- মতামত
- পরমতসহিষ্ণুতার অভাব ও পরিবর্তনের অনিবার্যতা
রাষ্ট্রচিন্তা
পরমতসহিষ্ণুতার অভাব ও পরিবর্তনের অনিবার্যতা

এই রাষ্ট্রের যাঁরা শাসক হয়েছেন তাঁরা পরমতসহিষ্ণুতা দেখাননি। চিন্তার স্বাধীনতা দিতে চাননি। আনুগত্য দাবি করেছেন। সৃজনশীলতা পৃষ্ঠপোষকতা পায়নি। মুনাফালিপ্সা ও ভোগের স্পৃহা সবকিছুকে গ্রাস করে ফেলতে চেয়েছে। টেলিভিশন ও ইন্টারনেটের ব্যবহার সংস্কৃতির চর্চায় সামাজিকতার জায়গাতে ব্যক্তিগত উপভোগকে প্রধান করে তুলেছে। অর্থনৈতিক দুর্দশার কারণে মানুষের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে তিন ধারার বিস্তারও সমাজ ও সংস্কৃতি উভয়কেই অত্যন্ত ক্ষতিকররূপে বিভক্ত করেছে।
ওদিকে মধ্যপ্রাচ্য থেকে কেবল টাকাই আসেনি, মৌলবাদের চর্চায় উৎসাহও এসেছে। ধর্মনিরপেক্ষতার অঙ্গীকার বাস্তবায়িত হয়নি; তদ্বিপরীতে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে। গণতান্ত্রিক ও সামাজিক সংস্কৃতির চর্চা যাঁদের করার কথা, তাঁরা অনেকেই ঝুঁকে পড়েছেন প্রচার-প্রতিষ্ঠার অভিমুখে। কেউ কেউ আবার সেবকে পরিণত হয়েছেন ক্ষমতাসীন বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলের। পাড়ায়-মহল্লায় সংস্কৃতিচর্চার সুযোগ সংকুচিত হয়ে এসেছে। এমনকি খেলাধুলার জায়গাও প্রায় নেই। হাস্যকৌতুক বেশ দুর্লভ হয়ে পড়েছে।
আমরা আগে ভাবতাম যে আদি সংবিধানে যে চারটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতির উল্লেখ ছিল তাদের মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সংজ্ঞাটি রয়েছে। পরের অভিজ্ঞতা জানিয়ে দিয়েছে যে, সেখানেও অস্পষ্টতা ছিল। স্পষ্ট করে বলতে গেলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল একটি সামাজিক বিপ্লবের চেতনা, যে বিপ্লবের চূড়ান্ত লক্ষ্য হবে সম্পদের ব্যক্তিমালিকানার জায়গাতে সামাজিক মালিকানার প্রতিষ্ঠা। ওই চেতনা থেকে তো আমরা অবশ্যই সরে গেছি। এমনকি আদি রাষ্ট্রীয় মূলনীতিগুলোও এখন আর কার্যকর নয়। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে মানবিক করে তোলার জন্য তাই সামাজিক বিপ্লবের প্রয়োজন প্রধান হয়ে পড়েছে। রাজা প্রজার পুরাতন সম্পর্কের অবসান ঘটিয়ে প্রত্যেকের জন্য সমান অধিকার ও সুযোগের ব্যবস্থা করার স্বপ্ন ছিল মুক্তিযুদ্ধের চালিকাশক্তি। সামাজিক বিপ্লবের ওই লক্ষ্য থেকে আমরা ক্রমাগত সরে এসেছি।
আমাদের স্বাধীনতার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য দ্রুত এবং পুরোপুরি অর্জিত হবে এটা আমরা আশা করিনি; কিন্তু যা ঘটেছে তা মোটেই সন্তোষজনক নয়। উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য একটি বড় রাষ্ট্রকে ভেঙে ছোট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ছিল না, ছিল মুক্তির; অর্থাৎ এমন একটি রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ে তোলার, যেটি হবে গণতান্ত্রিক এবং সমাজতান্ত্রিকও। সেদিকে আমরা এগোতে পারিনি। উন্নয়ন যা ঘটেছে তা পুঁজিবাদী ধরনের। উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে তাই বৈষম্য ও বিচ্ছিন্নতা বেড়েছে; এবং বৃদ্ধি পেয়েছে শোষণ।
সম্পদ সৃষ্টি মেহনতি মানুষের শ্রমে। এবং সেই সম্পদের একাংশ পাচার হয়ে গেছে বিদেশে, অন্য একটা অংশ খরচ হয়েছে ধনিক শ্রেণির ভোগবিলাসে। ব্রিটিশ শাসন ছিল ঔপনিবেশিক; পাকিস্তানি শাসকেরাও বাংলাদেশকে একটি অভ্যন্তরীণ উপনিবেশে পরিণত করতে চেয়েছিল। স্বাধীন বাংলাদেশেও কিন্তু এক ধরনের ঔপনিবেশিকতাই আমরা দেখছি। সেটা দেশীয় বুর্জোয়াদের ঔপনিবেশিকতা। শোষণ এবং সম্পদ পাচার, দুটিই পুরোমাত্রায় চলছে। গণতান্ত্রিক আমল বলতে যা বোঝায় সত্যিকার অর্থে তো সেটা পাওয়াই যায়নি।
