ঢাকা বৃহস্পতিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৩

প্রতিবেশী

শ্রীলঙ্কা সংকট কাটিয়ে উঠতে পারল

শ্রীলঙ্কা সংকট কাটিয়ে উঠতে পারল

কলম্বো বন্দর, শ্রীলঙ্কা - রয়টার্স

আরশাদ সিদ্দিকী

প্রকাশ: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৮:০০

দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপ দেশ শ্রীলঙ্কা ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। দ্রুতই কাটিয়ে উঠছে অর্থনৈতিক সংকট। বছর খানেক আগে দেশটির অর্থনীতি প্রায় তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল। আমদানি ব্যয় মেটাতে অপারগ বৈদেশিক ঋণের বোঝায় জর্জরিত দেশটিতে দেখা দিয়েছিল খাবার-ওষুধসহ প্রয়োজনীয় দ্রব্যের তীব্র সংকট।

গত বছরের শুরু থেকেই করোনা মহামারির ধাক্কা, ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব, কূটনৈতিক ঋণের ফাঁদে বিপর্যস্ত দেশটি প্রায় দেউলিয়া হতে বসেছিল। অর্থনৈতিক অধোগতির জন্য দায়ী এসব কারণের সঙ্গে যোগ হয়েছিল ক্ষমতাসীন রাজাপাকসে পরিবারের লাগামহীন দুর্নীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনাগত অব্যবস্থাপনা। চরম অর্থনৈতিক বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে শুরু হয় প্রতিরোধ আন্দোলন ‘আরাগ্যালায়া’। এ আন্দোলনের ফলে দেশটিতে ছড়িয়ে পড়ে রাজনৈতিক সহিংসতা। শ্রীলঙ্কার ক্ষমতাসীন সরকার পদত্যাগে বাধ্য হয়। জনদাবির মুখে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন।

নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন রনিল বিক্রমাসিংহে। এর আগে তিনি একাধিকবার দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলেছেন। অস্থায়ী প্রেসিডেন্টের দায়িত্বেও নিয়োজিত ছিলেন। তাঁকে ঘিরেও জনগণের মধ্যে অসন্তোষ ছিল। বিশেষজ্ঞদের অনেকেই শ্রীলঙ্কার অচলাবস্থা নিরসনে বিক্রমাসিংহের ভূমিকা নিয়ে সংশয়মুক্ত হতে পারেননি।

শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন দিনেশ গুণাবর্ধনে। জনবিক্ষোভের মুখে মাহিন্দা রাজাপাকসে পদত্যাগ করায় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পান রনিল বিক্রমাসিংহে। এর পর গোটাবায়া রাজাপাকসে পদত্যাগে বাধ্য হওয়ায় প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন রনিল বিক্রমাসিংহে। দিনেশ গুণাবর্ধনে রনিল বিক্রমাসিংহের পদে আসীন হন।

রাজনৈতিক এ পালবদলে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক অবস্থাও ধীরে ধীরে বদলাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর মূল্যস্ফীতি ৪৯ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। শ্রীলঙ্কার সরকারি-বেসরকারি তথ্যে  দেখা যাচ্ছে, এ বছর মূল্যস্ফীতি নেমে এসেছে ৬ দশমিক ৩ শতাংশে।

কেমন করে এ বদল সম্ভব হলো? তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে চলছে নানা রকম বিচার-বিশ্লেষণ। তাদের মতে, সরকারের ব্যয় সংকোচন এবং করের আওতা সম্প্রসারণের ফলে দেশটির রাজস্ব বেড়েছে। আগের বছরের তুলনায় এ বছর পর্যটন খাত থেকে আয় বেড়েছে ২৫ শতাংশের বেশি। রেমিট্যান্স বেড়েছে প্রায় ৭৬ শতাংশ।

অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতিতে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু নীতিগত সিদ্ধান্তেরও ইতিবাচক ভূমিকা রয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে,  মুদ্রামানের অবমূল্যায়ন এবং করের আওতা সম্প্রসারণ শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তনে বড় ভূমিকা পালন করেছে। এ ছাড়া অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে শ্রীলঙ্কা আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের সহায়তা পেয়েছে।

বছর দুই আগে বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কাকে ২০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছিল। এ মাসে ঋণের প্রথম কিস্তি ৫ কোটি ডলার পরিশোধ করেছে শ্রীলঙ্কা। এ মাসের শেষে আরেকটি কিস্তি দেওয়ার কথা। ২০২১ সালে শ্রীলঙ্কা তিন মাসে পরিশোধের শর্তে বাংলাদেশ থেকে ঋণ নেয়। কিন্তু সময়মতো তা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়। সে ঋণ শোধ করতে শুরু করেছে তারা।

রাজনৈতিক এ পালাবদলের পর নতুন সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের ফলে দেশটিতে বেশ কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। তা সত্ত্বেও দেশটিকে পুরোপুরি অর্থনৈতিক সংকটমুক্ত বলা যাচ্ছে না। সামনে তাদের পাহাড়সমান প্রতিবন্ধকতা রয়ে গেছে।

অভ্যন্তরীণভাবে সংস্কার কার্যক্রমের বিরোধিতা করে ট্রেড ইউনিয়নগুলো ইতোমধ্যে সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। সরকারের ব্যয় সংকোচনে রাষ্ট্রায়ত্ত এয়ারলাইন্স, টেলিকম এবং ইন্স্যুরেন্সের মতো সংস্থাকে বেসরকারীকরণের যে পরিকল্পনা সরকার নিয়েছে, তা বাস্তবায়নও সহজ হবে না।

ভর্তুকি হ্রাসের ফলে বিদ্যুৎসহ প্রয়োজনীয় অনেক কিছুর ব্যয় বেড়ে গেছে। শুধু বিদ্যুৎ খাতেই ব্যয় বেড়েছে ৬৫ শতাংশ। ফলে জনসাধারণের মধ্যে ক্ষোভ-বিক্ষোভ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে।  চলতি বছরে সব মন্ত্রণালয়ের বাজেট ৬ শতাংশ কমানো হয়েছে। সামরিক বাহিনীর সদস্য সংখ্যাও কমিয়ে অর্ধেকে আনার পরিকল্পনা করেছে সরকার।

সরকারের গৃহীত এসব পরিকল্পনা শেষ পর্যন্ত কতটুকু বাস্তবায়ন সম্ভব এবং দেশটি কত দ্রুত এসব প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নয়ন সাধন করতে পারে তা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে আরও কিছুটা সময়। তাদের কাছ থেকে নিম্ন আয়ের এবং উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোরও শেখার আছে অনেক কিছু।

বর্তমানে শ্রীলঙ্কার মোট ঋণের পরিমাণ প্রায় ৮০ বিলিয়ন ডলার। ২০২৭ সালের মধ্যে ২৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ শোধ করতে হবে। সরকারের তরফ থেকে ঋণ পুনর্বিন্যাসের জন্য আলোচনা চলছে। আলোচনা সফল হলে হয়তো ঋণের বোঝা কিছুটা লাঘব হতে পারে।

২০২২ সালে ইউনাইটেড নেশনস কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (ইউএনসিটিএডি) এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়,  নিম্ন আয়ের  দেশগুলোর ৬০ শতাংশ এবং উদীয়মান অর্থনীতির ৩০ শতাংশ ‘ঋণ সংকটে বা কাছাকাছি’ ছিল। দেশভেদে পরিস্থিতি ভিন্ন হলেও বিশ্বব্যাপী এ সংকটের স্বরূপ প্রায় একই। 

শ্রীলঙ্কার সংকট বিশ্বের সামনে এক দৃষ্টান্ত। বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ প্রতিনিয়ত একই ধরনের সংকট মোকাবিলা করছে।  করপোরেট নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া যে বিশ্লেষণ থেকে আমাদের দূরে সরিয়ে রাখে; শ্রীলঙ্কার সংকটকে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বিচার না করলে এ সংকটের গভীরতা পরিমাপ করা যাবে না।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শ্রীলঙ্কা ঔপনিবেশিক শাসন থেকে রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভ করে। অর্থনৈতিক  স্বাধীনতা না থাকায় আবার নব্য উপনিবেশের কবলে পড়ে। সেখানে অসম বাণিজ্যের শর্তাবলির মধ্যে তাদের শ্রম, সম্পদ ও রপ্তানিকে অবমূল্যায়িত করা হয় এবং আমদানিকে অতিমূল্যায়ন। এ প্রক্রিয়াটি দরিদ্র দেশগুলোর জন্য প্রায় সমানভাবে খাটে।

আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক এবং উত্তর গোলার্ধের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের দেওয়া ঋণ-ত্রাণ এবং সাহায্য ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি পাওয়া দেশগুলোকে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কাঠামোর সঙ্গে সংযুক্ত রাখার জন্য নিছক অজুহাত। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর ২০২৩ সালের আগ পর্যন্ত শ্রীলঙ্কাকে মোট ১৬ বার আইএমএফের কাছে  যেতে হয়েছে।

উত্তরের ধনী দেশগুলো মূলত ঋণনির্ভরতার চক্রকে আরও স্থায়ী করতে চায়। ১৯৮০ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে দক্ষিণের দরিদ্র দেশগুলো শুধু সুদ দিয়েছে ৪ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন ডলার। উন্নত দেশগুলো থেকে প্রাপ্ত আর্থিক সহায়তা দক্ষিণের দরিদ্র দেশগুলোকে পরনির্ভরশীলই করেছে; অর্থনৈতিক মুক্তি দেয়নি।

শ্রীলঙ্কার বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট ভারত মহাসাগরে চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে নব্য ঔপনিবেশিক ভূ-রাজনৈতিক সংঘাতের প্রেক্ষাপটে বিচার করতে হবে। বিশ্বের অনেক দেশ তাদের কৌশলগত অবস্থান এবং প্রাকৃতিক সম্পদের কারণে নব্য ঔপনিবেশিক পরাশক্তির দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে খেসারত গুনেছে। 

গত বছর শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ইচ্ছাকৃতভাবে ‘মঞ্চস্থ’, নাকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় নীতিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য পরিচালিত হয়েছিল, তা নিয়ে অনেক জল্পনা-কল্পনা রয়েছে। শ্রীলঙ্কার জনগণ কতটা বাহ্যিকভাবে পরিচালিত হয়েছিল, তা বুঝতে হলে বৈশ্বিক ঋণ এবং অর্থনৈতিক সংকটকে গভীরভাবে বিবেচনায় নিতে হবে।

আরশাদ সিদ্দিকী: সাংবাদিক, গবেষক

আরও পড়ুন