ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পার্লামেন্টের প্রস্তাব শুধু মানবাধিকারের নিরিখে দেখলেই হবে না, এর সঙ্গে রাজনীতি ও অর্থনীতি উভয়ই জড়িত। এ প্রস্তাবে মানবাধিকার ছাড়াও বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও নির্বাচন প্রসঙ্গ যেমন এসেছে, তেমনি বাংলাদেশের জন্য ইইউর অবাধ বাজার সুবিধা ‘এভরিথিং বাট আর্মস’ (ইবিএ) অব্যাহত রাখা যৌক্তিক কিনা, সেই প্রশ্নও স্পষ্টভাবে তোলা হয়েছে। মনে রাখতে হবে ইবিএর অধীনে বাংলাদেশকে বাণিজ্যের যে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়, তা শর্তহীন সুবিধা নয়। মূলত যেসব দেশ মানবাধিকার, সুশাসন, দুর্নীতি দমন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, নাগরিক অধিকার ইত্যাদির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে এবং মেনে চলে তাদেরই কেবল এ সুবিধা দেওয়া হয়। এর আগে শ্রীলঙ্কা, কম্বোডিয়া ও পাকিস্তানের এমন সুবিধা ওই শর্তাবলির ব্যত্যয় ঘটার কারণে বাতিল করা হয়।

 বাংলাদেশের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টের প্রস্তাব খুবই জোরালো সতর্কসংকেত। রাজনীতি একদিকে, অর্থনীতি একদিকে– এই দৃষ্টিভঙ্গিতে একে দেখার সুযোগ নেই। শুধু রাজনীতি কিংবা শুধু অর্থনীতি বলতে কিছু নেই; সবই রাজনৈতিক অর্থনীতি। রাজনৈতিক অর্থনীতির বিষয় এমন যে, একটি দেশের আন্তর্জাতিক বা দ্বিপক্ষীয় বিষয়ে যেমন নানা অঙ্গীকার থাকবে, তেমনি তার নিজের দেশের নাগরিকের প্রতি সুদৃষ্টি দেওয়া বা সুবিচার করতে হবে। তা না হলে তার আন্তর্জাতিক প্রভাব পড়তে বাধ্য। সেজন্যই ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থনৈতিক যে সুবিধা আমরা পাচ্ছি, তা বাতিলের প্রশ্ন আসছে। এ সুবিধা তারা যে কোনো সময় প্রত্যাহার করতে পারে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের ইবিএ সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে আরও কিছু দেখা হয়। এটা শুরু হয় সাধারণত শ্রমিকের অধিকার দেখার ব্যাপারে; নারীর অধিকারের বিষয় আছে এবং এর সঙ্গে পরিবেশগত দূষণ সম্পর্কিত বিষয়ও রয়েছে। তবে শেষ বিচারে গিয়ে সাধারণ মানবাধিকার, সুশাসন ও নাগরিক অধিকারের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। সেজন্যই ইউরোপীয় ইউনিয়নের শক্ত ভাষার প্রস্তাবকে আমলে নেওয়া জরুরি। যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে যারা এর অংশীদার– একদিকে চাকরিসূত্রে শ্রমিকরা আছেন এবং অন্যদিকে উদ্যোক্তারা যেমন রয়েছেন, তেমনি সরকারও ইউরোপের বাজারে রপ্তানির মাধ্যমে লাভের অংশীদার। উদ্যোগ মানে হলো, যেসব অভিযোগের ভিত্তিতে হুমকি আসছে সে অভিযোগগুলো যেন আমরা যত্নের সঙ্গে ইতিবাচকভাবে সমাধান করি।

মনে রাখতে হবে মানবাধিকার থেকে যেমন বাণিজ্য প্রভাবিত হচ্ছে, তেমনি এটি বৈদেশিক সাহায্য ও বিনিয়োগকেও আক্রান্ত করতে পারে। এটি অনেকটা ছোঁয়াচের মতো।

