নারীশিক্ষা বনাম বাল্যবিয়ে
সমাজ

প্রতীকী ছবি
আশেক মাহমুদ
প্রকাশ: ১৬ এপ্রিল ২০২৪ | ২৩:২৯
বাংলাদেশের শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্র-ছাত্রীর অনুপাত প্রায় সমান। অর্থাৎ মোট শিক্ষার্থীর অর্ধেকই নারী। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে নারী শিক্ষার্থীরা উপবৃত্তির মাধ্যমে আর্থিক সহায়তা পেয়েছে। এতে এ পর্যায়ে মেয়ে ও ছেলে শিক্ষার্থীর মধ্যে সমতা অর্জন সম্ভব হয়েছে। ব্যানবেইসের তথ্যানুযায়ী, ২০২২ সালে মাধ্যমিকে ঝরে পড়ার হার ছিল ৩৫ দশমিক ৯৮ শতাংশ। এখানে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের ঝরে পড়ার হার বেশি। ঝরে পড়ার হার উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমাতে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ বাড়ানোর আবশ্যকতা রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বা উচ্চশিক্ষায় ছাত্রীদের অংশগ্রহণ কমে ৩৬ দশমিক ৩০ শতাংশে নেমে এসেছে। এতে আর্থিক ও সামাজিক অগ্রগতিতে নারীর অংশগ্রহণ আশানুরূপ হতে পারছে না। উচ্চশিক্ষায় নারী শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি দিয়ে তাদের অগ্রগতি বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। উচ্চশিক্ষা থেকে মেয়েদের ঝরে পড়ার অন্যতম কারণ বাল্যবিয়ে। ১৮ বছরের আগে তথা মেয়েদের বাল্যবিয়ের হার ২০২২ সালে ছিল ৪১ শতাংশ।
শিক্ষার হার বৃদ্ধির সঙ্গে বাল্যবিয়ে কমে যাওয়ার কথা। অথচ তা বেড়ে যাওয়ায় নারীদের সামাজিক ও স্বাস্থ্যগত এবং অর্থনৈতিক অধিকার হ্রাসের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বাল্যবিয়ে বৃদ্ধির কারণ হিসেবে প্রাথমিকভাবে কভিডের প্রাদুর্ভাবকে দায়ী করা হয়। তবে এর প্রধান কারণ হিসেবে মূল্যস্ফীতিজনিত পারিবারিক দারিদ্র্য বৃদ্ধি ও সামাজিক নিরাপত্তার ঘাটতিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। যেহেতু বাল্যবিয়ে বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নারী শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার বৃদ্ধি পায় এবং উচ্চশিক্ষার সুযোগ ব্যাহত হয়; সে কারণে বাল্যবিয়ের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে নারীর অর্থনৈতিক অধিকার অর্জনের সুযোগ যেমন কমে, তেমনি নারীর ওপর পুরুষতান্ত্রিক নিপীড়ন বৃদ্ধির আশঙ্কা বাড়তে থাকে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এ তথ্য প্রকাশ করেছে। ২০২৩ সালে নারী নির্যাতন ও নারী হত্যা বৃদ্ধির প্রধান কারণ ছিল যৌতুক, অনৈতিক সম্পর্ক, মতের অমিল ও ব্যক্তিত্বের সংঘাত। এ থেকে বোঝা যায়, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংকটের মীমাংসা না হলে নারীর অধিকার সমুন্নত রাখা অসম্ভব।
কেননা, নারীর অধিকারকে যদি শ্রেণি কাঠামোর মধ্য থেকে দেখা হয়, তাহলে নারীর বৈষম্যের মধ্যে বহুমাত্রিকতা দেখা দেবে। তুলনার চিত্র তখন আর নারী ও পুরুষের মধ্যে থাকবে না; তুলনা হবে নারীর সঙ্গে নারীর। অর্থনৈতিক দিক থেকে দেখা যায়, চা শ্রমিকদের ব্যাপক অংশ নারী। চা শ্রমিকরা দারিদ্র্যকে বয়ে বেড়ায় বংশপরম্পরায়। বিভিন্ন আদিবাসী নারী, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নারী, বিহারি ক্যাম্পের নারী, গ্রামের কৃষক পরিবারের নারী, দিনমজুরদের পরিবারে নারী, বস্তিবাসী নারী, হিজড়া হিসেবে নারী, এমনকি গার্মেন্ট শ্রমিক হিসেবে নারীদের জীবনমানের কতটুকু উন্নতি হচ্ছে– সে হিসাব দেখা দরকার। এটা এ জন্য যে, মধ্যবিত্ত আর উচ্চবিত্ত পরিবারে গড়ে ওঠা নারীদের পক্ষে উচ্চশিক্ষা লাভের যে সুযোগ আছে; উল্লিখিত এসব গোষ্ঠীর মধ্যে সেই সুযোগ একদম সীমিত। অনেকের ক্ষেত্রে তা নেই বললেই চলে। শুধু তাই নয়; নারী নিরাপত্তার বিষয়ে দেখা যায় আইনের প্রয়োগ ও বিচার প্রক্রিয়া এখনও বেশি মাত্রায় শ্রেণিবান্ধব। দরিদ্র ও মাইনরিটি সম্প্রদায়ের মধ্যে কেউ নিপীড়িত হলে বা ধর্ষিত হলে তা বিচার প্রক্রিয়ায় আসতে পারে না। এমনকি বিচারের ক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত নারীও সুবিচার থেকে বঞ্চিত হতে পারে যদি আসামি উচ্চবিত্তের কেউ হয়।
সর্বসাকল্যে নারীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক অধিকার, রাজনৈতিক অধিকার ও সাংস্কৃতিক অধিকার লাভের লক্ষ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক পুঁজির অর্থপূর্ণ ব্যবহারের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এই ত্রিমাত্রিক পুঁজির ব্যবহারে ন্যায্যতা ও সমন্বয় করা অত্যাবশ্যক, যদিও তাতে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কর্ণধার হিসেবে সরকারের দায়িত্ব অনেক। সেই সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক সংগঠন, বিভিন্ন গণমাধ্যম এবং পরিবারের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। পুঁজির শাসনের স্থলে প্রজ্ঞার শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে নারীর অধিকার শ্রেণি কাঠামোতে আবদ্ধ থাকবে না। দরিদ্র ও অধিকারবঞ্চিত পরিবারগুলোয় নারীর শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সুবিধা বৃদ্ধির জন্য রাষ্ট্রীয় বাজেটের পরিসর বাড়াতে হবে। এর প্রায়োগিক ব্যবস্থাপনার জন্য সুনির্দিষ্ট পলিসি থাকবে, যেন প্রতিবছর তাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সুবিধাপ্রাপ্তির হার বাড়তে পারে। শিক্ষাব্যবস্থা ও মিডিয়ার অনুষ্ঠানমালায় এমন সংস্কার আনতে হবে– যেন অধিকারের ব্যাপারে নারীদের সচেতনতা বাড়তে পারে; নারীর সঙ্গে পুরুষের আচরণের উত্তম দিক শিক্ষা দেওয়া যায়; নারী ও পুরুষের মধ্যে পারস্পরিক সম্মান ও মর্যাদার মানসিকতা গড়ে ওঠে।
ড. আশেক মাহমুদ: সহযোগী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান
বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়