আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা ও প্রবীণ এই আইনজীবী মানবাধিকার সংগঠক হিসেবেও জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তরের পর আইন নিয়ে পড়াশোনা করেন। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর চট্টগ্রামের অন্যতম ট্রাস্টি রানা দাশগুপ্তের জন্ম ১৯৪৯ সালে, চট্টগ্রামে।

সমকাল: ৯টি মানবাধিকার সংগঠনের রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি হাইকোর্ট রুল জারি করেছেন যে কেন উত্তরাধিকার, বিয়ে নিবন্ধন ও সন্তানের অভিভাবকত্ব বিষয়ে হিন্দু নারীর অধিকার নিশ্চিতে সরকারের ব্যর্থতাকে বেআইনি ঘোষণা করা হবে না। এ বিষয়ে আপনার অভিমত জানতে চাই।

রানা দাশগুপ্ত: বাংলাদেশের হিন্দু নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক–এ বিবেচনাবোধ থেকে রিট আবেদনটি দায়ের হয়েছে। হিন্দু নারীদের শিক্ষিত ও সচেতন অংশ গত বেশ কয়েক বছর ধরে দাবিটি করে আসছে। কিন্তু হিন্দু সমাজের পুরুষদের মধ্যে এ নিয়ে বিভক্তি আছে। একটা অংশ দাবিটির সমর্থনে বক্তব্য রাখছে, অপর অংশটি এর তীব্র বিরোধিতা করে আসছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ মনে করে এ রিটের ওপর কোনো চূড়ান্ত মন্তব্য করার সময় এখনও আসেনি। সংগঠন বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। তাই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমি এ রিটের পক্ষে বা বিপক্ষে কোনো মন্তব্য করতে চাই না।

সমকাল: ব্যক্তি হিসেবে আপনার একটা মত থাকতে পারে না?

রানা দাশগুপ্ত: দেখুন, ব্যক্তি হিসেবে তো আমার অবশ্যই একটা মত আছে। আমি মুক্তিযুদ্ধ করেছি, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র আমার মাথায় আছে। সেখানে নাগরিকদের সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। তার আলোকেই বর্তমানে আমরা ধর্মীয় বৈষম্যবিরোধী একটি মানবাধিকার আন্দোলনে ব্যাপৃত আছি। তবে সংগঠনে এ নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকা অবস্থায় আমি প্রকাশ্যে কোনো পক্ষ নিতে পারি না। অবশ্য এটুকু বলতে পারি, যে রিট হয়েছে তা যদি শেষ পর্যন্ত গড়ায় তাহলে আদালতে এবং আদালতের বাইরে এ নিয়ে যে তর্ক-বিতর্ক হবে তাতে এ দ্বন্দ্ব নিরসনে একটি ইতিবাচক ফল বেরিয়ে আসতে পারে।

সমকাল: একজন প্রবীণ আইনজীবী হিসেবে বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেও কিছু বলতে পারেন।

রানা দাশগুপ্ত: হ্যাঁ, বিয়ের নিবন্ধন না থাকলে, ডিভোর্সের অধিকার না থাকায় এবং সম্পত্তিতে বিশেষত বিধবা নারীদের অধিকার না থাকায় কী দুর্ভোগ পোহাতে হয় তা আমি জানি। বর্তমানে বিয়ের নিবন্ধনসংবলিত বৈধ কাগজপত্র ছাড়া দেশের বাইরেও স্বামী-স্ত্রীর যাওয়া হয় না। জেন্ডার ইকুইটির বিষয়ে আন্তর্জাতিক চাপও আছে। সম্পত্তিতে মালিকানা না থাকলে বিধবা নারীদের অনেককে ফেউ ফেউ করে ঘুরতে হয়। একাধিক সন্তান থাকলে প্রশ্ন উঠে মা তুমি কার? ডিভোর্সের কথা বলতে গেলে, দরিদ্র অসচ্ছল অশিক্ষিত হিন্দু নারীর জন্য তা কোনো সমস্যা নয়, কারণ তার কাছে স্বামী হলো দেবতা। কিন্তু শিক্ষিত হিন্দু নারীদের মধ্যে এখন স্বাধীনচেতা ভাব প্রবল। একটি শিক্ষিত হিন্দু দম্পতি যখন অনুভব করে তাদের মধ্যে বিরোধের মাত্রা এত বেশি যে একসঙ্গে থাকা সম্ভব নয়, এমনকি জীবননাশের আশঙ্কা রয়েছে, তখন তারা কোনো আইনের আশ্রয় পায় না।

সমকাল: এই ধরনের পরিস্থিতিতে আপনারা কী করেন?

রানা দাশগুপ্ত: আমরা তখন দু’জনের সম্মতির ভিত্তিতে একটি আপসরফা তৈরি করি, যার কোনো আইনি ভিত্তি থাকে না। আমার পেশাগত জীবনে আমি দেখেছি, হিন্দু নারীর গর্ভে সন্তান আসার পর যার কারণে সে গর্ভবতী হয়েছেন ওই ব্যক্তি তাঁকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণে অস্বীকার করছেন এবং এ কারণে আদালতে মামলা দায়ের হয়েছে। ওই নারীর চরিত্র নিয়েও তখন প্রশ্ন তোলা হয়।

সমকাল: তাহলে তো এসব বিষয়ে আইন জরুরি বলে মনে হচ্ছে।

রানা দাশগুপ্ত: হিন্দু সমাজের দ্বিধাবিভক্তির মাঝে আইন তৈরির আগে এ বিষয়ে দ্বন্দ্বের অবসান হওয়া আবশ্যক। ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর আমরা প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের নেতৃত্বে হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন বাধ্যতামূলক রেখে একটি আইনের খসড়া তৈরি করি। তখন আমাদেরই একদল বন্ধু এর বিরোধিতা করে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে যান। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বললেন, হিন্দু সমাজের মধ্যে ঐক্য না থাকলে কোনো আইন করা উচিত নয়। শেষে একটি আপসরফা হিসেবে নিবন্ধনকে ঐচ্ছিক রেখে ২০১২ সালে ওই আইনটি পাস হয়।

সমকাল: বিরোধিতার কারণ কী বলে আপনি মনে করেন?

রানা দাশগুপ্ত: একটি তো হলো সমাজের রক্ষণশীলতা, যা আমরা ব্রিটিশ আমলে সতীদাহ প্রথা নিরোধ এবং বিধবা বিবাহ আইন প্রণয়নের সময়ও দেখেছি। কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো, খোদ রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিয়েই হিন্দু সমাজের মধ্যে ব্যাপক হতাশা বিরাজ করছে। অর্থনৈতিকভাবে দেশ যতই এগিয়ে যাক, রাষ্ট্র ও সমাজ অনেক পিছিয়ে গেছে। মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িকতা জোরদার হয়েছে। এর সবচেয়ে বড় শিকার হলো হিন্দুরা। ১৯৪৭-এ যেখানে এ দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু ছিল ২৯ শতাংশের বেশি, ১৯৭০-এ তা ১৯ থেকে ২০ শতাংশে নেমে আসে; সর্বশেষ জনশুমারি অনুসারে তা ৯.১ শতাংশ। তার মানে, সংখ্যালঘুরা অব্যাহতভাবে দেশত্যাগে বাধ্য হচ্ছে।

সমকাল: এভাবে দেশত্যাগে বাধ্য হওয়ার কারণ কী?

রানা দাশগুপ্ত: হিন্দুরা তাদের জন্মভূমিকে নিপীড়িত-নির্যাতিত হয়ে বসবাসের অযোগ্য বলে মনে করছে। তারা ভূমিদখলের শিকার, ধর্মান্তরকরণের শিকার। তাদের নারীদের ধর্ষণ করা হচ্ছে; অথচ এ সবের কোনো বিচার হয় না। দায়মুক্তির এ সংস্কৃতির মধ্যেই যখন হিন্দু নারীদের অধিকার-সংক্রান্ত আইন প্রণয়নের কথা বলা হয় তখন হিন্দু সমাজের ব্যাপক অংশ এর বিরোধিতা করে। যাঁরা বিরোধিতা করছেন তাঁরা একটি আতঙ্ক থেকে তা করছেন। তাঁরা বলছেন, এর ফলে হিন্দু নারীর পাশাপাশি তার নামের সম্পত্তিটুকুও যা রয়েছে তা দখল হয়ে যেতে পারে। এমনিতেই ১৯৬৫ সাল থেকে ভেস্টেড (এনিমি) প্রপার্টি অ্যাক্ট বা শত্রু সম্পত্তি আইন ছিল। এটা পরিবর্তিত হয়ে ২০০১ সালে অর্পিত প্রত্যর্পণ আইন হলেও এখনও একটি দুষ্টচক্রের দাপট থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারিনি। আমরা জ্বলছি, তার ওপর ওই আইন হলে নতুন আপদ তৈরি হতে পারে বলে শঙ্কা রয়েছে।

সমকাল: ভারত ও নেপালে তো পৈতৃক সম্পত্তিতে হিন্দু নারীর অধিকারের স্বীকৃতি দিয়ে আইন আছে।

