- মতামত
- ব্রিটিশদের উচিত উপনিবেশগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া
ইতিহাসের দায়
ব্রিটিশদের উচিত উপনিবেশগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া

মানব সভ্যতার ক্রমাগত রূপান্তরের পর সমাজ গঠিত হতে অসংখ্য উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে মানুষকে। উত্থান-পতনের সেই ঘটনাগুলোই এখন পরিণত হয়েছে ইতিহাসে। আমরা ইতিহাসের অন্ধকার ভাগ্যকে হয়তো ক্ষমা করতে পারি, কিন্তু অন্ধকার স্মৃতিকে চাইলেই ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। বিশেষ করে যখন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল, তখন তারা যেভাবেই হোক আধিপত্য বিস্তারের পাশাপাশি নিজেদের উচ্চ আসনের মানুষ (হোয়াইট সুপ্রিমেসি) হিসেবে দাবি করেছিল। ব্রিটিশরা সেই সময়ে তাদের প্রভাব প্রয়োগ করে উপনিবেশগুলোর প্রচুর সম্পদ লুণ্ঠন করে। তারা শিক্ষা ও যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আধুনিক করার বেশ কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছিল বটে, সেগুলো মূলত তাদের সুবিধার কথা চিন্তা করেই। কারণ, যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না থাকায় তারা সঠিকভাবে শাসনকাজ পরিচালনা করতে পারছিল না। পাশাপাশি উপনিবেশগুলোর মানুষ তাদের ভাষায় (ইংরেজি) কথা বলতে না পারায় ব্রিটিশরা ব্যবসা-বাণিজ্য করতে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছিল।
একবিংশ শতাব্দীতে একটি ক্রমবর্ধমান আন্দোলন দাবি করে যে, ব্রিটেনের উচিত তার ঔপনিবেশিক অতীতকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং এর ফলে যে ক্ষতি হয়েছে, তার দায়ভার বহন করা। ঔপনিবেশিকতার অন্ধকার ইতিহাস উপনিবেশগুলোর আকাশে এখনও এক প্রকার ঘৃণার প্রতিচ্ছবির মতো ছায়া হয়ে আছে। শুধু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সাবেক উপনিবেশের প্রতিশোধই মানব সভ্যতা থেকে সেই অন্ধকার ছায়া দূর করতে পারে। প্রতিশোধের ভাষা অবশ্যই সেই সময়ের মতো যুদ্ধ-বিদ্রোহ কিংবা রক্তের ভাষা হতে পারে না। তাহলে কীভাবে হতে পারে সেই প্রতিশোধ?
অক্সফোর্ড ইউনিয়নের একটি বিখ্যাত বিতর্কে ড. শশী থারুর বলেছিলেন, ‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য কখনও অস্ত যায় না; এমনকি ঈশ্বরও অন্ধকারে ইংরেজকে বিশ্বাস করতে পারেন না।’ অর্থাৎ ব্রিটিশদের অত্যাচার ও লুটপাটের ভয়াবহতা রাতের অন্ধকারকেও হার মানাত। ইতিহাসও তা-ই বলে। ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণে প্রায় ২০০ বছর অতিবাহিত হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে আমাদের আধুনিক বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারত। ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষদের ওপর হওয়া সেই অত্যাচার-নির্যাতনের ইতিহাস পড়লে এখনও চোখে পানি আসে। সেই সময়ে ব্রিটেন তার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য বজায় রেখে বিপুল পরিমাণ সম্পদ আহরণ করে এবং অর্থনৈতিক শোষণ আরোপ করে। এর কিছু উদাহরণ তুলে ধরা যেতে পারে।
ভারতবর্ষের মাটিতে ব্রিটিশরা কৃষকদের ‘নারকোটিক’ বা ‘মাদকদ্রব্য’ উৎপাদনে বাধ্য করেছিল। তখনকার সময়ে ব্রিটিশরা এ অঞ্চলকে বলত ‘নারকোটিক হাব’। এমনকি তারা উৎপাদিত মাদকদ্রব্যকে ‘ব্ল্যাক গোল্ড অব ইন্ডিয়া’ নামে সম্বোধন করত। একই জমিতে পরপর কয়েকবার নারকোটিক উৎপাদন করলে সেই জমি ফসল উৎপাদনের অনুপযোগী হয়ে যাবে জেনেও ব্রিটিশদের নির্যাতনের মুখে কৃষকরা নারকোটিক চাষাবাদ করতে বাধ্য হতো। ফলে ১৭৭০ সালে খাদ্য সংকট ও ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এতে প্রায় ১০ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয়। ব্রিটিশরা তখনও থামেনি। কৃষকরা যখন মাটির উর্বরা শক্তি নষ্ট হয়ে যাওয়ার ব্যাপার বুঝতে পেরেছিল, তখন তারা নারকোটিক চাষাবাদ বন্ধ করে দেয়। ব্রিটিশরা তখন তাদের দেওয়া তথাকথিত ঋণের অংশ (কৃষকরা মাদকদ্রব্য চাষাবাদে খরচ জোগাতে পারছিল না বলে তাদের অর্থ প্রদান করে ব্রিটিশরা। বলা হয়, এই অর্থ তোমরা নিজেদের জন্য খরচ কর। পরিবর্তে জমিতে মাদকদ্রব্য চাষ কর।) ফেরত চায়। পরবর্তী সময়ে কৃষকরা সেই অর্থ ফেরত দিতে না পারায় তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। ব্রিটিশদের এ কার্যক্রমের ফলে সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, বৈচিত্র্যময় মানুষ এবং এ অঞ্চলে সমৃদ্ধ ব্যবসা সবই গুরুতর ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এমনকি এসব ঘটনার দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব আজও এই দেশগুলোকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করে।