কানাডা শুক্রবার ভারতের সঙ্গে তার সম্ভাব্য বাণিজ্য চুক্তিসংক্রান্ত আলোচনা ‘অনির্দিষ্টকালের জন্য’ স্থগিত করেছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ জানিয়েছে, শুক্রবার বিকেলে এক বিবৃতিতে কানাডার বাণিজ্যমন্ত্রী ম্যারি ইংয়ের মুখপাত্র কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই এ ঘোষণা দেন। কবে এ আলোচনা আবার শুরু হবে, এ নিয়েও কিছুই বলেননি ওই মুখপাত্র।

 গত মে মাসে ইং এবং ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রী পীযুষ গয়াল এক যৌথ বিবৃতিতে এ বছরের শেষ নাগাদ নিজেদের মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধির আশা পোষণ করেছিলেন। সেই অনুসারে, ইংয়ের নেতৃত্বে একটা টিম ৯ অক্টোবর ভারতের মুম্বাই যাওয়ার কথা ছিল। বলা হয়েছিল, তখন দুই দেশ অটোমোবাইল, কৃষি, তথ্যপ্রযুক্তিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাণিজ্য বাড়ানোর সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করবে। দুই দেশ ওই বৈঠকেই কাঙ্ক্ষিত চুক্তি স্বাক্ষর করতে পারে বলেও বিভিন্ন খবরে জানা গিয়েছিল। এখন বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে পড়ল।

যদিও ভারতীয় দৈনিক হিন্দুস্তান টাইমস বলেছে, প্রথমে ভারতীয় কর্তৃপক্ষই ‘কানাডার ভূমিতে ভারতবিরোধী নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত’ ওই আলোচনা স্থগিত করে। কারণ ‘ভারত এমন কোনো দেশের সঙ্গে আলোচনায় বসতে পারে না, যেখানে ভারত ও তার জনগণবিরোধী নাশকতামূলক তৎপরতা চলে’। আলজাজিরা জানিয়েছে, ভারতের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেছেন– তারা আলোচনা স্থগিতের কানাডার ঘোষণা শুধু সংবাদমাধ্যমেই দেখেছেন। ব্লুমবার্গও লিখেছে, কানাডার প্রধানমন্ত্রী গত ৯-১০ সেপ্টেম্বর দিল্লির জি২০ সম্মেলনের উদ্দেশে রওনার হওয়ার আগে আগে ভারতের সঙ্গে দ্রুত চুক্তি সম্পাদনের বিষয়টি কানাডা স্থগিত করে। ম্যারি ইং এ সপ্তাহে এর একটা ব্যাখ্যাও দেন সংবাদমাধ্যমের কাছে। তিনি বলেন, অন্য অংশীজনের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আরও আলোচনা করতে হবে।

প্রসঙ্গত, গত বছর কানাডা যে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল ঘোষণা করে, তাতে চীনকে এড়িয়ে এশিয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্য বহুমুখী করার ওপর বেশ গুরুত্ব দেওয়া হয়। সেখানে বলা হয়, ‘ক্রমবর্ধমান কৌশলগত, অর্থনৈতিক ও জনসংখ্যাগত গুরুত্বের কারণে ভারত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে কানাডার এক মূল্যবান অংশীদারে পরিণত হয়েছে।’

এতকিছুর পরও কানাডা ভারত থেকে এখন মুখ ফেরালো বলেই মনে হচ্ছে। ইংয়ের মুখপাত্রের বিবৃতিতে আগামী বছর জাপান, ইন্দোনেশিয়া, কোরিয়া, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া ও ভিয়েতনামের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়ানোর তৎপরতা চালানোর কথা থাকলেও ভারতকে ওই তালিকায় রাখা হয়নি।

আমরা জানি, সাম্প্রতিক সময়ে কানাডায় শিখ সম্প্রদায়ের লোকেরা ভারত থেকে পাঞ্জাবকে বিচ্ছিন্ন করে স্বতন্ত্র ‘খালিস্তান’ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করছে। এটিকে মোদি সরকার ভারতবিরোধী তৎপরতা বলে আখ্যা দিচ্ছে। যে কোনো মূল্যে তা বন্ধের জন্য তারা কানাডা সরকারকে চাপ দিচ্ছে। অন্যদিকে, কানাডা সরকার বলছে, ওই আন্দোলনকে তারা শিখ নাগরিকদের ‘মতপ্রকাশের অধিকার’ বলে মনে করে।

অবশ্য এটাও বলেছে তারা, অল্প কিছু মানুষের মিটিং-মিছিলকে পুরো সম্প্রদায়ের কাজ বলে চালানোর সুযোগ নেই। প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো এটিকে উপেক্ষা করার জন্য তাঁর ভারতীয় প্রতিপক্ষকে অনুরোধ করেন। কিন্তু মোদি সরকার তা মানতে রাজি নয়। তাই মোদি এমনকি ট্রুডোকে এবারের জি২০ সম্মেলনের সময় এক কোণে ডেকে নিয়ে রীতিমতো ভর্ৎসনা করেন বলেও সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে। মোদি ওই সময় অনেকের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করলেও ট্রুডোর এমন বৈঠকের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। বিষয়টি কানাডার জন্য ব্যাপক অপমানজনকই হওয়ার কথা। বাস্তবেও সেটাই ঘটেছে।

বলাবাহুল্য, কানাডার ভোটারদের মধ্যে শিখ সম্প্রদায়ের লোক একেবারে কম নয়। ভারতের বাইরে কানাডাতেই শিখ জনগোষ্ঠীর লোক সবচেয়ে বেশি। অতএব উদারপন্থি ট্রুডোর কাছে ভোটার হিসেবে শিখদের মূল্য অপরিসীম। তাই একই রকম ইস্যুতে অন্য অনেক ক্ষেত্রে ভিন্ন আচরণ করলেও এ ক্ষেত্রে তাঁকে চরম উদারপন্থি হতেই হবে।

প্রশ্ন উঠেছে, ভারতকে নিয়ে আমেরিকা ও তার পশ্চিমা মিত্ররা এতদিন ধরে যে স্বপ্ন দেখে আসছে, যা কানাডাও এতদিন দেখেছে– তা এর ফলে ভাঙার মুখে পড়বে না তো? এখনই নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না। কারণ এশিয়ায় এবং এমনকি বিশ্ব পরিসরে চীনকে ঠেকাতে হলে পশ্চিমাদের ভারতকে লাগবেই। এ কারণেই তারা ইদানীং ভারতকে রীতিমতো কাঁধে তুলে নাচছে। যুক্তরাষ্ট্র যে জি২০ সম্মেলনের ঘোষণায় ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য সরাসরি রাশিয়ার নিন্দা থেকে বিরত থাকার ভারতীয় প্রস্তাবে রাজি হলো– এত তারই নিদর্শন। কারও কারও মতে, এটা মার্কিন প্রশাসনের জন্য রীতিমতো অনুরোধে ঢেঁকি গেলার মতো।

তাই বলে কানাডার পক্ষে তো কিল খেয়ে কিল হজম করার অবকাশ নেই। কানাডীয় খালিস্তানপন্থিদের বিরাগভাজন হয়ে মোদি সরকারের দাবি মেনে নিলে তো তা গত নির্বাচনে কানের কাছ দিয়ে গুলি যাওয়া ট্রুডোর জন্য আত্মঘাতী হতে পারে। আপনা বাঁচলে বাপের নাম। দেখা যাক, কোথাকার জল শেষ পর্যন্ত কোথায় গড়ায়। 

সাইফুর রহমান তপন : সহকারী সম্পাদক, সমকাল