মহান আল্লাহর অপার দান প্রকৃতি। প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার জন্য রোদ-বৃষ্টির প্রয়োজন অনস্বীকার্য। কিন্তু অনেক দিন ধরে বৃষ্টির দেখা নেই। গরমে হাঁসফাঁস করছে প্রকৃতি। তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রিও ছাড়িয়ে যাচ্ছে কোথাও কোথাও।
আকাশে মেঘ নেই; পাশাপাশি বাতাসে আর্দ্রতা কমে গেছে। এতে আরও বাড়ছে গরমের তীব্রতা। জরুরি প্রয়োজনে যাঁরা বাইরে বের হচ্ছেন, তাঁরা পড়ছেন বেশ অস্বস্তিতে। রোদ ও গরমের তীব্রতার সঙ্গে বাড়ছে মানুষের বিভিন্ন রোগ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি। ব্যাহত হচ্ছে মানুষের স্বাভাবিক কর্মচঞ্চলতা। এক পশলা বৃষ্টির জন্য হাহাকার করছে দেশের মানুষ।

এমন সংকটময় মুহূর্তে বৃষ্টির জন্য ইস্তিসকার নামাজ আদায়ের নির্দেশ দেয় ইসলাম। নিজেদের গুনাহের জন্য ক্ষমা চেয়ে মহান আল্লাহর দরবারে কায়মনোবাক্যে দোয়া করার বিধান হাদিসে বর্ণিত রয়েছে। ইসলামের পরিভাষায় বৃষ্টির জন্য বিশেষ নামাজকে সালাতুল ইস্তিসকা বলা হয়।

মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনের সুরা নুহ-এর ১০-১১ আয়াতে এরশাদ করেন: তোমরা তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমা করবেন। তোমাদের জন্য মুষলধারে বৃষ্টি বর্ষণ করবেন।

মহান আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে কোনো কিছুই হয় না। রোদ-বৃষ্টিও তাঁর রহমত ও মহান কুদরতের প্রকাশ। আল্লাহ তায়ালা সুরা আর-রুম এর ৩৮ আয়াতে এরশাদ করেন: ‘তিনিই আল্লাহ, যিনি বাতাস পাঠান, এর পর তা মেঘমালাকে সঞ্চালিত করে। এর পর তিনি মেঘমালাকে যেভাবে ইচ্ছা আকাশে ছড়িয়ে দেন এবং স্তরে স্তরে রাখেন। এর পর তুমি দেখতে পাও যে, তা থেকে বৃষ্টি নেমে আসে। তিনি তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাদের ইচ্ছা তাদের কাছে বৃষ্টি পৌঁছান; তখন তারা আনন্দিত হয়।’

মিশকাত শরিফের হাদিসে বর্ণিত, রাসুলে পাক (সা.) বৃষ্টির জন্য দোয়া করার সময় বলতেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি তোমার বান্দাকে এবং তোমার পশুদের পানি দান করো আর তাদের প্রতি তোমার রহমত বর্ষণ করো এবং তোমার মৃত জমিনকে জীবিত করো।’

বৃষ্টির জন্য দোয়া ও বিশেষ নামাজ আদায় করা রাসুলে পাক (সা.)-এর আমল ও সুন্নাত। এ সুন্নাত অনুসরণে প্রতি বছরই একাধিকবার পবিত্র কাবা ও মদিনার মসজিদে নববিসহ অন্যান্য মসজিদে বৃষ্টির জন্য সালাতুল ইস্তিসকা আদায় করা হয়। অনাবৃষ্টি কিংবা খরা দেখা দিলেই রাসুলে পাক (সা.) রহমতের বৃষ্টির জন্য নামাজ ও দোয়া করতেন।

ইস্তিসকার নামাজের জন্য একটি নির্দিষ্ট দিন ঠিক করা, যাতে সবাই ওই দিনের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে নামাজে অংশ নিতে পারেন। ইস্তিসকার নামাজে বিনয় ও নম্রতার সঙ্গে গমন করা সুন্নত। একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই যে মানুষের সব প্রয়োজন পূরণ করেন– এ মনোভাব অন্তরে জাগ্রত রাখা। নামাজের দিন নামাজ আদায়ের আগ পর্যন্ত খাবার গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকার ব্যাপারে কোনো কোনো আলেমের মত পাওয়া যায়।

সূর্যোদয়ের পর ২০ মিনিটের মতো সময় অতিবাহিত হলে ইস্তিসকার নামাজ পড়তে হয়। এ নামাজ মসজিদে নয় বরং খোলা মাঠে, ঈদগাহে আদায় করা সুন্নাত। কেননা, রাসুলে পাক (সা.) এমন আমল করেছেন। তবে প্রয়োজনের তাগিদে মসজিদেও আদায় করা যাবে। আজান ও ইকামাত ছাড়া ইমাম সাহেব দুই রাকাত নামাজ পড়াবেন। নামাজে উচ্চস্বরে কিরাত পাঠ করবেন। নামাজের পরে খুতবা দেবেন এবং খুতবার শুরুতে চাদর ঘুরিয়ে দেবেন, তার পর কিবলার দিকে দাঁড়িয়ে দু’হাত তুলে দোয়া করবেন; সবাই বসে বসে আমিন বলবেন। টানা তিন দিন ইস্তিসকার নামাজ আদায় করা মুস্তাহাব।

ইস্তিসকার নামাজের আগে সমবেত মুসল্লিদের ওয়াজ-নসিহত করা বিশেষ করে মানুষের হৃদয় বিগলিত হয় এমন কথাবার্তা বলা। যেমন– গোনাহ থেকে তওবার গুরুত্ব তুলে ধরা। অন্যায়ভাবে হাতিয়ে নেওয়া সম্পদ তার হকদারের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করা। কেননা, মানুষের পাপ-পংকিলতার কারণেই বৃষ্টিপাত বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর তওবা-ইস্তেগফার ও তাকওয়া অর্জনের মাধ্যমে দোয়া কবুল হয়। এ নামাজ উপলক্ষে দান-খয়রাতের ব্যাপারেও উৎসাহ দেওয়া। কেননা, দান-খয়রাত আল্লাহর রহমত প্রাপ্তির অন্যতম কারণ।

আবু দাউদ শরিফে বর্ণিত, হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘লোকজন রাসুলে পাক (সা.)-এর কাছে অনাবৃষ্টির কষ্টের কথা নিবেদন করলে রাসুলে পাক (সা.) ঈদগাহে সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে বিশেষ দোয়া করেন। যার অর্থ: ‘সব প্রশংসা পৃথিবীর প্রতিপালক মহান আল্লাহর জন্য। তিনি পরম করুণাময় এবং দয়ালু ও শেষ বিচারের মালিক। মহান আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো মাবুদ নেই। তিনি যা ইচ্ছা করেন, তা-ই করেন। হে আল্লাহ! তুমিই একমাত্র মাবুদ, তুমি ছাড়া আর কোনো মাবুদ নেই। তুমি ধনী, আমরা গরিব। আমাদের ওপর বৃষ্টি বর্ষণ করো এবং আমাদের জন্য যা অবতীর্ণ করো, তা আমাদের জন্য শক্তিময় ও কল্যাণ দান করো।’

তীব্র তাপদাহের এ সময়ে বৃষ্টির জন্য সমগ্র দেশের মানুষ নিজ নিজ এলাকায় একত্র হয়ে ইস্তিসকার নামাজে মহান আল্লাহর দরবারে অশ্রুসিক্ত নয়নে প্রার্থনা করুন এবং নিজেদের ভুল-ত্রুটি ও পাপমুক্তির জন্য কায়মনোবাক্যে দোয়া করুন। মহান আল্লাহ আমাদের ওপর রহমতের বৃষ্টি বর্ষণ করুন।

ড. মো. শাহজাহান কবীর: চেয়ারম্যান, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি