউলসের সঙ্গে।
আবু সাঈদ চৌধুরী একাধারে বিচারপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সে কারণে গণ্যমান্য সবার সঙ্গে সাক্ষাৎ করা তাঁর জন্য সহজ হয়েছিল। ২৪ এপ্রিল তাঁর আত্মবিশ্বাস, দৃঢ়তা ও নিরপেক্ষতায় বিলেতের কভেন্ট্রি শহরে গঠিত হয় ‘বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটি’ এবং কর্মপরিচালনার জন্য পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি স্টিয়ারিং কমিটি। আজিজুল হক ভুঁইয়া মনোনীত হলেন আহ্বায়ক। ওই সভার সভানেত্রী ছিলেন শিক্ষিকা লুলু বিলকিস বানু।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও সোশ্যালিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সাধারণ সম্পাদক মার্টিন এনালস ও হ্যানস ইয়ান্টসেককে শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য চেষ্টা করতে রাজি করালেন। আবু সাঈদ চৌধুরীর পরামর্শে ব্রিটিশ এমপি জন স্টোনহাউজ, ব্রুস ডগলাসম্যান ও পিটার শোর ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্যদের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বর নিষ্ঠুরতার বিষয়ে আলোচনার জন্য ১৪ মে তারিখে পার্লামেন্টের আলোচ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করতে সমর্থ হন। আলোচনার আগের দিন ‘নীরব বিবেক’ নামে দৈনিক গার্ডিয়ান পত্রিকা একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করে।
উল্লেখ্য যে, মার্চে ঢাকায় ধ্বংসযজ্ঞের বিবরণ দিতে গিয়ে বিলেতের অবজারভার পত্রিকায় বাঙালি চরিত্রের বর্ণনা দেয় এইভাবে যে, দু’বাঙালি দু’জনে আলাদা দুই দল গঠন করে আবার দু’জন মিলে তৃতীয় দল তৈরি করে। বাঙালিরা শান্তিপ্রিয় কিন্তু ভীতু প্রকৃতির। তারা এবার ক্ষেপেছে, রুখে দাঁড়াবে, হয়তোবা অচিরেই পৃথিবীতে একটি নতুন দেশ তৈরি হবে।
ব্রিটেনের ছায়া-সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেনিস হিলি পার্লামেন্টে শেখ মুজিবের মুক্তির ওপর বিশেষ জোর দেন এবং বলেন ‘শেখ মুজিবই সমস্যা সমাধানের চাবিকাঠি।’ প্রবাসী সরকারের পরামর্শে ২৪ মে বিচারপতি চৌধুরী গ্লাসগো থেকে নিউইয়র্ক গেলেন। শুরু করলেন একে একে অনেক সিনেটর ও কংগ্রেসম্যানের সঙ্গে সাক্ষাৎ। যুক্তিতর্ক দিয়ে বোঝালেন তাঁদেরকে বাংলাদেশের পক্ষে থাকার জন্য। বললেন, শেখ মুজিব তো তাঁদেরই মতাদর্শের মানুষ ও পুঁজিবাদের প্রবক্তা, উপমহাদেশে শান্তির জন্য শেখ মুজিবের অনতিবিলম্বে মুক্তি অত্যাবশ্যক।
বিচারপতি চৌধুরীর প্রচেষ্টায় জুন মাসে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের চারজন বিশিষ্ট সদস্য– কনজারভেটিভ দলের জেমস রেমস্টেন ও টবি জোসেফ এবং শ্রমিক দলের আর্থার বটমলি ও রেজিনান্ড প্রেনটিস– বাংলাদেশ ও ভারত সফর করে যে তথ্য প্রকাশ করেন তাতে বিশ্ববাসীর বিবেক জাগ্রত হয়।
২৬ জুলাই তারিখে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশের মানচিত্র ও শেখ মুজিবের ছবিযুক্ত দুটি ডাকটিকিট উন্মোচিত হয়। ১ আগস্ট ট্রাফলগার স্কয়ারের জনসভায় লন্ডনে বাংলাদেশ দূতাবাস স্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
১০ আগস্ট পাকিস্তান সরকার রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে ফাঁসি দাবি করে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার শুরু করে। চিন্তিত বিচারপতি চৌধুরী বিভিন্ন সহানুভূতিশীল রাষ্ট্রের সহায়তায় জাতিসংঘে শেখ মুজিবের বিচার বন্ধের দাবি উপস্থাপন করলেন এবং পুরো সেপ্টেম্বর মাস পরিভ্রমণ করলেন একে একে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশসমূহ– নরওয়ে, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড ও সুইডেন। দেখা করলেন ওইসব দেশের প্রধান বিচারপতিদের সঙ্গে। অর্থনীতিবিদ গুনার মিরডাল শেখ মুজিবের মুক্তির লক্ষ্যে সুইডেনস্থ বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিতে রাজি হলেন। অসলো বিশ্ববিদ্যালয় পাকিস্তানের গণহত্যা সংক্রান্ত কমিশন গঠনে উৎসাহিত হলো।
