
গত কয়েক বছর ধরে দেশব্যাপী বেশ কিছু ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কিশোর গ্যাং কালচার নামক সামাজিক অবক্ষয়ের নতুন এক চিত্র আমাদের গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিশোর গ্যাং বলতে ১৮ বছর কিংবা তার কম বয়সের সংঘবদ্ধ কিশোরদের বোঝায়, যারা নিজেরা সংঘবদ্ধ হয়ে বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালিত করে থাকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্যমতে, শুধু ঢাকাতেই ৯০টিরও অধিক কিশোর গ্যাং প্রায় সাড়ে তিনশ সদস্য দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। যদিও বিভিন্ন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী সংখ্যাটা আরও বেশি।
কিশোর গ্যাং কালচার বর্তমানে শুধু শহরের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ নেই, এর ভয়াল চিত্র দেখা যাচ্ছে গ্রামাঞ্চলেও। সম্প্রতি পুলিশের হাতে আটক হয়েছে ঢাকার মোহাম্মদপুরে নিজেদের কবজি কাটা গ্রুপ বলে পরিচয় দেওয়া এক কিশোর গ্যাং সদস্য, যারা টিকটক করার নামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্যমতে, গত দুই বছরে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে প্রায় ৩৪ জন নিহত হয়েছে! আহত হওয়ার ঘটনা অসংখ্য। এমন তথ্য আমাদের সবার জন্য আতঙ্কের।
কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা প্রায়ই নিজেদের শক্তিমত্তা জানান দিতে সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করছে। তারা একই রকম চুল কাটা থেকে শুরু করে অদ্ভুত চলাফেরাতে অভ্যস্ত। বিভিন্ন সময়ে এরা দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মহড়া দিচ্ছে, মেয়েদের যৌন হয়রানি করছে। বর্তমানে বিভিন্ন উচ্চবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্ত পরিবারের কিছু কিছু কিশোর এসব গ্যাংয়ে যোগ দিচ্ছে। ব্যক্তিগত হতাশা কিংবা নিজেদের প্রভাব বাড়ানো, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে এরা কিশোর গ্যাংয়ে নাম লেখাচ্ছে, যেটা সব থেকে দুঃখজনক। আবার রাজনীতিতে প্রভাব রাখতে অনেকেই কিশোর গ্যাং পুষে রাখে বলেও অভিযোগ আছে।
প্রযুক্তির উন্নতির কারণে অপসংস্কৃতির আগ্রাসন আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় স্পষ্ট। অপসংস্কৃতির আগ্রাসন আমাদের সামাজিক অস্থিরতা বাড়াচ্ছে। প্রযুক্তির এই অপব্যবহার সব থেকে বেশি হচ্ছে কিশোরদের মাধ্যমে। যেখানে বিভিন্ন ধরনের ভিডিও গেমস, টিকটক, লাইকি কিংবা ডিপ ফেকের মতো অ্যাপস বড় ভূমিকা রাখছে।
দীর্ঘদিন ধরে এসব গেমস কিংবা অ্যাপসের ক্ষতিকারক দিক নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। তবে কোনো কিছুতেই যেন সমাধান হচ্ছে না; বরং এর ব্যাপকতা ঘটছে দিন দিন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এসব কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে তৎপর থাকলেও থেমে নেই তাদের কর্মকাণ্ড! এদের অসামাজিক কার্যকলাপে বাধা দিতে গিয়েও লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনা আছে। সুতরাং, কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরি করতে না পারলে সেটা মহামারির মতো দেখা দেবে অদূর ভবিষ্যতে।
বিপথগামী এসব গ্যাংকে শুধু প্রতিরোধ করলেই হবে না, এদের মূলধারায় সুস্থ জীবনযাপনে ফিরিয়ে আনাও এক বড় চ্যালেঞ্জ! কিশোরদের বিপথগামী হওয়ার ক্ষেত্রে পরিবারের উদাসীনতা সব থেকে বড় কারণ। এ ছাড়াও নৈতিক শিক্ষার অভাবও এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে। প্রযুক্তির উন্নতি সাধন থেমে থাকবে না। তাই এগুলোর সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে আমাদের বিকল্প পথ তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আরও কঠোর অবস্থান জরুরি।
কে এম মাসুম বিল্লাহ : ব্যাংক কর্মকর্তা
মন্তব্য করুন