পশ্চিমাদের পরামর্শ আমলে না নেওয়ার ফল

ওবায়দুল হক
প্রকাশ: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ০১:৫৭
বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাধাদানকারীদের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা শুরু করা হয়েছে বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইটে শুক্রবার এ তথ্য প্রকাশ করা হয়। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র ইউরোপীয় ইউনিয়ন সম্প্রতি তাদের পার্লামেন্টে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশের পর জানিয়েছে, বাংলাদেশের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে তারা বড় আকারের কোনো পর্যবেক্ষক দল পাঠাবে না। স্বাভাবিকভাবেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউর এ সর্বশেষ বক্তব্য দেশের রাজনীতিতে এখন সবচেয়ে বড় আলোচনার বিষয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে ওবায়দুল হকের বিশ্লেষণ নিচে ছাপানো হলো।
শুক্রবার মার্কিন ভিসা বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করার ঘোষণা দিয়েছে, সেটা বলা চলে একটা আনুষ্ঠানিকতা। এর প্রয়োগ যে হচ্ছে সেটা আমরা আগে থেকেই জানতাম। এগুলো আমাদের জন্য সতর্কতামূলক সংকেত। দৃশ্যত মনে হতে পারে, সরকার বুঝি বিষয়টি নিয়ে উদাসীন। তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থেকে সরকারের মধ্যে এক ধরনের আত্মতুষ্টি তৈরি হয়েছে। এক ধরনের সক্ষমতাও তৈরি হয়েছে বলে তারা বিশ্বাস করেন। ফলে তারা বিষয়টি সেভাবেই মোকাবিলা করতে চান এবং সে ব্যাপারে সরকার প্রস্তুতই ছিল বলা চলে।
ভিসা নিষেধাজ্ঞা কার্যকরের ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রীর যে বিবৃতি শনিবারের খবরের কাগজে প্রকাশিত হয়েছে, তা গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলছেন, দেশের বাইরে থেকে নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র সফল হতে দেওয়া হবে না। তার মানে তিনি এখন অন্তত প্রকাশ্যেই বলছেন, এটি নির্বাচন বানচালের বিদেশি ষড়যন্ত্র। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আশঙ্কা করছেন যে, অবৈধ পন্থায় ক্ষমতা গ্রহণের চেষ্টাও হতে পারে। তিনি নিশ্চিত করে বলেছেন যে, সে ধরনের কোনো সুযোগ নেই। সে চেষ্টা হলে বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। তার মানে এখানে অসাংবিধানিকভাবে বাইরে থেকে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের শঙ্কাও রয়েছে।
এ ঘটনাগুলোকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার অবকাশ নেই। পশ্চিমাদের অবস্থান একেবারে পরিষ্কার। তারা সুষ্ঠু নির্বাচন এবং গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসনের কথা বলেছে। এগুলো তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমরা সেটা আমলে নিচ্ছিলাম না। বিশেষ করে র্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার কথা বলা যায়। সে নিষেধাজ্ঞায় উত্তর কোরিয়া কিংবা বার্মার সঙ্গে বাংলাদেশের নাম ঘোষিত হওয়াটা অকল্পনীয় ছিল। আমাদের জন্য সেটা অপমানজনক ছিল। তারা যে আমাদের বারবার সতর্ক করছিল, তা আমরা অনুধাবন করি ওই নিষেধাজ্ঞার পর।
তবে এখনও আমরা বদলাইনি। আমাদের দিক থেকে এটা এক ধরনের ‘ডিনাইয়াল’ বা আমলে না নেওয়ার মনোভাব ছিল। সরকার এমনকি বলেছে, এটা ষড়যন্ত্র, এটা অন্যায়মূলক সিদ্ধান্ত। জঙ্গি দমন সত্ত্বেও র্যাবকে পুরস্কার না দিয়ে তিরস্কার করা হয়েছে ইত্যাদি। সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্য এমন কিছু কথা বলতেই হয়। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা দেওয়ার চেষ্টা করা হলেও পশ্চিমারা তাতে আস্থা রাখেনি।
সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়ন পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্ত এবং মানবাধিকার প্রশ্নে যে প্রস্তাব পাস করল, সেসবও এরই অংশ। যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এতদিন বাংলাদেশের ব্যাপারে ইতিবাচক ছিল, তাদের অবস্থান কীভাবে বদলেছে সেটা দেখার বিষয়। গত বছর ব্রাসেলসে এক অনুষ্ঠানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একজন প্রতিনিধি বলছিলেন, বাংলাদেশ ২০২৯ সালের পরও জিএসপি সুবিধা পাবে। তিনি জোর দিয়েই বলেছিলেন। কিন্তু সেখান থেকে ক্রমাগতভাবে তাদের অবস্থান বদলে গেছে।
মে মাসে যখন ভিসা নীতির কথা আমরা জানতে পারি, তখনও ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলেছে, তারা ভিসা নীতির সঙ্গে নেই। সেখান থেকে তাদের নীতি পুরোপুরি ঘুরে গেল। তারা অবশ্য বলেছিল, ভিসা নীতির সঙ্গে না থাকলেও সুষ্ঠু নির্বাচন তারা চায়। এরপর তাদের প্রাক-পর্যবেক্ষক দল এসেছিল। এরপরই সাম্প্রতিক ইউরোপীয় পার্লামেন্ট-এর প্রস্তাব দেখলাম এবং তারপর নির্বাচনে পর্যবেক্ষক না পাঠানো ঘোষণা দিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
এ ঘটনাগুলো ঘটেছে সেই ডিনাইয়াল বা অস্বীকারের মনোভাবের কারণে। অর্থাৎ আমরা বলছি, এখানে তো সুষ্ঠু নির্বাচনের সব ব্যবস্থা আছে। সুষ্ঠু নির্বাচন হবে, তাই সবাইকে নির্বাচনে আসতে হবে। না এলে তো আমাদের করার কিছু নেই। আরেকটি যুক্তি হলো, আমরা তো সংবিধান বদলাতে পারব না, সাংবিধানিকভাবেই নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে। এই যে মানুষের দাবি উপেক্ষা– এটাই ডিনাইয়াল।
মানুষ ভোট দিতে চায়। সেজন্য রাজনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের দাবি উঠেছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যে দাবি তার নিশ্চয়তা কিন্তু পাওয়া যায়নি। আলোচনা চললেও সরকার এমন কিছু করতে পারেনি যে, বিরোধী দলের মধ্যে সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে আস্থা তৈরি হতে পারে। বিদেশিদের ক্ষেত্রেও ঠিক এটাই ঘটেছে, তারা আস্থা পাচ্ছেন না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ইউরোপীয় ইউনিয়ন নির্বাচনকে সবসময়ই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। অতি সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়ন স্পষ্ট করেই বলেছে, বাংলাদেশ যে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী নির্বাচন করতে পারবে এমন আস্থা তারা অর্জন করতে পারেনি। ইউরোপীয় কমিশনের পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তাবিষয়ক মুখপাত্র নাবিলা মাসরালির ভাষায়, বিশেষজ্ঞদের মূল্যায়নে বাংলাদেশের নির্বাচন আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী না হওয়ার আশঙ্কার কথা উঠে আসায়, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নির্বাচনে পর্যবেক্ষক না পাঠানো বাংলাদেশের জন্য খারাপ বার্তা, এতে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা কমে যাবে। যতবেশি আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক থাকবে ততবেশি নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন আমাদের জন্য রুটি-রুজির প্রশ্ন। আমাদের রপ্তানি পণ্যের ৪৮ শতাংশের গন্তব্য সেখানে। সেজন্য বাংলাদেশের চেম্বারগুলো নড়েচড়ে বসেছে। আসলে এর বিকল্পও নেই। ইউরোপীয় ইউনিয়ন জিএসপি সুবিধা বন্ধ করে দিলে তার প্রভাব অর্থনীতিতে গভীরভাবেই পড়বে। আমি মনে করি, এখনও সময় শেষ হয়ে যায়নি।
আমাদের ‘ডিনাইয়াল’ থেকে বের হয়ে আসতে হবে। এটা নিশ্চিত করতে হবে এ কারণে যে, রাজনীতিকে আপনি ‘জিরোসাম গেইম’ হিসেবে নিতে পারেন না। কারণ এখানে মানুষের জীবনের প্রশ্ন জড়িত। তাদের ভবিষ্যৎ, দেশের উন্নয়ন, তার প্রত্যাশা সবই জড়িত। সেজন্য আমাদের একটা মধ্যবর্তী অবস্থান বের করতে হবে। ‘জিরোসাম গেইম’ হিসেবে নিলে সবসময় জেতার সুযোগ নেই। কারণ রাজনীতি তো একদিনের জন্য নয়। দিনশেষে আপনাকে মানুষের কাছে ফিরে যেতেই হবে।
সেজন্য বিষয়টিকে বিদেশিদের ষড়যন্ত্র কিংবা বাইরে থেকে নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র এভাবে দেখার সুযোগ নেই। তবে এটাও বলা দরকার, হতে পারে এটা তাদের ষড়যন্ত্র, হতে পারে এটা বিদেশিদের ভূরাজনৈতিক খেলা। কিন্তু বাস্তব অর্থেই দেশের মানুষের প্রত্যাশাও তাদের সঙ্গে মিলে গেছে। মানুষ তার ভোটাধিকার ফেরত চাইছে। যে কারণে একটা মধ্যমপন্থা বের করতে হবে।
আমরা যেন আরেকটা ওয়ান-ইলেভেনের দিকে না ঝুঁকি এবং দীর্ঘমেয়াদে অসাংবিধানিক সরকারের হাতে ক্ষমতা না যায়। সেজন্য না বোঝার ভান করে থাকলে হবে না। অন্ধ হলেই প্রলয় বন্ধ হয় না।
ওবায়দুল হক: সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
- বিষয় :
- ভিসা নিষেধাজ্ঞা
- ওবায়দুল হক