ভারতের দৃষ্টি এড়িয়ে বাংলাদেশকে সমর্থন ও স্বীকৃতিদানের জন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম যৌথভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রথম চিঠিটি লেখেন যেটি ২৬ মে ১৯৭১ বার্লিন থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে পাঠানো হয়। ২৮ সেপ্টেম্বর খন্দকার মোশতাক কলকাতাস্থ মার্কিন দূতাবাসের সঙ্গে বৈঠক করে বলেন যে, শেখ মুজিবের মুক্তি বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেয়ে কম মূল্যবান নয়। এই আলোচনায় সৈয়দ নজরুল ইসলামের সম্মতি ছিল। শোনা যায় আওয়ামী লীগের জহিরুল কাইয়ুমসহ অপর ৪৩ জন জাতীয় সংসদ সদস্য আলোচনা সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলেন।
খন্দকার মোশতাক মার্কিন দূতাবাসকে বুঝিয়েছিলেন, শেখ মুজিববিহীন বাংলাদেশ হবে পুরোপুরি কমিউনিস্ট নিয়ন্ত্রিত ভারতের করদ রাজ্য। অক্টোবর মাসে ভারত প্রবাসী সরকার ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোপন আলোচনার সংবাদ পেয়ে ইন্দিরা গান্ধীর পররাষ্ট্র-বিষয়ক পরামর্শদাতা ডি পি ধর কলকাতায় এসে মোশতাককে বিশ্বাসঘাতক আখ্যা দেন এবং প্রবাসী সরকারকে পরামর্শ দেন। আবদুস সামাদ আজাদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিযুক্ত হন।
বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী প্রকৌশলী এফ আর খান ও অন্যদের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনকে প্রভাবিত করেন শেখ মুজিবের বিচার স্থগিতের জন্য। যুক্তরাষ্ট্র শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা থেকে রেহাই দিয়ে ফাঁসির দণ্ড থেকে মুক্তি দেবার জন্য ইয়াহিয়া খানকে অনুরোধ করেন। মার্কিন প্রশাসন বিশ্বাস করে যে, কেবল শেখ মুজিবই বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে কমিউনিস্ট ও ভারতের কবল থেকে মুক্ত রাখতে পারবেন। নভেম্বর মাসে পাকিস্তান শেখ মুজিবের বিচার প্রক্রিয়া স্থগিত করে।
১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। ২০ ডিসেম্বর পাকিস্তানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়। জুলফিকার আলী ভুট্টো শেখ মুজিবকে বিনা শর্তে মুক্তি দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন, ভবিষ্যতে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকে নিয়ে কনফেডারেশন গঠনের প্রত্যাশায়।
১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি রাত ৩টায় পাকিস্তান এয়ারলাইন্সের বিমানে ইসলামাবাদ থেকে লন্ডনের পথে যাত্রা করেন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান। জুলফিকার আলী ভুট্টো বিমানবন্দরে উপস্থিত থেকে তাঁকে বিদায় জানান এবং ফোনে সংবাদটা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথকে জানিয়ে দেন। ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের অনুরোধে অসম্মত হয়ে, ভারতীয় বিমানের পরিবর্তে ব্রিটিশ রয়েল এয়ারফোর্সের প্লেনে বাংলাদেশের প্রাণপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা প্রত্যাবর্তন করেন নয়াদিল্লি হয়ে। তারিখটি ছিল সোমবার, ১০ জানুয়ারি ১৯৭২। ১২ জানুয়ারি শেখ মুজিব গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তাজউদ্দীন আহমদের পদাবনতি ঘটে। তিনি অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী হন। পাকিস্তানকে সহায়তা করার অপরাধে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক বরখাস্ত আইয়ুব খানের প্রিয়পাত্র এস.এম.এস. সফদর পিএসপি প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে তাঁর পূর্বপদে যোগ দেন একই দিনে, ১২ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে।