সংস্কৃতি
হিন্দি ‘জওয়ান’ বাংলায় ডাবিং হয় না কীসের জোশে?

মযহারুল ইসলাম বাবলা
প্রকাশ: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ০২:৪৮
বলিউডের হিন্দি চলচ্চিত্র দক্ষিণাঞ্চলীয় চার রাজ্য ছাড়া ভারতজুড়ে প্রদর্শিত হয়। কিন্তু দক্ষিণের চার রাজ্য যথাক্রমে তামিলনাড়ু, কর্ণাটক, অন্ধ্র ও কেরালায় হিন্দি ভাষা ও সংস্কৃতি তারা প্রবলভাবে রুখেছে। তাই হিন্দি ভাষার চলচ্চিত্র সেখানে প্রদর্শিত হতে পারে না। ওই চার রাজ্যের পৃথক চার ভাষা তামিল, কন্নড়, তেলেগু ও মালয়ালম ভাষার বিকল্প ভাষাটি হিন্দি নয়; ইংরেজি। হিন্দি চলচ্চিত্র ‘জওয়ান’ ওই চার রাজ্যে তাই উপস্থিত হয়েছে চার পৃথক ভাষায় ডাবিং নিয়ে। অথচ বাংলাদেশে ছবিটি বাংলায় ডাবিং না করে নির্ভেজাল হিন্দি ভাষায় প্রদর্শিত হচ্ছে। কী বিচিত্র দেশ, সেলুকাস!
মাতৃভাষার জন্য লড়াইয়ে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেওয়ার মাধ্যমে আমরা বিশ্বে নজির স্থাপন করেছিলাম। পাকিস্তানের স্রষ্টা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দু ভাষা চাপাতে এসেও রেসকোর্সে এবং কার্জন হলের বক্তৃতা উর্দুতে নয়; ইংরেজিতে দিয়েছিলেন। তারপরও ওই বক্তৃতাই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সূচনা করেছিল। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে মিছিলে থাকা আমরা সড়কের পাশে উর্দু ও ইংরেজিতে লেখা সাইনবোর্ড নির্বিচারে ভেঙেছিলাম। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে জেল-জুলুম, প্রাণদান করে মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম। সেই আমরাই স্বাধীন বাংলাদেশে হিন্দি ভাষার আমদানীকৃত ভারতীয় চলচ্চিত্র প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে আমরা হিন্দি ভাষা-সংস্কৃতির আগ্রাসন সানন্দে বরণ করে নিলাম? এটি ইতিহাসের কৌতুক ভিন্ন আর কী বলা যায়?
এটা ঠিক, কেবল টিভির কল্যাণে হিন্দি ভাষা-সংস্কৃতি আমাদের ঘরে ঘরে অনেক আগেই ঢুকে পড়েছে। তাই বলে হিন্দি ভাষার ‘জওয়ান’ ছবিটি আমাদের দেশের প্রেক্ষাগৃহেও জোরকদমে প্রদর্শিত হবে?
পাকিস্তানিরা বল প্রয়োগেও আমাদের ওপর উর্দু ভাষা চাপাতে পারেনি। অথচ ভারতের সরকারি ভাষা হিন্দি আমরা সানন্দে গ্রহণ করছি। এই অবক্ষয় আমাদের জাতীয় জীবনে বিশেষ করে আমাদের ভাষা-সংস্কৃতিতে বিরূপ প্রভাব যে ফেলতে পারে– রাষ্ট্র ও সরকার তার সামান্য বিবেচনা না করে হিন্দি ভাষার ‘জওয়ান’ ছবিটি প্রদর্শনের অনুমতি দিল কেন? আমাদের প্রতিটি শাসকই নিজেদের জাতীয়তাবাদী পরিচয় দিয়ে এসেছে। তাদের জাতীয়তাবাদী চেতনা যে ফাঁপা– হিন্দি ভাষার ভারতীয় চলচ্চিত্র প্রদর্শনের অনুমতি দেওয়ার মধ্য দিয়ে সেটা স্পষ্ট। আমাদের চলচ্চিত্র শিল্প মুনাফালিপ্সায় এখন প্রায় বসে পড়েছে। সুস্থ বিনোদনের বিপরীতে স্থূলতার কারণে মানুষ প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে ছবি দেখা অনেক আগেই প্রায় ত্যাগ করেছে। এ অবস্থায় ভারতীয় হিন্দি ভাষার চলচ্চিত্রের অনুপ্রবেশ কি আমাদের মুখ থুবড়ে পড়া চলচ্চিত্র শিল্পের কবর রচনা নয়?
বলিউডের বাণিজ্যিক হিন্দি চলচ্চিত্র ‘জওয়ান’ দক্ষিণ ভারতের চার ভাষা যথাক্রমে তামিল, তেলেগু, কন্নড় এবং মালয়ালম ভাষায় ডাবিং করে মুক্তি দিলেও, ভারতের দ্বিতীয় প্রধান ভাষা বাংলায় ডাবিং করে তা মুক্তি দেওয়া হয়নি। মূল হিন্দি ভাষাতেই বাঙালি অধ্যুষিত রাজ্য ও অঞ্চলে ছবিটি মুক্তি দেওয়া হয়েছে। অথচ ভারতের মোট জনসংখ্যার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভাষাভাষী বাঙালি। সেই অর্থে বাঙালিরা ভারতের গুরুত্বপূর্ণ দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতি। ভারত রাষ্ট্রের ভূগোল ও রাজনীতিতে বাংলাভাষীরা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমন বাংলাভাষী অঞ্চলগুলো তাৎপর্যপূর্ণ বটে। ব্রিটিশ ভারতের জাতিগুলোর মধ্যে বাঙালি জাতিই ছিল অগ্রসর। বাংলা ভাষা সব বিবেচনায় ছিল অগ্রবর্তী। অথচ বাংলা ভাষায় ডাবিং করে ‘জওয়ান’ ছবিটি মুক্তি দেওয়া হয়নি। বাণিজ্যের মুনাফার হিসাব-নিকাশের বাইরে ভারতের ভাষা রাজনীতির বিকাশের ধারার একটি বিদ্বেষমূলক দৃষ্টান্ত নয় কি!
ভারতে ভাষিক-জাতীয়তার প্রশ্নে দ্বন্দ্ব-বিবাদের অজস্র ঘটনা ’৪৭-এর স্বাধীনতার পর থেকে আজও চলমান। ভারত রাষ্ট্রে জাতিগত সমস্যার সমাধান করা হয়নি। বলাবাহুল্য, ভারতীয় শাসকগোষ্ঠী অনিবার্যরূপে হিন্দিভাষী। ভারতের রাজনীতির নিয়ন্ত্রক ভারতীয় পুঁজিপতিরাও হিন্দি ভাষাকে উপলক্ষ করে অপরাপর জাতিসত্তার বিকাশকে অবরুদ্ধ করেছে নিজেদের বাণিজ্যিক স্বার্থে। সাবেক রাষ্ট্রপতি বাঙালি প্রণব মুখার্জি রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণের আগে আক্ষেপে বলেছিলেন, ‘একমাত্র হিন্দিভাষী না হওয়ার কারণেই সব যোগ্যতার পরও কংগ্রেস দলে ও সরকারের শীর্ষ পদ লাভ আমার সম্ভব হয়নি।’ হিন্দি ও বাংলা ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা। এই দুই ভাষার কোনটি ভারতের সরকারি ভাষা হবে– এ নিয়ে সংবিধান সভায় ভোটাভুটি হয়েছিল। দুটি ভাষার পক্ষে সমানসংখ্যক ভোট পড়ায় পুনরায় ভোটাভুটিতে মাত্র এক ভোটে বাংলা ভাষা হেরে যায়। এক ভোটে জয়ী হিন্দি ভাষা ভারতের সরকারি ভাষার মর্যাদা লাভ করে। ওই এক ভোটের ব্যবধান সৃষ্টিতে ভূমিকা পালন করেছিলেন বাঙালি সাহিত্যিক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। ঘরের শত্রু বিভীষণ!
ভারতের অপরাপর অ-হিন্দি জাতিসত্তার ওপর হিন্দি সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের অজুহাত– হিন্দি ভারতের সরকারি ভাষা। হিন্দি ভাষাকে পরিত্যাগ করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। দক্ষিণ ভারত যেটি পেরেছে, সেটা অন্য রাজ্যের পক্ষে এখন আর সম্ভব নয়। হিন্দি তাদের সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠা দিতে পারে। তাই তারা বাধ্য হয়েছে হিন্দি ভাষার প্রতি আকৃষ্ট হতে। কিন্তু আমরা? আমরা তো বাধ্য নই। আমাদের দেশে কেন হিন্দি ভাষায় চলচ্চিত্র প্রদর্শনের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে?
ঢাকায় হিন্দি ভাষায় চলচ্চিত্র প্রদর্শনের সংবাদে কলকাতার এক বন্ধু ফোনে আমাকে জানিয়েছেন, তাদের ওপর হিন্দি ভাষা ও সংস্কৃতি জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছে। এই ক্ষেত্রে তাদের লড়াইয়ের অনুপ্রেরণা ছিল বাংলাদেশ। বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, সংগ্রাম এবং সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী আমরা কেন হিন্দি ভাষার চলচ্চিত্র মহানন্দে উপভোগ করছি! কোথায় গেল আমাদের জাতীয় চেতনা? কোথায় আমাদের বাঙালি জাতীয়তাবাদ? আমি সদুত্তর দিতে পারিনি।
মযহারুল ইসলাম বাবলা: নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত
- বিষয় :
- মযহারুল ইসলাম বাবলা
- সংস্কৃতি
- চলচ্চিত্র