ঢাকা বৃহস্পতিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৩

প্রতিবেশী

বাংলাদেশ যেখানে পশ্চিমবঙ্গ থেকে এগিয়ে

বাংলাদেশ যেখানে পশ্চিমবঙ্গ থেকে এগিয়ে

মইনুল ইসলাম

প্রকাশ: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৮:০০

২০২৩ সালে বাংলাদেশ অর্থনীতির বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে ভারতের পশ্চিমবঙ্গকে টপকে গেছে। বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু জিএনআই পশ্চিমবঙ্গের চাইতে বেশি। (জিএনআই হলো জিডিপি ও নিট রেমিট্যান্সের যোগফল)। পশ্চিমবঙ্গের মেগাসিটি কলকাতাকে জনসংখ্যার দিক থেকে অনেকখানি পেছনে ফেলে দিয়েছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। ঢাকার জনসংখ্যা এখন দুই কোটি ২০ লাখ, আর কলকাতার জনসংখ্যা এক কোটি ৬০ লাখ। এমনকি জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান এখন পশ্চিমবঙ্গের চাইতে বাংলাদেশে বেশি। বাংলাদেশের নারীর প্রায় ৪১ শতাংশ বাড়ির আঙিনার বাইরে অর্থনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে ক্রিয়াশীল। দেশের দ্রুত বিকাশমান তৈরি পোশাক শিল্পে ৪০ লাখের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। এই শ্রমিকদের ৭০ শতাংশেরও বেশি নারী, যার সিংহভাগই গ্রাম থেকে এসে শহরে কর্মসংস্থান বেছে নিয়েছে। সমাজের দরিদ্র ও প্রান্তিক অবস্থানের এসব নারীর প্রাতিষ্ঠানিক শিল্প খাতে কর্মসংস্থান তাদের বঞ্চনা ও চরম দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে ভূমিকা রাখছে।

 ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিক শৃঙ্খল থেকে এক নদী রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জনকারী বাংলাদেশ ছিল একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত এবং চরম দারিদ্র্যকবলিত দেশ, যেখানে জনসংখ্যার ৮২ শতাংশই ছিল দারিদ্র্যসীমার নিচে। সুতরাং, ওই পর্যায়ে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ দারিদ্র্যপীড়িত হলেও বাংলাদেশের মানুষের চাইতে জীবনযাত্রার মানে এগিয়ে ছিল। বামফ্রন্টের দীর্ঘ শাসনামলে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বাংলাদেশের মানুষের চাইতে জীবনযাত্রার মানে আরও এগিয়ে ছিল।

’৭০ দশকের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে গত সাড়ে চার দশকে বাংলাদেশ থেকে আনুমানিক যে এক কোটি ৫০ লাখ অভিবাসী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত, তাদের ৯০ শতাংশ গ্রামের মানুষ। তাদের পাঠানো ক্রমবর্ধমান রেমিট্যান্সের অর্থপ্রবাহ এদেশের গ্রামীণ জনগণের জীবনে সচ্ছলতার একটা বড়সড় উপাদান নিয়ে এসেছে, যা পশ্চিমবঙ্গে তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। এখন বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতি পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ অর্থনীতির চাইতে অনেক বেশি গতিশীল হয়ে উঠেছে।

২০২১ সালের ২৪ নভেম্বর বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার সব শর্ত পূরণ করেছে। এর আগে ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাংকের ‘নিম্ন আয়ের দেশ’ ক্যাটেগরি থেকে বাংলাদেশ ‘নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ’ ক্যাটেগরিতে উত্তীর্ণ হয়েছে। ড. ইউনূস উদ্ভাবিত ক্ষুদ্রঋণ আন্দোলনের সাফল্য গ্রামের ভূমিহীন নারীর কাছে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ পৌঁছে দেওয়ার একটা কার্যকর হাতিয়ার বাংলাদেশকে উপহার দিয়েছে। গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাক এবং কয়েক হাজার এনজিওর ক্ষুদ্রঋণের সহায়তায় গ্রামীণ নারীর স্বকর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বাংলাদেশ বিশ্বে সফল দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের গ্রামীণ দারিদ্র্য নিরসনে ক্ষুদ্রঋণ তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। এর উল্টোদিকে পশ্চিমবঙ্গে গত চার দশক ধরে এক ধরনের ‘বি-শিল্পায়ন’ প্রক্রিয়া ক্রিয়াশীল হয়ে উঠেছিল আক্রমণাত্মক ট্রেড ইউনিয়ন ও রাজনৈতিক হানাহানির কারণে। অনেক শিল্পপতি বৈরী রাজনীতির শিকার হয়ে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ভারতের পশ্চিমাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে তাদের শিল্প-কারখানা সরিয়ে নিয়েছেন। বামফ্রন্টের আমলে মমতা ব্যানার্জির রাজনৈতিক আন্দোলনে নাজেহাল হয়ে টাটা গ্রুপ কর্তৃক তাদের ‘টাটা ন্যানো’ গাড়ির কারখানা পশ্চিমবঙ্গের সিংগুর থেকে গুজরাটে স্থানান্তরের ঘটনাটি বিশ্বে প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। পরবর্তীকালে নন্দীগ্রাম থেকে ইন্দোনেশিয়ার একটি শিল্প গ্রুপকেও পাততাড়ি গোটাতে হয়েছিল মমতা ব্যানার্জির আন্দোলনের কারণে। ২০১১ সালে মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতাসীন হওয়ায় পশ্চিমবঙ্গের এই নেতিবাচক ইমেজ গত এক যুগেও দূর হয়নি।

আশির দশকে রাজীব গান্ধী কলকাতাকে ‘ডাইয়িং সিটি’ আখ্যায়িত করেছিলেন। সেই ইমেজ থেকে কলকাতা আজও মুক্তি পায়নি। পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ৫০ শতাংশ শ্রমজীবী মানুষ এখনও কৃষি খাতে কর্মরত। ভারতের এক সময়ের নেতৃস্থানীয় শিল্পায়িত রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ বর্তমানে শিল্পায়নের ক্ষেত্রে ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে।

অন্যদিকে, কিছুদিন আগেও কৃষি খাতের অগ্রগতি বাংলাদেশের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে বেশি ছিল। অপারেশন বর্গার সাফল্য পশ্চিমবঙ্গকে এই অগ্রগতি অর্জনে সহায়তা করেছিল। এখন বাংলাদেশের কৃষি খাতেও সমৃদ্ধির ছোঁয়া লেগেছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর কৃষি ও কৃষকবান্ধব নীতিমালা গ্রহণের কারণেই কৃষি খাতে এই চমকপ্রদ সাফল্যের ধারা সূচিত হয়েছিল। ২০০৯ সালে মহাজোট ক্ষমতাসীন হওয়ার পর তাদের নিষ্ঠাবান প্রয়াসের ফলে ২০১১ সালে বাংলাদেশ মোটা ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। ১৯৭২ সালে দেড় কোটি টন ধান লাগত আমাদের, অথচ উৎপাদন করতে পারতাম মাত্র এক কোটি ১০ লাখ টন। গত ২০২২ সালে এদেশে বছরে তিন কোটি ৯০ লাখ টন ধান উৎপাদিত হয়েছে। ১৭ কোটির বেশি মানুষের খাদ্যশস্য জোগান দিয়েও এখন প্রায় প্রতি বছর মোটা ধান উদ্বৃত্ত হচ্ছে আমাদের। ধান, গম ও ভুট্টা মিলে ২০২২ সালে খাদ্যশস্য উৎপাদন ছিল চার কোটি ৪০ লাখ টন। (অবশ্য প্রতি বছর আমরা ৬০/৬৫ লাখ টন গম আমদানি করি)। ৭০ লাখ টন আলুর অভ্যন্তরীণ চাহিদার বিপরীতে ২০২২ সালে বাংলাদেশে এক কোটি ২ লাখ টন আলু উৎপাদিত হয়েছে। মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে দ্বিতীয়, তরিতরকারি উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ। হাঁস-মুরগির ডিম ও মাংস উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। দুধ উৎপাদনে দেশে এখনও ঘাটতি রয়ে গেলেও গরু-মহিষের মাংস উৎপাদনে আমরা স্বয়ম্ভরতার দ্বারপ্রান্তে। ঈদুল আজহার সময় অতীতে চোরাচালানে আসা ভারতীয় গরু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও এখন তার প্রয়োজন হয় না, বরং ২০২৩ সালের ঈদুল আজহার সময় কোরবানির গরু উদ্বৃত্ত ছিল। আম, পেয়ারা, আনারস, কলা ও কাঁঠালের মতো কয়েকটি প্রধান ফল উৎপাদনেও বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। খাদ্য সাহায্য এখন আমাদের বৈদেশিক ঋণ/অনুদানের ১ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে।


উচ্চফলনশীল প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার সেচ ব্যবস্থার আওতায় আসায় দেশের অধিকাংশ জমিতে বোরো চাষের সম্প্রসারণ, যথাযথ ভর্তুকি প্রদান, কৃষিঋণ পদ্ধতির সহজীকরণ, ফসলের বহুধাকরণ, কৃষির লাগসই যান্ত্রিকীকরণ, উচ্চফলনশীল ফসল, তরিতরকারি, মাছ, হাঁস-মুরগি ও ফলমূল চাষের ব্যাপক প্রচলন, রাসায়নিক সার, বীজ ও কীটনাশকের সহজলভ্যতা ইত্যাদি কৃষি খাতের উল্লেখযোগ্য সাফল্য। বলা চলে, বাংলাদেশে একটি কৃষিবিপ্লব চলমান। অবশ্য বাংলাদেশের জিডিপির মাত্র ১৩ শতাংশ এখন কৃষি খাত থেকে আসছে, যা ক্রমহ্রাসমান। কিন্তু কৃষিতে এখনও দেশের ৪০ শতাংশ শ্রমজীবী কর্মরত।

বাংলাদেশের অভিবাসীরা ফরমাল চ্যানেলে প্রতি বছর ২১/২২ বিলিয়ন ডলার অর্থ পাঠায়। এর বাইরে হুন্ডির মতো অপ্রাতিষ্ঠানিক চ্যানেলে যে আরও ২০ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে, তা গ্রামীণ অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় শক্তির উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগণের দারিদ্র্য দ্রুত নিরসনের বড় কারণ এই রেমিট্যান্স প্রবাহ। এই প্রবাহের সুফলভোগী পরিবারগুলোর বর্ধিত ভোগ, সঞ্চয় ও বিনিয়োগে গ্রামীণ অর্থনীতিতে বড়সড় সমৃদ্ধির জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। বাড়িঘর পাকা হচ্ছে; অন্যান্য ধরনের বসতঘরেরও মান বৃদ্ধি পেয়েছে; ছেলেমেয়ে ভালো স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে; পরিবারের সদস্যদের আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের সামর্থ্য বাড়ছে; শিশুমৃত্যুর হার কমছে; স্যানিটারি পায়খানার প্রচলন বাড়ছে; ঘরে ঘরে টিউবওয়েল বসেছে; ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ চলে এসেছে; কৃষির যান্ত্রিকীকরণ ত্বরান্বিত হচ্ছে; গ্রামে শপিংমল স্থাপনের হিড়িক পড়েছে। গ্রামের রাস্তাঘাটেও আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থা চালু হয়ে গেছে। এর ফলে গ্রামীণ জনগণের মধ্যে প্রায় ৮০ লাখ পরিবারের অন্তর্ভুক্ত ৪-৫ কোটি মানুষ এখন নিম্ন-মধ্যবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্ত অবস্থানে উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। কৃষি খাতের সাফল্যের পেছনেও বাংলাদেশি অভিবাসীদের অবদান অনস্বীকার্য। কৃষিতে উচ্চফলনশীল প্রযুক্তির প্রসার; সেচ ব্যবস্থার ব্যাপক প্রচলন; গ্রামীণ যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ; আধুনিক স্বাস্থ্য সুবিধা গ্রহণের পারঙ্গমতা বৃদ্ধি; গ্রামীণ জনগণের খাদ্যের পুষ্টিমান বৃদ্ধি ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স বিপুল অবদান রাখছে। গ্রামীণ সড়ক উন্নয়ন এবং আধুনিক পরিবহন চালুর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পশ্চিমবঙ্গকে পেছনে ফেলে দিয়েছে। বিদ্যুতায়নেও বাংলাদেশের সাফল্য প্রশংসনীয়। বাংলাদেশের শতভাগ মানুষ ২০২১ সালে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে।

পশ্চিমবঙ্গের সাক্ষরতার হার এখনও বাংলাদেশের সাক্ষরতার হারের চাইতে অনেক বেশি। পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষার মানও বাংলাদেশের চাইতে ভালো; উচ্চশিক্ষিত মানুষও পশ্চিমবঙ্গে অনেক বেশি। (মাদ্রাসা শিক্ষা বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে পেছনে টেনে ধরে রেখেছে)। তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারেও পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশের চাইতে অগ্রগামী। পশ্চিমবঙ্গ থেকে আইটি সম্পর্কিত সেবা রপ্তানি ২০২২ সালে তিন বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। জনগণের রাজনৈতিক সচেতনতা বাংলাদেশের চাইতে পশ্চিমবঙ্গে অনেক বেশি। বিধানসভা এবং লোকসভার নির্বাচনগুলো পশ্চিমবঙ্গে জালিয়াতিমুক্ত বলা চলে। গত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির ভরাডুবি তারই প্রমাণ বহন করছে। অথচ বাংলাদেশের গণতন্ত্র লাইনচ্যুত। পশ্চিমবঙ্গে জনগণের আয়বৈষম্য বাংলাদেশের চাইতে কম হওয়ায় প্রান্তিক জনগণের ভোগের মান বাংলাদেশের চাইতে ভালো হওয়ার কথা। অবশ্য বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যার ১৭-১৮ শতাংশ এখনও দারিদ্র্যসীমার নিচে।   

ড. মইনুল ইসলাম: সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন