
গত ১ জুন সমকালে প্রকাশিত একটি সংবাদ নজর কেড়েছে। নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলায় আব্দুস সালাম চাকরি না পেয়ে তাঁর শিক্ষার সব সার্টিফিকেট বা সনদ পুড়িয়ে ফেলেছেন। পুড়িয়ে ফেলার ছবি তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দিয়েছেন। ৩৬ বছরের আব্দুস সালাম সরকারি চাকরির জন্য অনেক চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সফল হননি। বয়স চলে যাওয়ায় আর সেই সম্ভাবনাও নেই। সুতরাং যে সার্টিফিকেট কর্মসংস্থান দিতে পারেনি, সেই সার্টিফিকেট তিনি আর রাখতে চান না। এর আগে ইডেন কলেজের আরেক ছাত্রী মুক্তা সুলতানা ফেসবুক লাইভে এসে তাঁর সার্টিফিকেটও পুড়িয়ে ফেলেছেন। বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক তাঁর মন্ত্রণালয়ে সেই ছাত্রীর হাতে চাকরির নিয়োগপত্র তুলে দেন।
করোনা মহামারি বিশ্বের অর্থনীতিকে ঝাঁকুনি দিয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধও বিশ্ব অর্থনীতিকে করেছে বিপর্যস্ত। প্রযুক্তির পরিবর্তনে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে কেন্দ্র করে গবেষকরা বলছেন, জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আসবে। পরিবর্তন হবে অর্থনীতি। তাতে ১০০ কোটি মানুষের কাজের ধরন পাল্টে যাবে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৬০% এর বয়সসীমা ০-২৫ বছর। অথচ তারুণ্যে জ্বলে ওঠা বাংলাদেশে অবহেলা আর হতাশায় নিমজ্জিত তরুণ-তরুণী। তাদের মূল সমস্যা কর্মসংস্থান। শিক্ষিত তরুণ-তরুণীর স্বপ্ন থাকে তারা পড়াশোনা শেষ করে সরকারি চাকরিতে যোগ দেবে।
আশঙ্কাজনক এক তথ্য দিয়েছে আইএলও। সংস্থাটি বলছে, বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষিত তরুণ-তরুণীর ৪৭ শতাংশই বেকার জীবন কাটাচ্ছে। তারা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হতে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে বসে আছে। আরেকটি তথ্যে আইএলও বলছে, করোনাকালে ১৪ হতে ২৫ বছর বয়সী ২০ শতাংশ তরুণ কাজ হারিয়েছে। আইএলওর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের দেড় কোটি যুবক বেকার হয়ে বসে আছে। যুবসমাজের মধ্যে যে হতাশা সৃষ্টি হয়েছে তার আরও একাধিক কারণ রয়েছে। এর একটি বড় কারণ হচ্ছে, চাকরি পেতে ঘুষ দিতে হবে– এমন একটা ধারণা গ্রামে-গঞ্জে এমনভাবে বিস্তৃত হয়েছে, যা ভয়ংকর।
সরকারি চাকরিতে নিয়োগ পদ্ধতি নিয়েও যুবসমাজের মধ্যে ব্যাপক হতাশা বিরাজ করছে। তার আরও একটি কারণ হচ্ছে কোটা পদ্ধতি। অতীতে চাকরিতে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে জেলা কোটা পদ্ধতি চালু ছিল। এর একটা বড় কারণ শিক্ষা-দীক্ষায় অনগ্রসর কোনো অঞ্চল যেন পিছিয়ে না যায়। একপর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, নারী, জেলা, নৃজাতিগোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী কোটা যুক্ত হয়ে কোটা নির্ধারণ হয়ে যায় ৫৬ শতাংশে। সংগত কারণেই এ নিয়ে প্রতিবাদ শুরু হয়। সরকার কোটা পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনে। কিন্তু সরকারকে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে মেধাভিত্তিক নিয়োগকেই সবচেয়ে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সেটাই সঠিক পথ।
সরকারি চাকরির বয়সসীমা নিয়েও তরুণদের ভেতর তীব্র ক্ষোভ রয়েছে। যেখানে দেশের গড় আয়ু এখন ৭৩ বছর, সেখানে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ অবসরের বয়সসীমা নতুন করে ভাববার সময় এসেছে।
আব্দুস সালাম চাকরি না পেয়ে মোহনগঞ্জের স্টেশন রোডে একটি খাবারের রেস্টুরেন্ট দিয়েছেন। তাতেও তাঁর জীবনের কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসেনি। মাও সে তুং গণচীনের সারাদিনের সাফল্যের জন্য যুবসমাজের কর্মকেই চিহ্নিত করেছিলেন বলেই তারুণ্যকে সকালের সূর্যের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। চীন তারুণ্যকে উৎসাহিত করেছে, তারুণ্যকে সম্মান জানিয়েছে, তারুণ্যকে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়েছে বলেই আজ পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পেরেছে।
মুক্তা সুলতানা ফেসবুক লাইভে সার্টিফিকেট পুড়িয়ে একটা চাকরি হয়তো পেয়ে গেছেন। আব্দুস সালাম পাবেন কিনা জানি না। অগণিত মুক্তা-সালাম বাংলাদেশের ঘরে ঘরে। সালাম সার্টিফিকেট পুড়িয়েছেন, অজস্র সালাম ঘরে বসে হাত-পা গুটিয়ে হতাশায় জীবন পোড়াচ্ছেন।
আমাদের দেশের কর্ণধারদের গুরুত্বের সঙ্গে যুবসমাজের কথা ভাবতে হবে। আশির দশকের মাঝামাঝি শিল্পী খালিদের একটি গান ঢাকাসহ সারাদেশের তরুণদের ভেতর জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল– ‘পড়ালেখা শেষ করে বেকারত্বে ধুঁকে মরা এ কেমন অভিশাপ বলো ...’। যুবসমাজকে এই অভিশপ্ত জীবন থেকে উদ্ধারের পথটি রাষ্ট্রকেই খুঁজে বের করতে হবে।
রুস্তম আলী খোকন : সাবেক ছাত্রনেতা
মন্তব্য করুন