
মেডিকেলে ২০০১ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত ১৬ বছরে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে ১০ বার। দৈনিক আজাদী লিখেছিল, ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রে ভর্তি হয়েছিলেন কয়েক হাজার জন। এ বছর সিআইডিও স্বীকার করেছে, ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রে শত শত শিক্ষার্থী মেডিকেলে ভর্তি হয়েছেন। এই হাজার বা শত শত জনের বেশির ভাগই এখন নিয়মিত চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত। অবস্থাটি ভীতিকর। এ বছরের ৩০ জুলাই থেকে ১৩ সেপ্টেম্বর সময়ে মেডিকেলে প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের ২৪ জন গ্রেপ্তার হয়েছে। তাদের আয়-উপার্জন কয়েকশ কোটি টাকা। জানা গেছে, চক্রগুলো প্রশিক্ষিত ও সংঘবদ্ধ। দেশব্যাপী তাদের নেটওয়ার্ক।
সম্প্রতি গ্রেপ্তার হওয়া চক্রের সর্বশেষ আটজনের একজন ঢাকার নামকরা স্কুলের শিক্ষিকা। অন্য সাতজন নামিদামি হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসক। গলায় স্টেথোস্কোপ আর সাদা অ্যাপ্রন পরা সাতজন সৌম্যদর্শন মানুষের কথা মনে এলো। মনছবিতে ভেসে উঠল অসংখ্য পেশাদার খুনির চেহারা। মনে বারবার প্রশ্ন জাগছিল– এসব চিকিৎসককে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা-পয়সা দেওয়া হলে তারা তাদের চিকিৎসাধীন রোগীদের ওষুধের নামে সায়ানাইড বা বিষ প্রয়োগ করে মেরে ফেলতে পারেন কিনা? মন বলছিল, হ্যাঁ; পারবেন। শিক্ষা-নৈতিকতাশূন্য হয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো চিকিৎসক-শিক্ষক প্রশ্নপত্র ফাঁসে নামবেন না। শিক্ষা-নৈতিকতাশূন্য হয়ে গেলে বিজ্ঞানের সজ্ঞান ব্যবহার দিয়ে সন্তর্পণে খুন করা তেমন কঠিন কোনো কাজ তো নয়; বরং প্রশ্নপত্র ফাঁসেই ঝুঁকি বেশি।
আগে একজন চিকিৎসক বরখাস্ত হয়েছিলেন। তিনি চিকিৎসকদের অত্যন্ত ক্ষমতাধর সংগঠন ক্ষমতাসীনদের পৃষ্ঠপোষকতাধন্য ‘স্বাধীনতা চিকিৎসা পরিষদ’-এর সদস্য ছিলেন। অপরাধের সঙ্গে ক্ষমতার সংযোগ থাকবেই। কিন্তু শিক্ষা-নৈতিকতা ও চিকিৎসা-নৈতিকতাকে একই চোখে দেখা বা একই ছকে ফেলা বিপজ্জনক।
রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ ব্যাংকের প্রতিযোগিতামূলক নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখতেন বুয়েট শিক্ষক। গত বছরের এক তদন্তে দেখা গেছে, প্রশ্নপত্র ফাঁস করে দুই ব্যাংক কর্মকর্তাসহ ১৫ জন পেয়েছিলেন ২৫ কোটি টাকা। বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রতিরক্ষা হিসাব নিরীক্ষক দপ্তরের ‘অডিটর’ পদের মতো অত্যন্ত সংবেদনশীল পদের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের অন্যতম হয়ে উঠেছিলেন। বিমানের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ক্রীড়নক ছিলেন বিমানেরই একজন উপমহাব্যবস্থাপক। বিমানের প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্র এতটাই বেপরোয়া; বিজ্ঞাপন ছাড়তেও দ্বিধান্বিত নয়। খবরের শিরোনাম হয়– ‘ফেসবুকে প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রতারণা, আছেন দুই প্রকৌশলীও।’ গত বছর দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের এসএসসির ছয়টি বিষয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত পাওয়া গেছে ছয়জন স্কুলশিক্ষককে। নার্সিং কলেজের প্রশ্নপত্র ফাঁসের হোতা ছিলেন কলেজেরই সাবেক অধ্যক্ষ।