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্য প্রায় ২০০ বছর উপনিবেশের অধিবাসীদের যন্ত্রণা দিয়েছে, শোষণ করেছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের তখনকার দখলদাররা উপনিবেশগুলোতে লুট করেছে; মহাদেশের অর্থনীতিকে উড়িয়ে দিয়েছে; জোরপূর্বক শ্রম দিতে বাধ্য করেছে এবং চর্চা করেছে অসম বাণিজ্যের। নিজস্ব ব্যবসা পরিচালনার জন্য সে সময়ের বাজারে বাঙালিকে লাইসেন্স পর্যন্ত দেওয়া হতো না। প্রমাণ হিসেবে আমরা ক্লার্কের লেখা ‘The British Empire: A History in Ten Maps (2019)’ বই থেকে সেই ইতিহাস জানতে পারি। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর উল্লেখ করেছেন, ব্রিটিশরা ভারতে তাদের দুই শতাব্দীর শাসনামলে ৪৫ ট্রিলিয়ন ডলারের সম্পদ নিয়ে গেছে, যা আমরা বিশ্বের সেই সময়ের অর্থনীতির অর্ধেক হিসাবে বিবেচনা করতে পারি।
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে হেরে যাওয়ার পরের ইতিহাস সবারই জানা। বাংলার মানুষের কাছে ফরাসিদের সমর্থন করা ছাড়া সে সময় আর কোনো উপায় ছিল না। বাংলা তখন ব্রিটিশ প্রশাসনের অধীনে প্রথম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অংশ হয়ে ওঠে। ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ এবং সামাজিক অস্থিরতা এ অঞ্চলের মানুষের কাছে ছিল নিয়মিত অভিজ্ঞতার মতো। শেষ পর্যন্ত ১৯৪৩ সালে বঙ্গীয় দুর্ভিক্ষের ফলে লক্ষাধিক মানুষ মারা যায়, যা ব্রিটিশ নীতি এবং অসতর্কতার কারণে আরও খারাপ হয়েছিল। ‘The Bengal Famine of 1943: A Man-made Holocaust?’ শিরোনামে এশিয়ান স্টাডিজের একটি জার্নালে বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন স্পষ্টভাবে সেসব কথা তুলে ধরেছিলেন।
এই ঐতিহাসিক অবিচারের প্রতিকার হিসেবে ‘ক্ষতিপূরণ’ সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম হতে পারে, যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, দারিদ্র্য বিমোচন এবং অবকাঠামো ও শিক্ষা কার্যক্রমকে এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ দিতে পারে। কিন্তু স্বাভাবিকভাবে চিন্তা করলে এই প্রেক্ষাপটে যে প্রধান ইস্যুটি দেখা দেবে তা হলো, ব্রিটিশরা তার সাবেক উপনিবেশগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেবে– এটা সম্ভব কিনা!
‘দ্য ফিউচার অব ক্যাপিটালিজম: ফেসিং দ্য নিউ অ্যাংজাইটিস’ বইয়ে পল কোলিয়ার উল্লেখ করেছেন, ব্রিটেনের মতো একটি দেশের জন্য ক্ষতিপূরণ প্রদান করা একটি কঠিন প্রচেষ্টা। কারণ এতে অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হবে। আমরা মনে করি, একটি সহজ এবং সুন্দর ‘দুঃখিত’ বলা একটি মহান ক্ষতিপূরণ হতে পারে। বাঙালি হিসেবে আমরা শান্তিপ্রিয় জাতি। এই মাটিতে যে রক্ত মিশে আছে, তাতে শোষণ হওয়ার রক্তই বেশি। প্রায় ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসনের সব অন্যায়ের জন্য তাদের অনুশোচনা করা উচিত। পাশাপাশি ১০০ বছর আগে যে ঘটনা ঘটেছিল তার জন্য ক্ষমা চাওয়া উচিত। ক্ষমা চাওয়ার মধ্যে মহত্ত্ব আছে। যদি তা না-ই হতো, তাহলে জার্মানির চ্যান্সেলর এবং কানাডার প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমা চাওয়াটা ‘বড় প্রতিশোধ’ হিসেবে বিশ্বের সামনে হাজির হতো না। ওয়ারশ ঘেটোতে জার্মান নাৎসিরা ইহুদিদের পোলিশ করার জন্য যা করেছিল, জার্মান চ্যান্সেলর ১৯৭০-এর দশকে তার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী হিসেবে হাঁটু গেড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন। একইভাবে কোমাগাটা মারু শিপিং বিপর্যয়ের প্রায় ১০২ বছর পর কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো তাঁর দেশের সংসদের হাউস অব কমন্সে ক্ষমা চেয়েছিলেন। সে ঘটনা আমরা দেখেছি।
এই ‘দুঃখিত’ শব্দটি কয়েক শতাব্দীর ব্রিটিশ কলঙ্ক কিছুটা হলেও মুছে দিতে পারে। ‘দুঃখিত’ শব্দটি বলতে ব্রিটিশদের আর্থিক খরচের প্রয়োজন হবে না। প্রয়োজন হবে মানবিকতাবোধের।
মো. তোসলিম ভূঁইয়া প্রান্তিক ও মো. খশরু আহসান: নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী
মন্তব্য করুন