ইসলাম ও সমাজ
মানুষের উপকারে রাসুলের (সা.) তাগিদ

মোহাম্মদ শাহ জালাল
প্রকাশ: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৮:০০
হিজরি রবিউল আউয়াল মাস চলমান। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কারণেই মাসটি আমাদের কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সর্বদাই আমাদের আল্লাহ-নির্দেশিত রাসুল (সা.)-এর দেখানো পথে চলতে হবে। এখানে তাঁর একটি সুন্নতের অবতারণা করছি। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘উত্তম মানুষ সে-ই, যে অন্য মানুষের উপকারে আসে।’ অন্য হাদিসে এসেছে, ‘আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তি সে-ই, যে তাঁর সৃষ্টিকুলের জন্য বেশি উপকারী।’ অথচ বর্তমানে আমাদের সমাজে ধার্মিকতাকে কিছু মুসলমান নিছক আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছেন।
কোনো পরিস্থিতিতেই তিনি আনুষ্ঠানিক ইবাদতের বাইরে কিছু করতে চান না। এমনকি মায়ের জন্য ওষুধ আনা, বাবাকে ডাক্তার দেখানো, স্ত্রীর জন্য প্রয়োজনীয় পোশাক-পরিচ্ছদ কেনা ইত্যাদি কাজের জন্যও তাঁর সময় নেই। তাঁর ধারণা অনুযায়ী, তিনি দ্বীনের কাজে, জিকির-ওজিফা, কোরআন তেলাওয়াত বা মোরাকাবায় বসে আছেন। অথচ মাতা-পিতার চাহিদা পূরণ; আত্মীয়ের হক আদায়, হাল-হকিকত জানতে চাওয়া, সুখ-দুঃখের খবর নেওয়া জরুরি ছিল। ভাই, চাচা বা মামা তাঁর দেখা ও সান্নিধ্য পেয়ে মানসিক শান্তিটুকু লাভ করত, তা তাদের পাওনা।
অনেক ক্ষেত্রে তো দেখা যায়, এই ধার্মিক ভাই, চাচা বা মামা আত্মীয়দের উত্তরাধিকার হিসেবে প্রাপ্য না দিয়ে আটকে রেখেছেন। এমন হলে যে কোনো ধার্মিকের জীবন ষোলো আনাই মিছে। ওয়ারিশদের পাওনা না মিটানোর অপরাধে তাঁর কোনো ইবাদত-বন্দেগিই কবুল হচ্ছে না। যদি পাওনা দিয়েও থাকেন, এর পরও তাদের মন খুশি করা তাঁর দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত।
হাশরের দিন বহু লোক ক্ষমা লাভ করে জান্নাতে যাওয়ার জন্য রওনা হবে, কিন্তু আত্মীয়তার হক আদায় না করার ফলে তাদের আটকে দেওয়া হবে। আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করা কবিরা গুনাহর অন্তর্ভুক্ত। হাশরের দিন এই ‘বন্ধন’ আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করে বন্ধন ছিন্নকারীর বিচার চাইবে এবং তাকে জাহান্নামে নিয়ে ছাড়বে। পিতা-মাতা, ভাইবোন, চাচা-ফুফু, মামা-খালা ও তাদের দ্বারা অর্জিত ভাইবোন ও তাদের সন্তানদের সঙ্গে আত্মীয়তা রক্ষা করা, সম্পর্ক পরিচর্যা করা ইসলামের বিধান। অন্য পক্ষের আচরণে অনেক ক্ষেত্রে এ বন্ধন ছিন্ন ও নষ্ট হয়ে যায়। তাই নিজ দায়িত্বে ক্ষমা, উদারতা, দয়া ও ত্যাগের মাধ্যমে এসব আত্মীয়তার সম্পর্ক জড়িয়ে রাখা অসীম সওয়াবের কাজ। এসব বন্ধন ছিন্ন বা নষ্ট করা হারাম ও কবিরা গুনাহ এবং জাহান্নামে যাওয়ার অন্যতম কারণ।
অনেকে না জানার কারণে এসব বন্ধন ছিন্ন করেন। কিছু মুসলমান অজ্ঞতা ও অসচেতনতার কারণে এই মহা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি অবহেলা করা সত্ত্বেও নিজেকে ধার্মিক, আল্লাহর প্রিয় ব্যক্তি বলে মনে করছেন। তিনি তাঁর মনগড়া ধর্মীয় কাজ ও আনুষ্ঠানিক ইবাদতের তুলনায় এসব জরুরি কাজকে কিছুই মনে করছেন না। বৃদ্ধ পিতা-মাতা, ছোট শিশু, অন্তঃসত্ত্বা বা রোগাক্রান্ত স্ত্রীকে ফেলে রেখে আনুষ্ঠানিক ধর্মকর্মে ডুবে থাকেন। শরিয়তের বাইরে গিয়ে তারা ধার্মিক হওয়ার দোহাই দিয়ে অসামাজিক হয়ে যাচ্ছেন। রোগী দেখতে যান না; কেউ অসুবিধায় পড়লে খোঁজখবর নেন না। মানুষের কষ্ট দূর করার কোনো স্পৃহা তাদের থাকে না। মৃতের জানাজায় যান না, দাফন-কাফনে অংশ নেন না; প্রতিবেশীর বিপদে এগিয়ে যান না। কঠিন কাজকর্ম অন্যদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে তিনি ওজিফায় মগ্ন থাকেন। ফাঁকিবাজ বা ধূর্ত প্রকৃতির এসব লোক অন্যদের কাছ থেকে প্রাপ্ত এবং অন্যদের দ্বারা অর্জিত সুবিধাগুলো আবার ঠিকই ভোগ করেন। অঘোষিত এক বৈরাগ্যবাদ তাদের ঘিরে ধরে থাকে, যা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
জীবনকে বাদ দিয়ে ধার্মিক হওয়া যায় না। দায়িত্ব এড়িয়ে আল্লাহকে খুশি করার কোনো সংক্ষিপ্ত রাস্তা নেই। অজ্ঞতা থেকে বেরিয়ে এসে সচেতন হয়ে সব মুসলমানকে প্রকৃত ধার্মিক হতে হবে। ইচ্ছামতো ধার্মিকতার সংজ্ঞা তৈরি করে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করা যাবে না। এক কথায়, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নতের বাইরে কোনো ধার্মিকতা নেই। মহান আল্লাহ আমাদের প্রকৃত ধার্মিক হওয়ার যোগ্যতা দান করুন।
ড. মোহাম্মদ শাহ জালাল: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট; আহ্বায়ক, সুফিবাদি নাগরিক মজলিস-সুনাম
- বিষয় :
- ইসলাম ও সমাজ
- মোহাম্মদ শাহ জালাল