
পরপর কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর আত্মহননের মধ্যেই এমন এক শিক্ষার্থীর শেষ চিঠি বা সুইসাইড নোট সামাজিকমাধ্যমে ভাসছিল, যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাননি। মেয়েটি তাঁর মা-বাবাকে লিখেছেন, ‘আমি চান্স না পাওয়ায় তোমরা সমাজে মুখ দেখাতে পারছ না’। মেয়েটি আরও লিখেছেন, তিনি তাঁর সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। ‘এত সমালোচনা, অপমান, টেনশন’ সহ্য করতে না পেরে তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। মেয়েটির চিঠিতেই সব পরিষ্কার। আমাদের ফুলগুলো ঝরে যাওয়ার কারণগুলোর মধ্যে সামাজিক প্রভাবই যে প্রধান মেয়েটির চিঠিই তার প্রমাণ।
সন্তানকে মা-বাবার চেয়ে বেশি আর কে ভালোবাসেন? প্রত্যেক সন্তানকে নিয়েই মা-বাবার স্বপ্ন থাকে, পরিকল্পনা থাকে। কিন্তু অতিরিক্ত প্রত্যাশা যে কেবল সন্তানের জন্য নয় নিজেদেরও বেদনার কারণ হতে পারে, সেই প্রমাণও মেয়েটির চিঠি। তবে মা-বাবার প্রত্যাশাও এ সমাজই তৈরি করে দিচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লে ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে– তা হয়তো অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু যাঁরা এমনকি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়ার সুযোগ পাননি তাদের মধ্যে ক্যারিয়ারে সফল হওয়ার উদাহরণ তো কম নেই।
আত্মহত্যা নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা জানেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যেই আত্মহননের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। গত তিন বছরের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতি বছরই আগের বছরের তুলনায় আত্মহত্যা বেড়েছে। আরও দুর্ভাগ্যের বিষয়, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যেই এ প্রবণতা বেশি। যাঁরা ভর্তি পরীক্ষার মতো যুদ্ধে উত্তীর্ণ হয়ে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন, তাঁরা নিঃসন্দেহে মেধাবী। তাঁরা চাইলে কী না করতে পারেন। তাদের জন্য ক্যারিয়ারের সুযোগও অবারিত। বিসিএস কিংবা সরকারি চাকরি না হলেও, বেসরকারি চাকরি এমনকি উদ্যোক্তার জীবন বেছে নিয়ে অনেকেই সফল হয়েছেন। নিজের ব্যবস্থার পাশাপাশি অন্যের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করছেন। ইন্টারনেটের এই যুগে অনেকে স্বাধীনভাবে ফ্রিল্যান্সিং করছেন। তাঁরা কেউই খারাপ নেই। তারপরও কেন আত্মহননের পথ বেছে নেওয়া?
পাছে লোকে অনেক কিছুই বলে, সেগুলো ধরে আপনি কেন থামবেন? আপনার একটা দুয়ার বন্ধ, হাজারটা দরজা যে আপনার জন্য উন্মুক্ত তা হয়তো আপনি জানেন না। থেমে না গিয়ে আপনাকে সেই দ্বারে পৌঁছতে হবে। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই জীবন। জীবন বাঁচানোর জন্য মানুষের কত আকুতি, হাসপাতালে না গেলে তা বোঝা যাবে না। খারাপ অবস্থায় থেকেও মানুষের জীবন যাচ্ছে। জীবনের নিয়মেই মৃত্যু আসবে। কিন্তু নিজ থেকে মৃত্যুর কাছে সঁপে দেওয়া মানুষের কাজ নয়।
নিছক অর্থোপার্জনের দিক থেকে সমাজ যাকে কাঙ্ক্ষিত পেশা মনে করে সেটা বাস্তবে সুস্থ জীবনযাপনে সহায়ক নাও হতে পারে। পেশার ক্ষেত্রে সামাজিক ট্রেন্ড তাই শেষ কথা হতে পারে না। প্রত্যেকেই বিরাট সম্ভাবনা নিয়ে আসে, তার সম্ভাবনার বিকাশ তাকেই ঘটাতে দিন। সন্তান হিসেবে আপনি তাকে নির্দেশনা দিতে পারেন, প্রত্যাশার কথাও বলতে পারেন কিন্তু অত্যধিক চাপের মধ্যে রাখার ফল সব সময় ভালো হয় না।
মেয়েটার মতো শেষ চিঠি কোনো মা-বাবা নিশ্চয়ই দেখতে চান না।
মাহফুজুর রহমান মানিক: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, সমকাল
mahfuz.manik@gmail.com
মন্তব্য করুন