ঢাকা সোমবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৩

দেশ

আপনাদের ‘বেহেশতে’ মানুষের জায়গা কোথায়?

আপনাদের ‘বেহেশতে’ মানুষের জায়গা কোথায়?

সুলতানা কামাল

প্রকাশ: ১৬ অক্টোবর ২০২৩ | ১৮:০০

সকালের অবসরে টেলিভিশনে খবর শুনছিলাম। শিরোনামে দেখতে পেলাম ‘চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর গেলেন রাষ্ট্রপতি।’ খবরটা দেখে মানবিক কারণেই খারাপ লাগল রাষ্ট্রপতির অসুস্থতায়। আমি তাঁর দ্রুত আরোগ্য কামনা করি। তবে কিছুদিন আগে শুনেছি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতির প্রশংসা করেছে। স্পষ্টতই সেই উন্নতি রাষ্ট্রপতি পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি। আমার জানাশোনা বন্ধুবান্ধব কষ্ট করে হলেও সাধ্যে কুলালে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার কথাই চিন্তা করেন।


অবধারিতভাবে বলা হবে, দরিদ্ররা চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতির সুফল পাচ্ছে বা পাবে। সেটাই কথা। দরিদ্রদের জন্য একটা স্তর পর্যন্ত উন্নত মান, কিন্তু সেটা ধনী বা ক্ষমতাশালীদের জন্য প্রযোজ্য নয়। দুঃখটা হলো, সব ব্যবস্থার মতো ধনী এবং দরিদ্রের জন্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মানেও আকাশ-পাতাল তফাত থাকবেই– সেটা বাস্তবতা বলে মেনে নেওয়ার পরামর্শ আসবে। এসব কথা যখন ভাবছি তখনই আমার এক সহকর্মী এলেন। কথায় কথায় তিনি বাজার করতে গিয়ে তাঁর পরিবারের এক সদস্যের অভিজ্ঞতার কথা বললেন। ভদ্রলোকের তালিকায় একটি পদ ছিল ‘শাক’। তাঁর প্রয়োজন অনুযায়ী তিন আঁটি শাক কিনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দাম শুনে দুই আঁটি কেনার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।

আমাদের সবারই খাদ্য তালিকায় প্রতিদিন একটি-দুটি পদ ছেঁটে দিতে হচ্ছে। মাছ-মাংস দৈনন্দিন খাবার থেকে সাপ্তাহিক কিংবা পাক্ষিক হয়ে গেছে। সবজি কম কম করে খেতে হচ্ছে। শাকও পর্যাপ্ত কেনার সাধ্য নেই। অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোলাও-কোরমার উৎসব আর বিলানোর খবরও চোখে পড়ে বা শুনতে পাই। শুনি, দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বিশ্বাসও করি বাজারের অবস্থা দেখে। কোনো খাবার পাওয়া যায় না বলে দেখিনি। হাতে পর্যাপ্ত টাকা থাকলেই সবকিছু সুলভ হয়ে ওঠে। মুশকিল টাকা না থাকা বা কম থাকা মানুষদের। নীতিনির্ধারকরা স্বীকার করছেন, সিন্ডিকেটের কারণেই দ্রব্যমূল্যের এই লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি।

মন্ত্রীরা কেউ কেউ বেশ খোলামেলাই বলছেন, তাদের পক্ষে সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না। তারপরও ওই পদে অধিষ্ঠিত থাকা তাদের খুবই জরুরি। একজন মন্ত্রী কিছুদিন আগে বলেছিলেন, ‘আপনারা তো বেহেশতে আছেন।’ কিছু মানুষের জন্য তো এটি সত্যই। ক্ষমতায় গিয়ে জনগণের করের পয়সায় দৈনন্দিন জীবন থেকে প্রতিটি ক্ষেত্রে সবচেয়ে সুবিধাভোগী জীবন যাপন করতে পারলে বেহেশতে থাকার স্বাদ তো পাওয়া যেতেই পারে। জনগণের জমা করা টাকা লুট করে বিদেশে পাচার করে দেওয়ার পরও সরকার তাদের কেশাগ্র স্পর্শ করতে না চাইলে বা না পারলে তারা তো বেহেশতের সুখ পেতেই পারেন।

সাধারণ মানুষ যখন প্রতিদিন দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হওয়ার লড়াই থেকে বেরিয়ে আসার জন্য প্রাণপাত করছে, তখন নির্বাচন পরিচালনায় প্রয়োজনের অজুহাতে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের গাড়ি কিনে দেওয়াটা ‘বেহেশতি’ সওগাত তো বটেই! এমন আরও অনেক দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়, যেখানে সাধারণ মানুষকে বঞ্চিত করে, অসুবিধায় রেখে গুটিকয় ব্যক্তিকে আইনি-বেআইনি সুবিধা দেওয়া হয়েছে বিলাসী জীবনযাপনের জন্য।

বাংলাদেশে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য এখন ভয়ানক অবস্থায় চলে গেছে। শুধু অর্থনৈতিক দারিদ্র্য নয়; শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি, সামর্থ্যের বঞ্চনা– সব মিলিয়ে সমাজের মধ্যবিত্ত থেকে দরিদ্র জনগোষ্ঠী আজ দিশেহারা। বলতেই হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করা একটি দেশ, যার আদর্শের ভিত্তিই ছিল সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার আর সব মানুষের মর্যাদা সমুন্নত রাখা; সেই দেশের কিছু মানুষকে সাধারণ জনগণের শ্রম সস্তায় বিক্রি করে, তাদের কষ্টের অর্জিত সম্পদ অবাধে লুট করতে দিয়ে, অন্যায্য সুযোগ-সুবিধা দিয়ে ‘বেহেশত’-এ রাখার জন্য সাধারণ মানুষ মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের দাবিদার রাজনীতিকদের ক্ষমতায় দেখতে চায়নি। তাদের কাছে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল ভিন্ন।

সামনে নির্বাচন। একবার কি তারা তাদের আচরণ ও কথায় অন্যেরা কে কী করেছে বা করে, এই আচ্ছন্নতা থেকে বেরিয়ে আসবেন? তারা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে, কোনো অপশক্তির সঙ্গে আপস না করে, নিজেদেরই ঘোষিত মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে অবিচল থেকে সবার জন্য বাসযোগ্য একটি দেশ গঠনে নিয়োজিত হওয়ার বিশ্বাসযোগ্য প্রত্যয়ের প্রতিফলন ঘটাতে পারেন না? সুলতানা কামাল: মানবাধিকার কর্মী

আরও পড়ুন