ঢাকা বুধবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪

দশদিক

নারী নিয়ে হাওয়ার ওপর তাওয়া ভাজা কেন?

নারী নিয়ে হাওয়ার ওপর তাওয়া ভাজা কেন?

ফারুক ওয়াসিফ

প্রকাশ: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৮:০০

বিবিসির খবর, চাইলেও বাচ্চাকে একটা ডিম খাওয়াতে পারছেন না মা। অন্য মাধ্যমের খবর, সুদে টাকা ধার নিয়ে ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালে স্বামীর ডেঙ্গুর চিকিৎসা করাচ্ছেন স্ত্রী। এদের নিয়ে কথা বলতে পারতেন ক্রিকেটার তানজিম। এদের নিয়ে কথা বলতে পারতেন তানজিমের সমালোচকরাও। কিন্তু মানুষের জীবনের সমস্যার চাইতেও সাংস্কৃতিক বিতর্কে মনে হয় মধু বেশি।
ক্রিকেটার তানজিম সাকিবের পোস্টটি অনেক পুরোনো। রাজনীতি ও অর্থনীতি চরমভাবাপন্ন। ক’দিন বেশ গরমও গেল আবহাওয়া। এর মধ্যে পুরোনো একটি বাজে লেখাকে সামনে টেনে নিয়ে আসার বুদ্ধি যাঁরই হোক, তিনি হাওয়ার ওপর তাওয়া ভাজায় ওস্তাদ। তাঁর খুরে প্রণাম।

তারপরও কিছুই বদলায় নাই। ব্যাংক খাতে টাকা নাই, সেই খাতের টাকা এখন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ঘুরে বেড়াচ্ছে বলে খবর আসে। চলচ্চিত্রের নায়ক ওমর সানী আক্ষেপ করে বলেছেন, মানুষ কী কী খেতে পারবে তার লিস্ট রাষ্ট্র ধরিয়ে দিলে পারে। মঙ্গলবার সকালে ধানমন্ডি লেকের পাড়ে চা খেতে গিয়ে শুনি, সকালে হাঁটাহাঁটি গ্রুপে একদল মানুষ ডিমের দাম নিয়ে আলাপ পাড়ছেন। তাদের কারও একজনের বাসা থেকে আনা হয়েছে ভুনা খিচুড়ি আর গরুর গোস্তের দুটি পাতিল। মাংস খেতে খেতে তবুও তারা গরিব মানুষের ডিমের আলাপকে জায়গা দিয়েছেন। কিন্তু ফেসবুকে এসে দেখি ভিন্ন আলাপ। মানুষের জীবনযন্ত্রণা থেকে ওঠা ঢেউ ফেসবুকের নীল-সাদা জগতে কোনো তরঙ্গই তুলল না! সেখানে চলছে নারীবিষয়ক সাংস্কৃতিক বিতর্ক।

মধ্যবিত্তের সুবোধ মানুষদের জীবনে সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, চেতনা এসব গুরুতর আলাপের বিষয়। তাদের এসব মানায়ও। কারণ পেটে তো টান পড়ছে না। কঠিন অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক বাস্তবতা থেকে যেটা যত দূরে, সেটা তত মন কাড়ে কাদের? যাদের পেটে টান পড়ছে না, পিঠে লাঠির বাড়ি পড়ার ভয় নাই। তাদের কাছে নরনারীর প্রেম, কেলেঙ্কারি, গোপন কথা ফাঁস এইসব দারুণ মজাদার। কুলফি মালাইয়ের মতো যতক্ষণ পারা যায় ততক্ষণ এসব আলাপ থেকে রস বের করায় ব্যাপক আরাম তাদের। যে পাহাড় তারা সরাতে পারবে না, যে আগুন তারা নেভাতে পারবে না, যে অন্যায়ের প্রতিকারের সাহসও তাদের কম, তা নিয়ে কথা বলে কী লাভ? এটাই কি আজকের দর্শন?

যিনি বাজারে গিয়ে ইলিশের বদলে তেলাপিয়া কিনে ফিরলেন, অর্থনীতির উত্তাপটা তাঁর পরিবারে গিয়ে লাগল। যিনি যানজট, লোডশেডিং, জলাবদ্ধতা কিংবা দফায় দফায় বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানির দাম বাড়ায় পেরেশান, তাঁর চাইতে সরকারি সেবার হালহকিকত আর কে বেশি জানে? অথচ তাঁর ফেসবুক পেজে গেলে দেখা যাবে, তাঁর আলাপ ইলন মাস্ক কিংবা কোরীয় ব্যান্ড বিটিএস নিয়ে; তর্ক জুড়ে দিচ্ছেন ইউরোপীয় কোনো ফুটবল টিমের পক্ষে; রসাল গুলতানি করছেন মৌসুমী-ওমর সানি-জায়েদ খানের ত্রিভুজ সম্পর্কের গুজব নিয়ে। দেখেশুনে মনে পড়ছে ছোটবেলায় পড়া সেই মালয় দ্বীপের বোকা শিয়ালের ছড়াটার কথা– ‘ইল্যুশন অ্যান্ড রিয়ালিটি’ তথা বিভ্রম ও বাস্তবতার কথা: ‘মালয় দ্বীপে এক যে বোকা শেয়ালে/ লাগলে খিদে মুরগি এঁকে দেয়ালে/ আপন মনে চাটতে থাকে খেয়ালে।’


তাই ক্রিকেটার তানজিম এবং তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ একই দলে পড়েন। বলা যায়, তারা একই ফেসবুক মহল্লার বাসিন্দা। তাদের আলাপে বাস্তবতার ‘ব’টাও নাই। নাহলে নারী নিয়ে এরকম তালকানা আলাপ তোলার দরকার কেন হলো তাঁর? শেষ খবর অনুযায়ী ফেসবুকে নারীবিদ্বেষী কথাবার্তা বলবার জন্য তানজিম সাকিব ক্ষমা চেয়েছেন। তাঁর মা-ও একজন নারী। সুতরাং কোনো নারী তাঁর কথায় আঘাত পেলে তিনি দুঃখিত বলে জানিয়েছেন। বেশ, মানুষের হুঁশ ফেরানো উচিত, হুঁশ ফিরতে দেওয়া আরও উচিত। বিষয়টা এখানেই শেষ হয়ে গেলে ভালো হয়। এর জন্য তাঁর মতো দক্ষ খেলোয়াড়কে দল থেকে বাদ দেওয়া একেবারেই ঠিক হবে না। খেলাধুলা যিনি করেন তিনি শিক্ষক বা ইমাম বা রাজনৈতিক নেতা নন। খেলোয়াড়রা খেলার বাইরে আর যা বলবেন, সেসবকে একজন সাধারণ নাগরিকের আলাপ হিসেবেই দেখা উচিত। আর আধুনিক ক্রীড়াজগতে, ক্রীড়া বাণিজ্যে খেলোয়াড়দের রেসের ঘোড়া হিসেবেই দেখা হয়। যে ঘোড়া জিতবে তার লাথিও খাবে তার মনিব; যে ঘোড়া দৌড়াতে পারে না, তার দামি কথারও দাম নাই।

তানজিমরা যেসব ডলার খরচ করে বিদেশে খেলতে যান, তা আসে গার্মেন্টসের নারীদের শ্রম থেকে। ঢাকাসহ এর আশপাশের এলাকার মাদ্রাসাগুলোর ছাত্রছাত্রী আসলে পোশাকশিল্পের কর্মীদের সন্তান। অতএব ওই নারীরাই মাদ্রাসা শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকদের মধ্যে পড়েন। মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের মায়েদের প্রতি ওই শিক্ষার কর্ণধার ও অনুরাগীদের কিছুটা শ্রদ্ধাবোধ থাকা উচিত।