বাংলাদেশের রপ্তানির জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজার সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বাংলাদেশের মোট পণ্যের ৪৮ শতাংশই যায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে। সেখানকার প্রায় দুই ডজন দেশে প্রতি বছর প্রায় আড়াই হাজার কোটি ডলার রপ্তানি করে বাংলাদেশ। এমনকি বর্তমানে বাংলাদেশের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের ইবিএ সুবিধার পরিসর আরও বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলমান। অথচ বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ইবিএ সুবিধা অব্যাহত রাখা উচিত কিনা, তা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যরা। যেখানে ইবিএ কর্মসূচির মাধ্যমেই জিএসপি সুবিধা দেওয়া হয়, সেখানে এ সুবিধা তারা প্রত্যাহার করলে তা অর্থনৈতিকভাবে কতটা ঝুঁকির কারণ হবে তা বলাবাহুল্য। একই সঙ্গে আমরা যদি ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টি দিই, জিএসপি প্লাস আমাদের সামনে। বাংলাদেশকে জিএসপি প্লাসের জন্য যোগ্যতা অর্জন করতে হবে ২০২৯ সালের পর শুল্কমুক্ত সুবিধা অব্যাহত রাখার জন্য। সেটা অবশ্য এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পর। তবে তাদের এই বিশেষ ধরনের অনুকম্পা আমাদের পেতে হবে। আলোচ্য ঘটনায় তাদের সহৃদয়তার জায়গাটা যে সংকুচিত হচ্ছে তা স্পষ্ট। সেজন্য এখন আমরা যেটা পাচ্ছি সেটা রক্ষা করতে তৎপর হতে হবে।

এটাও মনে রাখতে হবে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টে সম্প্রতি যে প্রস্তাব পাস হলো, তা যে কেবল সাম্প্রতিক দু’জন মানবাধিকার কর্মীর কারাদণ্ডের ঘটনায় ঘটেছে এমনটি নয়। এটা সামগ্রিকভাবে আমাদের জাতীয় পরিস্থিতির কারণেই হয়েছে এবং এর সঙ্গে আগামী নির্বাচনকেও বাদ দেওয়া যাবে না।

তবে এর সরাসরি প্রভাব পড়বে রপ্তানিকারক গোষ্ঠীর ওপর। এখন যদি ব্যবসায়ীরা বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে রাজনীতিকে জড়ায় না, সেটা আসলে ভুল। কারণ শ্রীলঙ্কায় মানবাধিকার খণ্ডিত হওয়ার পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের এই সুবিধা বন্ধ করে দিয়েছিল। কম্বোডিয়ায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় নির্বাচনের আগে ২০-২৫ শতাংশ সুবিধা বন্ধ করে দেওয়া হয়। একইভাবে পাকিস্তানকে দেওয়া সুবিধাও ইইউ প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। আফ্রিকার অনেক দেশ থেকেও এ ধরনের সুবিধা প্রত্যাহার করা হয়।

সেজন্য বিষয়টি হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। আগেও আমরা বিদেশি নানা উদ্বেগ দেখেছি। এবারের প্রস্তাবে একেবারে ‘অ্যাকশন’-এর কথা বলা হচ্ছে। আমাদের মনে আছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন সময়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। সে উদ্বেগগুলো আমলে নেওয়া হয়নি বলেই দেখা গেল একসময় তারা নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দেয়। সেজন্যই এসব ঘটনায় উদ্যোগটা জরুরি। তা না হলে এমন পদক্ষেপ আসতে পারে, যা হঠাৎ আমাদের ওপর বজ্রপাতের মতো পড়তে পারে। এটাও বলেছি, শুধু একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টে এমন প্রস্তাব আসেনি। এটা আমাদের ধারাবাহিক কর্মতৎপরতার ফল। তারা বিষয়গুলো সংসদে আলোচনা করেছে এবং এরপর নির্বাহী বিভাগ তাদের প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে।

আমাদের করণীয় বিষয়টি ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টে উপস্থাপিত প্রস্তাবেই রয়েছে। তারা নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার চর্চার বিষয়ে আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুসরণের আহ্বান জানিয়েছে। পাশাপাশি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, মানবাধিকারকর্মী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের কাজের নিরাপদ ও অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করার বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে। এমনকি সরকারকে ২০২৪ সালের নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক করার আহ্বানও তাদের প্রস্তাবে অন্তর্ভুক্ত।     

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: সম্মাননীয় ফেলো, সিপিডি