চারদিক
তিস্তার সর্বগ্রাসী ভাঙন

আব্দুল হাই রঞ্জু
প্রকাশ: ০১ অক্টোবর ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ০২ অক্টোবর ২০২৩ | ০৩:৫৬
কয়েক দিনের টানা বর্ষণ ও উজানের ঢলে তিস্তায় দেখা দিয়েছে বন্যা। খরস্রোতা তিস্তা এখন পানিতে টইটম্বুর। সেই সঙ্গে দেখা দিয়েছে নদীভাঙন। শুধু ভাঙন নয়; তৃতীয় দফায় কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার একাধিক ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় আমন ক্ষেতেরও যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে। এ বছর প্রথম দফার বন্যায় রাজারহাট উপজেলার বিদ্যানন্দ এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের নদীর তীর সংরক্ষণ প্রকল্পের কিছু অংশ ভেঙে যায়। পরে পানি উন্নয়ন বোর্ডের তরফে তাৎক্ষণিক জিও ব্যাগে বালু ভর্তি করে নদীতীর রক্ষার চেষ্টা করা হয়। এখনও সে প্রচেষ্টা অব্যাহত। শুধু তাই নয়; লালমনিরহাট জেলার আদিতমারী ও হাতীবান্ধায়ও তিস্তার ভাঙন অব্যাহত আছে। বন্যা হলেই নদীভাঙনের আতঙ্কে তিস্তাপারের মানুষের নির্ঘুম রাত কাটাতে হয়।
তিস্তা হিমালয় পর্বত থেকে শুরু হয়ে কুড়িগ্রামের চিলমারী বন্দরে এসে ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে মিলিত হয়েছে, যা আগেই বলেছি। ভৌগোলিক কারণে তিস্তার গুরুত্ব অপরিসীম। তিস্তার পানির ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশের চারটি জেলার সেচভিত্তিক চাষাবাদ। যে কারণে লালমনিরহাট ও নীলফামারী জেলার সীমান্তে তিস্তা নদীর ওপর ৪৪টি রেডিয়াল গেট সংবলিত ৬১৫ মিটার দৈর্ঘ্যের ব্যারাজটি নির্মিত হয়। ১৯৭৯ সালে শুরু হয়ে ব্যারাজটির কাজ ১৯৯০ সালে শেষ হলেও এর সুফল চারটি জেলার মানুষ ভোগ করছে। তিস্তা নদীর পানিকে নিয়ন্ত্রণ এবং সংরক্ষণ করে কয়েকটি জেলায় সেচ সুবিধা নেওয়া হয়। ফলে বাংলাদেশের কয়েকটি জেলার মানুষ সেচভিত্তিক চাষাবাদ করে খাদ্য উৎপাদনে ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছে। উজানে অতিবৃষ্টি হলে তিস্তা ব্যারাজের গেট বন্ধ করে তিস্তার বাংলাদেশ অংশের মানুষকে আকস্মিক বন্যার কবল থেকে উদ্ধারও করা যায়।
১৯৯৮ সালে ভারত সরকার তিস্তা ব্যারাজের ৬০ কিলোমিটার উজানে গজলডোবায় ব্যারাজ নির্মাণ করে তিস্তা ব্যারাজের এ কার্যকারিতা অনেকাংশেই নষ্ট করে দেয়। এর পর থেকে ভারতে অতিবর্ষণ হলে কিংবা উজানের ঢলের পানির কারণে বাংলাদেশের কয়েকটি জেলায় আকস্মিক বন্যার সৃষ্টি হয়। এমনকি শুষ্ক মৌসুমে গজলডোবায় পানি একতরফাভাবে আটক করে বাংলাদেশ অংশের তিস্তাকে পানিশূন্য করে ফেলে। ফলে সেচভিত্তিক চাষাবাদে এ অঞ্চলের মানুষকে প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়। নিরুপায় হয়ে সেচভিত্তিক চাষাবাদকে নির্বিঘ্ন করতে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের দিকে জোর দিতে হয়। এভাবে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করতে করতে এখন পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে পানির সংকটে এক সময় সেচভিত্তিক চাষাবাদ কিংবা মানুষের বেঁচে থাকার জন্য নিরাপদ সুপেয় পানি দুষ্প্রাপ্য হয়ে যাবে।
এ সংকট থেকে উত্তরণে প্রয়োজন তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যাকে নিশ্চিত করা। কিন্তু দুর্ভাগ্য, বছরের পর বছর তিস্তা চুক্তির জন্য ভারত সরকারকে বাংলাদেশ সরকার অনুরোধ করলেও কোনো কাজ হচ্ছে না। বরং আশ্বাস আর প্রতিশ্রুতির বেড়াজালে তিস্তা চুক্তি আটকে আছে। সম্প্রতি জি২০ সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরে গিয়েছিলেন। তখন অনেকেই আশা করেছিলেন, এ দফায় হয়তো তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে একটি সমঝোতা হবে। বাস্তবে তেমন কিছুই ঘটেনি। কবে, কখন তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি হবে, তা সবার কাছেই অজানা এক স্বপ্ন।
সংগত কারণে তিস্তা নদীর নাব্য বৃদ্ধি করতে ড্রেজিং প্রকল্প হাতে নিয়ে পানি ধারণের ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে শুষ্ক মৌসুমেও তিস্তায় ভরপুর পানি থাকে। তিস্তার গভীরতা বৃদ্ধি করতে পারলে ভাঙনও অনেকাংশে কমে আসবে এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে সেচভিত্তিক চাষাবাদকে নির্বিঘ্ন করা সম্ভব হবে।
আব্দুল হাই রঞ্জু: সাবেক ছাত্রনেতা