নারীদের কাজবাজ-চাকরি নিয়ে সমাজ-অর্থনীতির গবেষকদের ভিন্ন ভিন্ন ধারণা রয়েছে। দূর অতীতে তো বটেই, এখনও পৃথিবীতে অনেক মাতৃতান্ত্রিক সমাজ আছে, যেখানে মায়েরাই বড়। সেসব সমাজে জোর-জুলুম-অপরাধ অনেক কম। আবার কয়েক হাজার বছর ধরে পৃথিবীটা শাসন করছে পুরুষ শক্তি। তারা কি দাবি করতে পারবে যে তাদের রাজত্বে মানুষ সুখে আছে, প্রকৃতি ভালো আছে? আবার বর্তমান কালের পুরুষ শাসিত সমাজের নারী শাসকরাও যে উন্নত শাসন দিয়েছেন বা দিচ্ছেন, তা দাবি করারও জোরদার প্রমাণ হাতে নাই।

তবে গণহারে নারীরাও নিজস্ব উপার্জন করবেন, পুরুষের পাশাপাশি সংসারের হাল ধরবেন– পশ্চিমে এমন ধারণার চলন শুরু হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের কঠিন বাস্তবতায়। নারীরা টাকা আয় না করেও সংসার নামক প্রতিষ্ঠান চালিয়ে নিয়ে, পরের প্রজন্ম হিসেবে সন্তানদের তৈরি করে, ক্ষেত-খামার-কারখানা-অফিসের পেছন দিকটা, অর্থাৎ পরিবারকে সেবা দিয়ে সমাজটাকে যেভাবে টিকিয়ে রাখেন, তার অর্থকরী এবং সামাজিক মূল্যের কথাও অনেকে বলে থাকেন। স্বামী-স্ত্রী দু’জনই যেখানে উপার্জন করছেন, সেখানে খাদ্য, গৃহস্থালি এবং সন্তানাদি দেখাশোনার জন্য অন্য নরনারীর শ্রম কেনার দরকার হয়। কোনটা সেরা উপায় তা আমার জানা নাই। তবে যে ধরনের দেশে যে অর্থনীতিতে আমরা থাকি, সেখানে একজনের কামাইয়ে সংসার চলবে না অনেকেরই।

তাই জরুরি হলো, সমাজ-সংসার ও রাষ্ট্রে পুরুষ ও নারীর গুরুত্বকে সমান বলে স্বীকার করে নেওয়া। মানুষ হিসেবে দু’জনেরই দু’জনের ওপর অধিকার যেমন রয়েছে, তেমনি দু’জনেরই আলাদা করে রয়েছে কিছু মৌলিক অধিকার। নারী বা পুরুষের উভয়ের বেলাতেই চাকরি বা উপার্জন করা না-করা হওয়া উচিত যার যার প্রয়োজন ও পছন্দের ব্যাপার। স্বামী আয় করেন; স্ত্রী নিজের শ্রম, সময়, যত্ন দিয়ে দু’জনের পরিবারটাকে চালিয়ে যান– এটা সুন্দর। তেমনি কোনো স্বামী স্ত্রীর আয়ে চললে চলবেন, তাতে অসুবিধা কী? নারীদের আয়-উপার্জন নিয়ে মূল কথা হওয়া দরকার এই যে, আজকের পুঁজিবাদী বৈষম্যের যুগে একজনের আয়ে সংসার চলতে পারে কিনা। যদি না চলে তবে সমাধান কী? একই কথা জাতীয় অর্থনীতির বেলাতেও খাটে। নারী শ্রমের ব্যবহার ছাড়া প্রতিযোগিতামূলক দুনিয়ায় জাতীয় উৎপাদন বাড়ানো যাবে কিনা। তার পরের প্রশ্ন হলো, মেয়েদের কেন কম মজুরি দেওয়া হয়? কেন ভাইয়েরা তাদের বোনের প্রাপ্য ওয়ারিশ বুঝিয়ে দেন না? কেন নারীর ওপর নির্ভরশীল সংসার ও সমাজে পুরুষদের কেউ কেউ কর্মজীবী নারীদের অপছন্দ করেন এবং ভয়ও পান! যাবতীয় প্রশ্নের কাঠগড়ায় কেন নারীদেরই দাঁড় করানো হয়?

ফারুক ওয়াসিফ: লেখক এবং সমকালের পরিকল্পনা সম্পাদক
 faruk.wasif0@gmail.com

whatsapp follow image

আরও পড়ুন

×