শিক্ষা-নৈতিকতা নিয়ে এখন কেউ আর কথা বলে না। ওসব ডাল-ভাত, গা সওয়া; যেন এমনটাই হওয়ার কথা। এই নষ্টের দেশে মা-বাবা সন্তানের জন্য নকল সরবরাহ করতে যায়। ফাঁস হওয়া প্রশ্ন কিনে আনে আট-দশ লাখ টাকায়। সামান্য রুচিতেও বাধে না তাদের! ফাঁস করা আর কেনা প্রশ্নে সন্তান বুয়েট-মেডিকেলে স্থান করে নেয়। বাবা-মা বগল বাজায়। একে ধরে ওকে ধরে দাওয়াত দিয়ে লোক ডাকিয়ে জানান দেয়– ‘জানো, আমার বেবিটা মেডিকেলে চান্স পেয়েছে।’ সন্তানদের ইঙ্গিত দিয়ে দেয়– খরচ করা টাকা খুব তাড়াতাড়ি তুলে আনতে হবে কিন্তু। সন্তানদেরও এরাদা-ওয়াদা অনেকটা সে রকমই। বিয়ের বাজারে তারা রানী-রাজা হয়। পাস করে বেরোনোর আগে-পরে পকেট তাজা হয়। তাদের সনদের কোথাও লেখা থাকে না– চৌর্যকর্মের ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার। আমাদের সন্দেহ করা দরকার, তারপর যত প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়, সম্ভবত সব বৈতরণীই তারা কোনো না কোনো চৌর্য উপায়েই পার হয়।
শিক্ষকরাই প্রশ্নপত্র ফাঁস ও কেনাবেচার কাজে জড়িত জেনে অনুভূতি হয়েছিল– ‘ধরণী, দ্বিধা হও।’ যখন দেখলাম, যেনতেন কোচিং সেন্টারে ক্লাস নিয়ে শিক্ষক পরিচিতি জোটানো মানুষই নয়; নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় ও হাই স্কুলের শিক্ষকরাও জড়িত; বুঝেছিলাম, ঘুণপোকা সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে। শিক্ষার কাঠামোকে ঝাঁঝরা করে ফেলেছে ইতোমধ্যে।
সমাজবিজ্ঞান ও অপরাধবিজ্ঞানে ‘হোয়াইট কলার ক্রাইম’ বা ‘শ্বেত পোশাকের অপরাধ’ বলে একটি ধারণা আছে। এই জাতের অপরাধী সম্মানিত, শিক্ষিত, সজ্জন, আপাত ভদ্রলোক এবং নৈতিকতার বুলি কপচাতেও পারদর্শী। আদতে কুশলী অপরাধী। বাংলাদেশ এ মুহূর্তে ‘শ্বেত পোশাকের অপরাধীর’ স্বর্গরাজ্য। তাদের অপরাধ এন্তার। ব্যাংক লুট করে ফেলেন। শেয়ারবাজার থেকে তছরুপ করেন লাখ কোটি টাকা। ক্ষমতার দাপটে দিনকে রাত করেন। আইন-বিচার ব্যবস্থা– সব কিনে নেন। হেন বড় বড় অপরাধ নেই, যা করেন না। কিন্তু সেগুলো খোলা চোখে দেখা যায় না। তাই তারা ভিআইপি-সিআইপি হিসেবে রাষ্ট্রীয় প্রটোকল পান। এদিকে ১০ হাজার টাকা ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে না পারার অপরাধে কৃষক সার্টিফিকেট মামলায় নিঃস্ব হন। কোমরে দড়ি বেঁধে রাস্তায় হাঁটিয়ে তাদের তোলা হয় আদালতে। ভাত চুরি করা ছিঁচকে চোর, সিঁধেল চোর বা ছিনতাইকারীকে কত বড় অপরাধীই না মনে হয়! কারণ তাদের অপরাধ দেখা যায়; ‘শ্বেত পোশাকের অপরাধ’ দেখার জো নেই। প্রশ্নপত্র ফাঁস শুধু ‘শ্বেত পোশাকের অপরাধ’ই নয়; একটি ভয়াবহ সামাজিক দুর্যোগও বটে!
