- মতামত
- ৬১ বছরে শিক্ষা দিবস: স্বীকৃতির দীর্ঘ অপেক্ষা
ফিরে দেখা
৬১ বছরে শিক্ষা দিবস: স্বীকৃতির দীর্ঘ অপেক্ষা

আজ ১৭ সেপ্টেম্বর। ঐতিহাসিক ‘শিক্ষা দিবস’। যে পটভূমিতে বৈষম্য, বঞ্চনা ও ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন সূচিত হয়– নবকুমার স্কুলের ছাত্র বাবুল, বাস কন্ডাক্টর গোলাম মোস্তফা ও গৃহকর্মী ওয়াজীউল্লাহ শাহাদাতবরণ করেন, তা আমাদের জাতীয় ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আজ তার ৬১ বছর পূর্তির দিন।
১৯৫৯ সালে সর্বদলীয় ছাত্র সংগঠনগুলোর একুশের সম্মিলিত অনুষ্ঠানে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ সভাপতির ভাষণে এসব বিকৃতি ও রোমান হরফ প্রবর্তনের প্রস্তাবসহ অন্যান্য তথাকথিত সংস্কার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এ সময়ে– বিশেষ করে– পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থবৈষম্য এবং পশ্চিম কর্তৃক পূর্বকে শোষণের স্বরূপ বুদ্ধিজীবী ও অর্থনীতিবিদদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ পটভূমিতে পূর্ব বাংলার বুদ্ধিজীবী সংস্কৃতিসেবী ও অগ্রণী ছাত্রসমাজ যখন বঞ্চনার বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফুঁসছিলেন, সে সময়– ১৯৬২ সালে– শরীফ শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট প্রকাশিত হয়; আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট হয়েই শিক্ষানীতি প্রণয়নের জন্য ১৯৫৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর পাকিস্তান শিক্ষা বিভাগের সচিব ও আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর সাবেক শিক্ষক এসএম শরীফকে চেয়ারম্যান করে এ কমিশন গঠন করেন। শরীফ কমিশনের যে সুপারিশ বাষট্টির ছাত্র আন্দোলনকে তীব্রতর করে ও আশু কারণ হিসেবে দেখা দেয় তা হলো, দুই বছর মেয়াদি স্নাতক ডিগ্রি কোর্সকে তিন বছর মেয়াদি করার সুপারিশ। একই সময়ে আওয়ামী লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর গ্রেপ্তারও জনমনে বিক্ষোভ তৈরি করে।
বিগত বছরগুলোতে ড. মোহাম্মদ হাননানের ছাত্র আন্দোলন নিয়ে লেখা বই থেকে বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন সম্পর্কে নানা তথ্য তুলে ধরেছি। এ প্রসঙ্গে বেশির ভাগ লেখকের লেখায় শিক্ষা আন্দোলনের শেষ ধাপে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিচালিত ছাত্র আন্দোলনের কথাই উঠে এসেছে; আন্দোলনের উৎসস্থল কলেজ, এমনকি স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনের ব্যাপকতা ও তাদের অংশগ্রহণ নিয়ে তেমন কথা আসেনি। ঢাকার আজিমপুর গার্লস স্কুলের ছাত্রীরা দেয়াল টপকে কীভাবে মিছিলে যোগ দেয়, সে ঘটনার উল্লেখও সেখানে নেই। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী। এ প্রসঙ্গ নিয়ে তিনি একাধিক বই লিখেছেন। তাঁর বই থেকে আন্দোলনটি সম্পর্কে কিছু তথ্য তুলে ধরা যায়।
তিনি লিখেছেন– ‘সে সময় সত্যিকার অর্থে জগন্নাথ কলেজ সমগ্র বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলনের জন্য প্রধান ঘাঁটি হিসাবে বিবেচিত হতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরেই অধিকাংশ আন্দোলনের সূচনা ঘটত সেখান থেকেই। কিন্তু এর ব্যতিক্রম ঘটিয়ে শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে বাষট্টির ঐতিহাসিক ছাত্র আন্দোলন সূচনা হয়েছিল আমাদের ঢাকা কলেজ থেকে। ঢাকা কলেজের ছাত্র হিসাবে শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে আমরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে কলেজ বর্জন করে ধর্মঘট ও রাস্তায় বিক্ষোভ মিছিল বের করি। পরে আমাদের দেখাদেখি অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অচিরেই শিক্ষা কমিশনবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়।’
‘ডিগ্রির ছাত্রদের আন্দোলন করার পেছনে মুখ্য দাবি ছিল, ডিগ্রি কোর্সকে তিন বছরের জায়গায় দুই বছর করতে হবে। প্রথম দিকে আন্দোলনের মূলশক্তি ছিল তারাই। তবে আমরা ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্ররা ডিগ্রি কোর্সের ব্যাপারটি ছাড়াও ইংরেজিকে ছাত্রদের জন্য অতিরিক্ত বোঝা মনে না করেই আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়েছিলাম। ঢাকার শিক্ষা কমিশনবিরোধী এ আন্দোলনের পেছনে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন ঢাকা কলেজ, জগন্নাথ কলেজ, ইডেন কলেজ ও কায়েদে আজম (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী) কলেজের ছাত্রছাত্রীরা।’
একসময় আমাদের দেশে শিক্ষার উন্নয়ন বলতে দালানকোঠার উন্নয়ন বোঝানো হতো। স্কুলে কিংবা গৃহে অথবা উভয় স্থানে শিক্ষার্থীর লেখাপড়ায় প্রতিকূল পরিবেশ এবং নিরানন্দ পাঠদান পদ্ধতি যেমন গ্রাহ্যের মধ্যে আসেনি, পাঠদানকারী শিক্ষকের প্রাপ্য আর্থসামাজিক মর্যাদার বিষয়গুলোও ছিল বিবেচনার বাইরে। দুঃখজনকভাবে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক উভয় ক্ষেত্রে অবস্থার কিছু পরিবর্তন হলেও এখনও অপূরিত প্রত্যাশার তালিকা কম দীর্ঘ নয়।
উল্লেখ্য, সমন্বিত শিক্ষা আইন, স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠন, পিএসসির আদলে শিক্ষক নিয়োগ ব্যবস্থা চালুর মতো প্রত্যাশা এখনও বাস্তবায়নের অপেক্ষায় রয়েছে। সেই সঙ্গে সংবিধান ও জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ অনুসারে সরকারি-বেসরকারি, গ্রাম-শহর, নারী-পুরুষ বৈষম্যের প্রাসঙ্গিকতায় শিক্ষায় করণীয় রয়েছে উল্লেখ করার মতো।
ব্যক্তিগতভাবে শেখ হাসিনার নির্দেশনায় তাঁর সরকারের উদ্যোগে শিক্ষকদের প্রস্তাবমতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পাঠ্যসূচিতে উল্লেখযোগ্যভাবে স্থান করে নিতে পারলেও মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর ছোবল থেকে মুক্তচিন্তা ও মুক্তবুদ্ধির সুরক্ষায় বাধা কোনো অংশে কম নয়। সে জন্য বেশি করে চোখ-কান খোলা রাখার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
শিক্ষায় নারীর অগ্রযাত্রা নজর কাড়লেও কর্মমুখী শিক্ষা ও শিক্ষার উচ্চস্তরে নারীর অগ্রযাত্রা নিশ্চিতকরণে অনেক কিছু করার আছে। এ কথা স্পষ্ট, মুক্তিযুদ্ধের পথ ধরে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক পরিবর্তন ও অর্জন সম্ভব হয়েছে। তবে শিক্ষা ব্যবস্থাপনা, শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উন্নয়ন এবং শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো অপরিহার্য। অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থা-ওইসিডি পরিচালিত পিসা (প্রোগ্রাম ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসেসমেন্ট) কর্মসূচির সঙ্গে বাংলাদেশে শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন ব্যবস্থা যুক্ত করা আবশ্যক।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যে চারটি মোটাদাগের ঘটনা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে তা হলো– বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও সত্তরের সাধারণ নির্বাচন। বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলনে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের কারণে ঘটনাবহুল দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়, যখন পরাধীন দেশে আমরা একটি গণমুখী শিক্ষানীতির দাবিতে আন্দোলন করেছিলাম। আমার বিশ্বাস, শিক্ষাকে ভিত্তি করে সামনে এগিয়ে চলার অপরিহার্যতায় শিক্ষা দিবসের চেতনা, প্রেরণা ও নির্দেশনা দীর্ঘদিন আমাদের পথচলায় আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করবে।
বিগত বছরগুলোতে শিক্ষা দিবসের আলোচনায় শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ, ইতিহাসবিদ, সাংবাদিক, পেশাজীবী সবাই দিনটিকে ‘জাতীয় শিক্ষা দিবস’ ঘোষণার দাবি জানান। আজ শিক্ষা দিবসের ৬১ বছর পূর্তি উপলক্ষে দেশের শিক্ষকসমাজ ও শিক্ষাকর্মীরাও একইভাবে এর সঙ্গে অভিন্ন মত ও পূর্ণ একাত্মতা প্রকাশ করবেন। সরকার এ প্রত্যাশা পূরণ করলে তা হবে বিজ্ঞতার পরিচায়ক ও একটি দূরদর্শী সিদ্ধান্ত। জীবনের পড়ন্ত বেলায় তারই প্রতীক্ষায় থাকলাম।
অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ: ’৬২ শিক্ষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ প্রণয়ন কমিটির সদস্য
মন্তব্য করুন