- মতামত
- পররাষ্ট্রনীতি এখন একটু বেশি চাপের মধ্যে
সাক্ষাৎকার: ড. এ কে আব্দুল মোমেন
পররাষ্ট্রনীতি এখন একটু বেশি চাপের মধ্যে

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন এমপি আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়ার আগে ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ফ্রেমিংহ্যাম স্টেট ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতি ও ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের চেয়ারম্যান ছিলেন। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। ড. মোমেন বোস্টনের নর্থইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি থেকে ১৯৮৮ সালে অর্থনীতিতে পিএইচডি করেন। ১৯৭৩ সালে তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনে যোগ দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ও উন্নয়ন অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর এই অর্থনীতিবিদের জন্ম ১৯৪৭ সালে, সিলেটে।
সমকাল: বাংলাদেশের জন্য ঘোষিত নতুন মার্কিন ভিসা নীতিকে কীভাবে দেখছেন?
এ কে আব্দুল মোমেন: আমাদের এ নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ নেই। মার্কিন সরকার তার ভিসা নীতি পরিবর্তন করতে পারে। যারা নির্বাচনকে বানচাল করতে চাইবে, অথবা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন না করতে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নেবে, সহিংসতা চালাবে, ভোটকেন্দ্র দখল করবে অথবা উস্কানিমূলক বক্তব্য দেবে, তাদের প্রতি নতুন এ নীতি বর্তাবে। মার্কিন প্রশাসন এমনিতেও সবাইকে ভিসা দেয় না। তারা কাদের ভিসা দেবে, কাদের দেবে না– এ নিয়ে মার্কিন কর্তৃপক্ষের নীতিগত অবস্থান রয়েছে। আমরা এ নিয়ে চিন্তিত নই।
সমকাল: বিরোধী দলের দাবি– বিগত দুই নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকেই এই পদক্ষেপ।
এ কে আব্দুল মোমেন: বাংলাদেশে গত সাড়ে ১৪ বছরে কয়েক হাজার নির্বাচন হয়েছে। এর মধ্যে গুটিকয়েক নির্বাচন ছাড়া সবই সুষ্ঠু হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বা অন্যান্য দেশেও তা-ই হয়। আমাদের দেশের ক্ষেত্রে এসব ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বলা হয়ে থাকে।
সমকাল: ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নিজেদের ও মিত্রদের মধ্যে নির্বাচন করে প্রধান বিরোধী দলগুলোকে বাইরে রাখার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এ কে আব্দুল মোমেন: আমরা কখনোই এটি চাই না। আমরা চাই স্বচ্ছ নির্বাচন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন– ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার নির্বাচন করতে হবে। যাঁরাই নির্বাচনে আসতে চান, তাঁদের আমরা আমন্ত্রণ জানাই। আমাদের কোনো আপত্তি নেই। বরং তারাই নির্বাচন বয়কট করেছে। নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনের সময় তাদের পূর্ণ ক্ষমতা রয়েছে। আওয়ামী লীগ নির্বাচন চায়। নির্বাচন যেন না হয়, বিরোধী দল সেই পাঁয়তারা করছে।
সমকাল: বিরোধী দল তাহলে কী চায়?
এ কে আব্দুল মোমেন: তারা চায় একটা সামরিক সরকার আসুক। তারা মুখে বলে নির্বাচনের কথা। আসলে নির্বাচন চায় না।
সমকাল: সামরিক সরকার এলে বিরোধী দলের লাভ কী?
এ কে আব্দুল মোমেন: তাহলে আওয়ামী লীগকে দাবানো যাবে। ২০০৬ সালে এলো সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। আওয়ামী লীগ সরকারে ছিল না; কিন্তু আওয়ামী লীগকেই আঘাত করা হলো বেশি। তারা মনে করে, যদি এমন কোনো অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসে, তাহলে আওয়ামী লীগকে শায়েস্তা করতে পারবে। আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা ধ্বংস করতে পারবে।
সমকাল: যুক্তরাষ্ট্র তো সুষ্ঠু, অবাধ ও নিয়মিত ভোটের কথা বলছে মাত্র!
এ কে আব্দুল মোমেন: আমেরিকার বড় বন্ধু সৌদি আরব, মিসর। মিসরে নির্বাচন কেমন হয়েছে, তা নিশ্চয়ই জানেন। অং সান সু চি যখন নির্বাচন করলেন, রোহিঙ্গারা ভোট দিতে পারেনি। এটি একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন! পাকিস্তানে কী হচ্ছে, তার কোনো খবরই নেই। আমেরিকার স্ট্যান্ডার্ড দেশভেদে ভিন্ন। আমেরিকার গত নির্বাচনকেই সে দেশের মানুষ ফেয়ার মনে করছে না। আওয়ামী লীগ জনগণের ম্যান্ডেটে বিশ্বাস করে।
সমকাল: আমেরিকার অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি কি চাপের মধ্যে পড়ে গেল?
এ কে আব্দুল মোমেন: বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি সব সময় চাপের মধ্যে থাকে। এখন একটু বেশি চাপের মধ্যে আছি। একটি কারণ হলো– আমাদের গুরুত্ব বাড়ছে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি দেশ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি করে ফেলছে; দুর্যোগপীড়িত একটি দেশ নিজের পায়ে দাঁড়াচ্ছে– এটি অনেকের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছে। তারা চায় বাংলাদেশের সরকার সব সময় হাত পেতে থাকবে। আরেকটা কারণ হলো আমাদের ভৌগোলিক অবস্থান। এটি ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেকেই এখন ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। এর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুটি ব্লক তৈরি হয়েছে। আমরা এখনও কোনো ব্লকে যোগ দিইনি। যে কারণে অনেকের নজর আমাদের দিকে।
সমকাল: অভিযোগ রয়েছে, আমরা চীন-ভারতের বলয়ে বেশি ঝুঁকে পড়ছি।
এ কে আব্দুল মোমেন: আমরা এখনও একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি বজায় রেখেছি। আমরা বলি– সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়। আমরা চীনের ব্লকে যাইনি, আমেরিকার ব্লকে যাইনি; কোনো ব্লকেই যাইনি। আমাদের প্রতিবেশী ভারত; আমাদের বন্ধু দেশ। চীন আমাদের উন্নয়নে সহায়তা করে, জাপানও করে। আমরা সবাইকে নিয়েই আছি। আমেরিকা আমাদের এখন আর সেভাবে সাহায্য করে না। সাহায্যের পরিমাণ অনেক কমে গেছে। তবে আমাদের পণ্য তারা কেনে।
সমকাল: ভারতকে ট্রানজিট দিয়ে আমরা কী পেলাম?
এ কে আব্দুল মোমেন: আমরা চুক্তি করেছি। আমাদের পণ্যও ভারতের ভেতর দিয়ে নেপালে যাবে। আমরা একটি ভিসামুক্ত অঞ্চল করতে চাই।
সমকাল: রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বাংলাদেশ যে অবস্থান নিয়েছে, তা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে সমালোচনা আছে। সংবিধানে আছে– বাংলাদেশ সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতা, জাতিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত সব নির্যাতিত মানুষের পাশে থাকবে।
এ কে আব্দুল মোমেন: এটি সঠিক নয়। জাতিসংঘে অনুষ্ঠিত ভোটে দেখা যাবে, আঞ্চলিক অখণ্ডতা আমরা চাই, সে জন্য এ ক্ষেত্রে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছি। যখন মানবিক সাহায্যের কথা এসেছে, আমরা তার পক্ষে ভোট দিয়েছি। আমরা নিজেদের মূলনীতির ভিত্তিতে অবস্থান নিয়েছি।
সমকাল: রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি। এটি কি কূটনৈতিক ব্যর্থতা?
এ কে আব্দুল মোমেন: রোহিঙ্গাদের যখন মিয়ানমার বের করে দেয়, তখন কি তারা ঠিক করেছিল– আবার তাদের ফেরত নিয়ে যাবে? নিশ্চয়ই না। তারা রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে গণ্য করেনি। তারা সত্তর, আশি, নব্বইয়ের দশকেও রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করেছে। যে ধনী দেশগুলো মানবাধিকারের কথা বলে, তখন তারা কোথায় ছিল? আমরাই তাদের আশ্রয় দিয়েছি। ধনী দেশগুলোর উচিত ছিল রোহিঙ্গাদের নিয়ে যাওয়া। তারা বলেছে– আমরা নিয়ে যাব। যুক্তরাষ্ট্র ৬ বছরে ৬২ জনকে নিয়েছে। এ সময়ে কানাডা নিয়েছে ৯ জন। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, রোহিঙ্গাদের অবস্থা ভালো না।
সমকাল: রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য প্রভাবশালী দেশগুলো কী করছে?
এ কে আব্দুল মোমেন: বিশ্বের মোড়লরা যদি মনে করে, এই সমস্যা দূর করার জন্য মিয়ানমারকে চাপ দেওয়া উচিত, তাহলে তারা সেখানে ব্যবসা করবে না, বিনিয়োগ করবে না। জার্মানি জানিয়েছে, তারা নতুন করে বিনিয়োগ বন্ধ করে দিয়েছে। হাঙ্গেরিও একই কথা জানিয়েছে। কিন্তু মার্কিন কোম্পানি এখনও সেখানে ব্যবসা করছে। যুক্তরাজ্য, জাপান, সিঙ্গাপুরও করছে। সুতরাং মিয়ানমার কোনো চাপ অনুভব করছে না।
সমকাল: এই অঞ্চলের ভূ-রাজনীতিতে চীনের প্রভাব কি বৃদ্ধি পাচ্ছে?
এ কে আব্দুল মোমেন: উন্নত দেশগুলোর মধ্যে এ নিয়ে দ্বন্দ্ব আছে। তারা চীনকে দূরে সরিয়ে রাখতে চায়। আমাদের এ নিয়ে মাথাব্যথা নেই। আমরা দেশের মানুষের মঙ্গলের জন্য যা দরকার, তা-ই করব।
সমকাল: আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দৃঢ় অবস্থানের জন্য তো দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন জরুরি।
এ কে আব্দুল মোমেন: অবশ্যই জরুরি। কিন্তু এটা শুধু সরকার বা নির্বাচন কমিশন চাইলেই হবে না। সব দল- মতের লোকের ঐকান্তিকতা থাকতে হবে। সরকার সুষ্ঠু নির্বাচন করতে বদ্ধপরিকর। আমরা চাই বন্ধু দেশগুলো আমাদের সাহায্য করবে।
সমকাল: কিন্তু রাষ্ট্রদূতদের প্রটোকল বাতিল করে কি বন্ধু দেশগুলোকে অসন্তুষ্ট করা হয়নি?
এ কে আব্দুল মোমেন: আমরা কনভেনশনে যত ধরনের সিকিউরিটি রুলস আছে, সব দিয়ে যাচ্ছি। কিছু বাড়তি দিয়েছি। আমেরিকার মিশনগুলোর নিরাপত্তায় আমরা ১৫৮ জন জনবল নিযুক্ত করেছি। কিন্তু আমাদের এখন ব্যয় সংকোচন করা দরকার।
সমকাল: ইকোনমিক ডিপ্লোম্যাসি কতটা এগোলো?
এ কে আব্দুল মোমেন: ইকোনমিক ডিপ্লোম্যাসির জন্য আমাদের প্রধানমন্ত্রী রোডম্যাপ ঠিক করে দিয়েছেন– ভিশন ২০২১, ২০৩০ ও ২০৪১। আমাদের মানবসম্পদ রয়েছে। আমরা যদি মানবসম্পদ যথাযথ কাজে লাগাতে চাই, তবে যথেষ্ট বিনিয়োগ প্রয়োজন। আমরা এ জন্যই দেশে ম্যানুফ্যাকচারিং হাব তৈরি করেছি। এতে কর্মসংস্থান হচ্ছে। এখন প্রয়োজন প্রযুক্তি ও জ্ঞানভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থা।
সমকাল: আমরা কি ব্রিকসে যুক্ত হচ্ছি?
এ কে আব্দুল মোমেন: আমাদের দেশের মানুষের মঙ্গলের জন্য যা কিছু দরকার, আমরা সেটা করছি। ব্রিকসে এখনও আমরা জয়েন করিনি। তবে আমরা সেখানে যুক্ত হতে চাই। ধনী দেশগুলো আমাদের সেভাবে কোনো আর্থিক সহযোগিতা করে না। তাদের আর্থিক ক্ষমতাও কমে যাচ্ছে। আমাদের দেশ উন্নয়ন করতে চায়।
সমকাল: দীর্ঘ সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
এ কে আব্দুল মোমেন: সমকালকেও ধন্যবাদ।
মন্তব্য করুন