রানা দাশগুপ্ত: হ্যাঁ, সেখানে তা আছে। কিন্তু ওই দুই দেশে হিন্দুরা যে পরিস্থিতিতে আছে এখানকার হিন্দুরা তার ঠিক উল্টো পরিস্থিতিতে বসবাস করছে। শুধু আইনের ক্ষেত্র ভারত ও নেপালকে অনুসরণ করার মানে নেই। এতে এখানকার হিন্দুদের শান্তি ও স্বস্তি আসবে না। তার মানে হিন্দু নারীর অধিকার নিয়ে আইনের বিরোধিতা এখানে যতটা রক্ষণশীল মানসিকতার কারণে হচ্ছে তার চেয়ে বেশি এক্ষেত্রে হিন্দুদের রাষ্ট্র ও বৃহত্তর সমাজের একাংশের কাছ থেকে প্রাপ্ত কষ্ট-যন্ত্রণা কাজ করছে।
সমকাল: আপনাদের তো বর্তমান সরকারের শীর্ষমহলে যোগাযোগ আছে। সংখ্যালঘুদের যন্ত্রণা-ক্ষোভের কথা কি সেখানে পৌঁছায় না?

রানা দাশগুপ্ত: তারা জানেন সবই; সমাধানের প্রতিশ্রুতিও দেন, কিন্তু বাস্তবে কিছুই হয় না। ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার অর্পিত (শত্রু) সম্পত্তি আইন বাতিল করে প্রত্যর্পণ আইন প্রণয়ন করে। এরপর ২০১১ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত আইনটির ছয়টি সংশোধনী হয়। কিন্তু বাস্তবে আইনের যথাযথ কোনো প্রয়োগ নেই। এখানে প্রচলিত দণ্ডবিধি বা অন্যান্য আইন চারিত্রিক দিক থেকে সেক্যুলার তবে এ সবের প্রয়োগকারী বেশিরভাগ মানসিকভাবে সাম্প্রদায়িকতা দোষে দুষ্ট। আজ পর্যন্ত অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনটির ‘ক’ শিডিউলে সম্পত্তি ফিরে পেতে যত আবেদন জমা পড়েছে তার অর্ধেকও নিষ্পত্তি হয়নি। আবেদনের ওপর শুনানির পর আবেদনকারীর পক্ষে রায় হওয়া সত্ত্বেও সম্পত্তি জেলা প্রশাসকরা আইন অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে ফিরিয়ে দিচ্ছেন না। সরকারি কর্মকর্তারা নতুনভাবে এদের হয়রানি ও আর্থিকভাবে সর্বস্বান্ত করে চলেছেন।

সমকাল: এগুলো কি নির্বাচনী ইস্যু হতে পারে না?

রানা দাশগুপ্ত: ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে ঢাকায় মহাসমাবেশ করে আমরা কিছু দাবি পেশ করে বলি, যে দল এগুলো মেনে নিয়ে পূরণ করার প্রতিশ্রুতি দেবে তাকে আমরা ভোট দেব। আওয়ামী লীগ সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় ছাড়া আর সব দাবি তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত করে। কিন্তু কোনোটাই আজ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন, সংখ্যালঘু কমিশন গঠন, বৈষম্য বিলোপ আইন, দেবোত্তর সম্পত্তি আইন করতে হবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনোটাই হয়নি। ফলে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক হতাশা বিরাজ করছে।

সমকাল: সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত যেসব সাংসদ আছেন তারা কী করছেন?

রানা দাশগুপ্ত: সংসদের এমপিদের মধ্যে সংখ্যালঘু ইস্যুতে সুবর্ণা মুস্তাফা আর সম্প্রতি পদত্যাগকারী ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানার কণ্ঠ শুনেছি। সংখ্যালঘু এমপিদের মধ্যে গ্লোরিয়া ঝর্ণা ও বাসন্তী চাকমা ধারাবাহিকভাবে কথা বলেছেন। আর খানিকটা বলেছেন মনোরঞ্জন শীল গোপাল। অন্য কেউ কথা বলেননি। তাঁরা সংসদে প্রকৃত অর্থে কি ভূমিকা পালন করছেন তা দেশবাসীর অজানা।

সমকাল: কারণ কী?

রানা দাশগুপ্ত: ব্যক্তিস্বার্থ। দুঃখজনক হলো, আমরা এক সময় সরকারের কাছে জাতীয় সংসদে সংখ্যালঘুদের সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব দাবি করে বলেছিলাম অন্তত ৬০টি আসন চাই। তখন সংসদে মাত্র ২/৩ জন এমপি ছিলেন, যাঁরা ধর্মীয় পরিচয়ে সংখ্যালঘু ছিলেন। আজ সংসদে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ২২ জন এমপি আছেন, অথচ সংখ্যালঘুর কষ্ট-যন্ত্রণা তুলে ধরার এমপি নাই বললে চলে।

সমকাল: আপনাকে ধন্যবাদ।

রানা দাশগুপ্ত: সমকালকেও ধন্যবাদ।