বাংলাদেশের অত্যন্ত অসহিষ্ণু শাসকরা লোভ দেখান এবং ভয় দেখান। বুদ্ধিজীবীরা কেউ পড়েন লোভে, অনেকেই থাকেন ভয়ে। বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে ভয়ের একটি সংস্কৃতিই বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে। আরেকটি বাস্তবতা হলো এই যে, বুদ্ধিজীবীরা সংগঠিত নন। তদুপরি তাঁরা আবার দলীয়ভাবে বিভক্ত। স্বাভাবিকভাবেই সরকারপন্থি হওয়ার দিকেই ঝোঁকটা থাকে অধিক। দেশে সরকারবিরোধী আন্দোলন দুর্বল; সে কারণেও সরকারের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের অবস্থানটা সবল হয় না। তদুপরি মিডিয়া বিরোধীপক্ষের সংবাদ প্রকাশে উৎসাহ প্রকাশ করে না; ফলে সরকারবিরোধী অবস্থান নিলেও সেটা তেমন প্রচার পায় না। রাজনীতিতে, সমাজজীবনে নিশ্চয় সুবিধাবাদ ছিল ও আছে, পাশাপাশি ভয়ও কাজ করছে।
আগামী নির্বাচনে শাসক শ্রেণির রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংঘর্ষ না ঘটলেও অরাজকতা তৈরি হতে পারে। অরাজকতাটা কেমন দাঁড়াবে এবং তার পরিণতি কী হবে সেটা নির্ভর করছে সংশ্লিষ্ট মহলগুলো কে কী রকম আচরণ করে তার ওপর।
আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দল দুটির মধ্যে ফারাক অবশ্যই আছে; কিন্তু সেটা মৌলিক নয়। তার কারণ যে প্রতিশ্রুতিই তাঁরা দিন না কেন ক্ষমতায় গেলে যে তার বাস্তবায়ন ঘটাবেন এটা আশা করা যায় না। প্রতিশ্রুতি ভুলে যাওয়াটাই তাঁদের স্বভাব। এটাও তো সত্য যে, বুর্জোয়ারাই রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকবেন; এবং তাঁদের স্বভাব ও অভ্যাসে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। তাঁরা গণতন্ত্রমনস্ক নন এবং তাঁদের দেশপ্রেমে বিস্তর ঘাটতি রয়েছে। এটা তো দৃশ্যমানই যে তাঁদের দলের অভ্যন্তরে পর্যন্ত গণতন্ত্রের চর্চা নেই।
আমাদের রাজনৈতিক সংকটে বিদেশিদের নির্লজ্জ হস্তক্ষেপ আমরা দেখে থাকি। বিষয়টি লজ্জাকর বটে। আমরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছি; রাষ্ট্রীয় সব সিদ্ধান্ত আমরা নিজেরাই নেব, এটাই প্রত্যাশিত। সেটা ঘটছে না। কারণ রাষ্ট্রের শাসক শ্রেণি দেশের মানুষের সমর্থনের ওপর ভরসা করে না, তারা বিদেশিদের সমর্থন চায়। শাসকরা পরস্পরের মিত্র নয়, কিন্তু আদর্শগতভাবে তাদের মধ্যে নিকটবর্তিতা রয়েছে। তারা সবাই পুঁজিবাদী এবং আমাদের দেশের পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটা বিশ্ব পুঁজিবাদী বন্দোবস্তেরই অংশ। অন্যদিকে পুঁজিবাদীরা সাম্রাজ্যবাদীও, তারা চায় নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে। নির্বাচন এলে সরকার পরিবর্তনের একটি সম্ভাবনা দেখা দেয়, পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদীরা চায় তাদের পছন্দের অংশ ক্ষমতায় আসুক; তারা তাই তৎপর হয়ে ওঠে। ঘটনাটা দ্বিপক্ষীয়, দেশীয়রা সাহায্য চায়, বিদেশিরাও প্রস্তুত থাকে সাহায্য দিতে।
তরুণরা কিন্তু সকল সময়েই দুঃসাহসী। সাহস হারালে তাদের সঞ্চয় বলে আর কিছু থাকে না। হতাশা দেখা দেয়। বাংলাদেশে তেমনটাই দেখা যাচ্ছে। একদা যে তরুণরা মুক্তিযুদ্ধ করেছে, আজ তারা অনেকেই হতাশাগ্রস্ত। কেউ কেউ মাদকাসক্ত। অপরাধীদের কিশোর গ্যাং গড়ে উঠেছে। ব্যর্থতাটা মূলত সমাজ-পরিবর্তনকামী রাজনৈতিক শক্তির। তারা তরুণদের সমাজ-পরিবর্তনের সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে শাসকশ্রেণিকে ব্যর্থ বলা যাবে না। তাদের পক্ষে তরুণদের বিপথগামী ও রাজনীতিবিরোধী করে তোলাটাই স্বাভাবিক। তারা চায় না যে তরুণরা বিদ্রোহ করুক। তরুণের সাহসকে তারা ভয় পায়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে ছাত্র সংসদের নির্বাচন হয় না, সেটা একটা প্রমাণ তারুণ্যের প্রতি শাসকশ্রেণির অবিশ্বাসের।
আমরা চারপাশে দেখতে পাই সাধারণ মানুষ আছে, বিবেকবান মানুষেরও অভাব নেই, তারুণরাও রয়েছে। তারা রাজনীতিকদের ওপর আস্থা হারিয়েছে ঠিকই; কিন্তু নিজেদের ওপর আস্থা হারায়নি। তারা শ্রম দেয় এবং স্বপ্ন দেখে। তাদের শ্রম ও স্বপ্নই পরিবর্তনের কারণ হয়ে থাকে। ভরসা করি তারা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিপক্ষে দাঁড়াবে। কেবল আমাদের দেশে নয়, সব দেশে এবং সভ্যতাকে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার দিকে পরিচালিত করবে। স্বপ্ন ছাড়া মানুষ বাঁচে না এবং বাঁচার জন্যই নতুন পৃথিবী গড়ার স্বপ্নটা শক্তিশালী হয়ে উঠবে। পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন