উনিশ শতকের শেষ দিকে মার্কিন নৌকৌশলবিদ আলফ্রেড থায়ার মাহান ‘দি ইন্টারেস্ট অব আমেরিকা ইন সি পাওয়ার’ (১৮৯৭) শিরোনামে একটি গ্রন্থ লেখেন। এতে তিনি লিখেছেন, সমুদ্রবাণিজ্য বা নৌশক্তি যেভাবেই হোক; সমুদ্র যার নিয়ন্ত্রণে থাকবে তার পক্ষে পৃথিবী নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। বর্তমানে বিশ্ববাণিজ্যের ৯০ শতাংশই হয় সমুদ্রপথে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম দ্য ডিপ্লোম্যাটের মতে, বঙ্গোপসাগরে খনিজসম্পদের সঠিক আহরণ ও ব্যবহার বাংলাদেশকে আগামী দিনের এনার্জি সুপারপাওয়ারে পরিণত করবে। আবার আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম দ্য স্ট্র্যাটেজিস্টের মতে, বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ জনসংখ্যা রয়েছে এ অঞ্চলে।

 চট্টগ্রামের দক্ষিণে মাতারবাড়ীতে বাংলাদেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে জাপান। এ বন্দর ও অর্থনৈতিক অঞ্চল জাপানের ‘বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট (বিগ-বি)’-এর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলের লজিস্টিকস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি এবং ওয়াটারফ্রন্ট ইন্ডাস্ট্রির কেন্দ্র হবে নতুন এ বন্দর ও অর্থনৈতিক অঞ্চল। ২০২২ সালের ১ মার্চ ঢাকায় ‘এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরের ভূরাজনীতি এবং বঙ্গোপসাগরের উপকূলের পুনঃসংযোগ’ শীর্ষক সেমিনারে জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি বলেন, অবাধ ও উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক এ অঞ্চলের প্রতিটি দেশের শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির জন্য শৃঙ্খলাভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে। ইন্দো-প্যাসিফিকের কৌশলগত বাণিজ্যপথে বাংলাদেশের অবস্থান। জাপানের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)’-এর প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং সংগতিপূর্ণ বলে মনে করেন টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তাকাহারা আকিও।

মার্কিন জিওলজিক্যাল সার্ভে বিভাগের তথ্যমতে, অগভীর সমুদ্রে ৮ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস ও সাগরক্ষেত্রের ১০ ও ১১ নং ব্লকের ৫ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুতের কথা জানা যায়। বঙ্গোপসাগরে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম খাদ ‘সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড’– যেখানে তিমি, ডলফিন, কচ্ছপসহ বিরল জলজ প্রাণীর নিরাপদ প্রজননকেন্দ্র, জীববৈচিত্র্যের অন্যতম আধার; বিশাল এই জলভান্ডারে রয়েছে মৎস্য সম্পদের প্রাচুর্য। এখানেও খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুত আছে বলে ধারণা করা হয়। এ ছাড়াও ১৩ রকমের খনিজদ্রব্যসহ খনিজ বালুর আনুমানিক ধারণা পাওয়া যায়। প্রতি বছর বাংলাদেশ প্রায় ৬ লাখ টন মাছ আহরণ করে, যা দেশের মোট উৎপাদনের প্রায় ১৮ শতাংশ। বিশ্বের দীর্ঘতম অখণ্ড সমুদ্রসৈকত, ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যসমৃদ্ধ প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন বঙ্গোপসাগরের তীরে অবস্থিত।

বঙ্গোপসাগরে মজুত খনিজ সম্পদের কৌশলগত ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশ শক্তি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে। মৎস্য সম্পদ আহরণ ও প্রক্রিয়াজাত করে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতসহ বৈদেশিক রপ্তানি আয়ে অবদান রাখতে পারে। কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত, প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন ও সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে কেন্দ্র করে পর্যটনশিল্পে এক নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে। বঙ্গোপসাগরের তলদেশে ৩০ থেকে ৮০ মিটার গভীরতায় এক ধরনের ক্লের সন্ধান পাওয়া গেছে, যা সিমেন্ট উৎপাদনে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

বৈশ্বিক সামুদ্রিক বাণিজ্যের ৩০ শতাংশ ও বার্ষিক প্রায় ৫ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য শুধু দক্ষিণ-চীন সমুদ্র দিয়েই পরিচালিত হয়। প্রায় এক লাখ জাহাজ এ পণ্য সরবরাহ করে ভারত মহাসাগর থেকে আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত বাণিজ্য পথ ধরে। এখানে নিজেদের কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা চীনের নিজস্ব বাণিজ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য খুবই প্রয়োজন। চীন এশিয়ার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের সঙ্গে মেরিটাইম সিল্ক রোডের মাধ্যমে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অধীন অতি উচ্চাকাঙ্ক্ষী এক প্রকল্পের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছে। চীন ইতোমধ্যে বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে সমুদ্র উপকূলবর্তী অবকাঠামো নির্মাণের জন্য বিপুল বিনিয়োগ করছে। আবার ভারতের ‘অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি’ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মিয়ানমার হচ্ছে একটি অপরিহার্য নিয়ামক। ভারতের এই ‘পুবে তাকাও’ নীতির আলোকে পূর্ব এশিয়ায় তার প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক সুদৃঢ় করার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারের দিক দিয়ে মিয়ানমার একটি মূল ভিত্তি। যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারে চীনের বিপরীতে ভারতকে সমর্থন করে। ভারতের স্বার্থ হলো বঙ্গোপসাগর ও বাংলাদেশের ট্রানজিট ব্যবহার করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সেভেন সিস্টার্স রাজ্য–আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, মণিপুর, অরুণাচল, মিজোরাম, নাগাল্যান্ডে পণ্য পৌঁছে দেওয়া এবং বঙ্গোপসাগরসহ এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের কৌশলগত আধিপত্য বিস্তারকে চ্যালেঞ্জ করে কৌশলগত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। ভারতের ইকোনমিক কটন রুটের বাস্তবায়নের মাধ্যমে চীনের সামুদ্রিক সিল্ক রুটকে চ্যালেঞ্জ জানানো।

বঙ্গোপসাগরের সীমারেখা শুধু কক্সবাজার পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয়, এটা শ্রীলঙ্কার নিচ পর্যন্ত বিস্তৃত। বিশ্বের প্রায় অর্ধেক পণ্য ও জ্বালানিবাহী জাহাজ এ পথ ব্যবহার করে। সমুদ্রপথে আমাদের প্রায় ৯ হাজার কোটি ডলারের বাণিজ্য হয়। বিদেশের সাড়ে চার হাজার জাহাজ বাংলাদেশে এই আমদানি-রপ্তানি পণ্য পরিবহন করে। বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জও রয়েছে। মাদক চোরাচালান, মালাক্কা প্রণালিতে জলদস্যুতা, জাহাজ বা স্থলভাগ থেকে দূষণ সাগরের পরিবেশ বিনষ্ট করছে। বিমসটেক, সার্ক ও আসিয়ানের মাধ্যমে সম্মিলিতভাবে এসব সংকট দূর করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বর্তমান সরকার সংঘাত এড়িয়ে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় সব দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার নীতি অনুসরণ করছে। ভারসাম্যের কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের আইপিএসের পাশাপাশি চীনের বিআরআইর সক্রিয় অংশীদার বাংলাদেশ। জাপানের ন্যাশনাল গ্র্যাজুয়েট ইনস্টিটিউট অব পলিসি স্টাডিজের (জিআরআইপিএস) প্রেসিডেন্ট তানাকা আকিহিকা ‘বঙ্গোপসাগরে কানেকটিভিটি: বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ’ শীর্ষক এক ওয়েবিনারে বলেন, ভূরাজনীতি নিয়ে প্রতিযোগিতা থাকলেও যুক্তরাষ্ট্র ও চীন পরস্পরের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার।

যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল (আইপিএস) বা চীনের নেতৃত্বে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)– যাতেই সম্পৃক্ত হই না কেন, বঙ্গোপসাগর থেকে সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক সুবিধা পেতে হলে বাংলাদেশের সমুদ্রাঞ্চলে শান্তি ও আইনের শাসন বজায় রাখতে হবে। বঙ্গোপসাগরের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিতে এর উপকূলীয় রাষ্ট্রগুলোর অভিন্ন স্বার্থ বিদ্যমান। বিমসটেক এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংগঠন বঙ্গোপসাগরে একটি আইনভিত্তিক সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারে; যা অন্তত বঙ্গোপসাগরকে তুলনামূলকভাবে শান্তি বজায় রাখতে সহায়তা করবে এবং সমুদ্রসম্পদের ন্যায্য হিস্যার পথ সুগম করবে। বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সহযোগিতার যেমন সম্ভাবনা রয়েছে, তেমনি বিরোধের আশঙ্কাও রয়েছে। আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক রাজনীতির আধিপত্য বিস্তার ও বাণিজ্য স্বার্থের এই জটিল হিসাবনিকাশে বাংলাদেশের কৌশলী অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। বঙ্গোপসাগর ও বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ তার পররাষ্ট্রনীতিতে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় সমন্বয় করতে পারে। ভারত, জাপান, চীনসহ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করে বাণিজ্যবৈষম্য রোধ ও বিনিয়োগ বাড়াতে পারে। বঙ্গোপসাগরীয় দেশগুলোর জোট বিমসটেকে বাংলাদেশের অবস্থান আরও সুদৃঢ় করা উচিত। আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোতে বাংলাদেশের প্রবেশ বঙ্গোপসাগর দিয়ে হতে পারে এবং এ লক্ষ্যে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করতে হবে।   

ড. মো. মোরশেদুল আলম: শিক্ষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়