অপরাধবিজ্ঞানমতে, ‘শ্বেত পোশাকের অপরাধ’ সবচেয়ে বেশি হয় বীমা, অর্থবাজার (স্টক মার্কেট ও ব্যাংকিং সেক্টরে) ও ব্যবসায় এবং সবচেয়ে কম হয় শিক্ষাজগতে। দুনিয়াজুড়ে এমনটিই বাস্তবতা। কিন্তু গত কয়েক দশকে বেশ কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে, ভারতে শিক্ষা ও চিকিৎসায় ‘শ্বেত পোশাকের অপরাধ’ মহামারির আদলে বাড়ছে। বাংলাদেশে শিক্ষাক্ষেত্রে ‘শ্বেত পোশাকের অপরাধ’ বিষয়ে কোনো গবেষণাই নেই। আমরা সদ্য একটি গবেষণা প্রকল্প হাতে নিয়েছি। শুরুতেই অনুভব করছি, অপরাধটির ব্যাপকতা এতটাই, ছোটখাটো গবেষণার বদলে বিশ্বকোষ তৈরি করতে পারার মতো উপাদানে ভরপুর হয়ে পড়েছে শিক্ষা খাতটি। শিক্ষাজগৎ কলুষিত হয়ে পড়ার সবচেয়ে বড় কারণ এখন পর্যন্ত অপরাজনীতি ও ক্ষমতার রাজনীতির কুপ্রভাব। কিন্তু এটুকু বললেই বিষয়টি বুঝতে পারা কঠিন।
শিক্ষকতা পেশায় আছি কয়েক দশক। তাই শিক্ষাজগৎকে খুব কাছ থেকেই দেখা। এই মহৎ পেশাটিও যে সীমাহীন স্খলনে বিধ্বস্ত-বিপর্যস্ত– সত্যটি জোরগলায় বলার সময় হয়েছে। হাই স্কুল ও কলেজের ছাত্রত্বকালে যখন দেখতাম, বিজ্ঞান শিক্ষকদের কাছে প্রাইভেট না পড়লে বিজ্ঞানের ছাত্ররা ব্যবহারিক পরীক্ষায় নম্বরবঞ্চিত হতো, তখনই প্রমাদ গুনেছিলাম। ভাগ্যিস, সে সময় অনেক শিক্ষা সংস্কার আন্দোলন ছিল। ছাত্র সংগঠনগুলো অসচ্ছল ছাত্রছাত্রীদের জন্য কোচিং, ভর্তি প্রস্তুতিতে সহায়তা, পাঠচক্রসহ নানা রকম শিক্ষাসহায়ক কর্মকাণ্ড চালাত। স্পষ্ট মনে আছে, বামপন্থি ছাত্র সংগঠনগুলোর ‘শিক্ষা সুযোগ নয়, অধিকার’ আন্দোলন আকৃষ্ট করত অসচ্ছল ছাত্রছাত্রীদের। ভাষ্যটিতে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের মনের কথাটিই প্রকাশ পেত। কোচিং সেন্টার ব্যবসা ও বিজ্ঞান শিক্ষকদের টিউশনি ব্যবসা চার দশক আগে এতটা রমরমা বা খুল্লামখোলা ছিল না। আলগা আয়-রোজগার যা করার, শিক্ষকরা অনেকটা রয়েসয়ে করতেন। ভয়-ডর ছিল। বিবেকের দংশনও ছিল যথেষ্ট। শিক্ষা-নৈতিকতার জায়গাটি তেমন কলুষিত ছিল না। দু-একটি বিচ্ছিন্ন ব্যতিক্রম বাদে শিক্ষকরা সাধারণত ক্লাস ফাঁকি দিতেন না; ক্লাসে নিজের কোচিং সেন্টার বা টিউশনির মার্কেটিং করতেন না। দরিদ্র ছাত্র অনেককেই বিনা খরচে বা স্বল্প খরচে ক্লাসবহির্ভূত কোচিং সেবা দিতেন। সত্য-মিথ্যা নিশ্চিত নই; সম্প্রতি জানলাম, শিক্ষকরাও ছাত্রদের কোনো নির্দিষ্ট কোচিং সেন্টারে যেতে অনেকটা বাধ্য করেন। বিনিময়ে কমিশন উপার্জন করেন। চিকিৎসকরা যেভাবে ডায়াগনস্টিক ল্যাবগুলোতে রোগীদের অনাবশ্যক টেস্টের জন্য পাঠিয়ে কমিশন আয় করেন সেভাবে।
চিত্রটি স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত কোথাও শিক্ষা-নৈতিকতার পাঠের ব্যবস্থা নেই। শিক্ষার্থীদের জন্য তো নেই-ই; শিক্ষকদের জন্যও নেই। আইরিশ শিক্ষাবিদ, পণ্ডিত ও শিক্ষা-নৈতিকতা বিশেষজ্ঞ ক্লাইভ স্টেইপল লিউইসের সাবধানবাণী আমলে নেওয়ার এখনই সময়। তিনি স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, শিক্ষা-নৈতিকতাই হবে শিক্ষাব্যবস্থার সূচনা বাক্য। নৈতিকতাবিযুক্ত শিক্ষা কাজের বটে, তবে দুর্দান্ত চতুর শয়তান তৈরিই তার কাজ। শিক্ষা সংস্কার শুরু হোক। ‘শিক্ষা-নৈতিকতা’ই হয়ে উঠুক সংস্কারের সূচনা বাক্য।
হেলাল মহিউদ্দীন: অধ্যাপক, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ, পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড সোশিওলজি; নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন