মুজিবনগরের গার্ড অব অনার ছিল জীবনের শ্রেষ্ঠতম মুহূর্ত
সাক্ষাৎকার: মাহবুব উদ্দিন আহমদ বীরবিক্রম

মাহবুব উদ্দিন আহমদ
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সমকালের সহকারী সম্পাদক সাইফুর রহমান তপন।
প্রকাশ: ১৬ এপ্রিল ২০২৪ | ২৩:৪১ | আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০২৪ | ১২:৪৭
‘এসপি মাহবুব’ নামে সমধিক পরিচিত মাহবুব উদ্দিন আহমদ বীরবিক্রম বর্তমানে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয়। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ছাত্রলীগে যুক্ত এবং তৎকালে ঢাকা হল ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল তিনি মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় (বর্তমানে মুজিবনগর) বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতিকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন। পরবর্তী সময়ে ৮ নম্বর সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত হন। ‘স্মৃতির পাতায় মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি’, ‘মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথা’, ‘বঙ্গবন্ধুকে যেমন দেখেছি’ ইত্যাদি বইয়ের এ লেখকের জন্ম বরিশালে ১৯৪৫ সালে। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সমকালের সহকারী সম্পাদক সাইফুর রহমান তপন।
সমকাল: মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ বীরত্বের জন্য আপনি রাষ্ট্রীয়ভাবে বীরবিক্রম খেতাব পেয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন কীভাবে?
মাহবুব উদ্দিন আহমদ: আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ্ হলের নির্বাচিত সহসভাপতি ছিলাম। ১৯৬৮ সালে সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে পুলিশ সার্ভিসে যোগ দিই। এক পর্যায়ে তৎকালীন গভর্নর হাউসে (আজকের বঙ্গভবন) এডিসি এবং ১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বরে তৎকালীন ঝিনাইদহ মহকুমার এসডিপিও বা মহকুমা পুলিশ কর্মকর্তা পদে নিযুক্ত হই। একাত্তরের ৭ মার্চ ছিলাম চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায়। সেখান থেকে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ শোনার জন্য চট্টগ্রাম শহরে যাই। কিন্তু ভাষণটি সেদিন বেতারে প্রচার হয়নি– আপনারা জানেন। ওই দিনই ঢাকায় চলে আসি। পুলিশ কন্ট্রোল রুমে বসে ৮ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনি। আমার মনে হলো, দেশে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে; নিজের কর্মএলাকায় যাওয়া দরকার।
সমকাল: ঝিনাইদহে ফিরলেন কবে?
মাহবুব উদ্দিন আহমদ: ১৭ মার্চ রওনা দিয়ে ১৮ মার্চ ঝিনাইদহে পৌঁছি। গিয়েই স্থানীয় এমপিএ, এমএনএ, আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে দেখা করি। বলি, বঙ্গবন্ধু তো যার যা আছে তা-ই নিয়ে প্রস্তুত হতে বলেছেন; ঢাকায় মেয়েরাও অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ নিচ্ছে; আপনারাও শুরু করুন, আমি সহায়তা করব। তারা রাজি হলেন। আমি পুলিশের সঙ্গে আনসার ও মুজাহিদ বাহিনীকে যুক্ত করে প্রশিক্ষণ শুরু করি। মূলত পুলিশ লাইন ও কেসি কলেজ মাঠে প্রশিক্ষণ চলে বাঁশের লাঠি ও গাদা বন্দুক দিয়ে। প্রশিক্ষণ চলাকালেই ২৩ মার্চ মেহেরপুরের তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, নড়াইলের কামাল সিদ্দিকী, সা’দত হোসাইনসহ আশপাশের মহকুমা প্রশাসক (এসডিও) বন্ধুরা আসেন আমার বাসস্থান ওয়াপদা কলোনির রেস্ট হাউসে। সিদ্ধান্ত নিই– যে কোনো অবস্থায় আমরা জনগণের সঙ্গে থাকব; আক্রমণ হলে আমরা তা প্রতিরোধ করব।
সমকাল: আপনি তো ২৫ মার্চ রাতেই প্রতিরোধ যুদ্ধে নেমে পড়েন–
মাহবুব উদ্দিন আহমদ: হ্যাঁ, ২৫ মার্চ রাত ১১টার দিকে যশোর থেকে এক টেলিফোন অপারেটর ফোন করে বলে– স্যার, বিশাল সেনা কনভয় আপনার এলাকার দিকে যাচ্ছে। আমি অবশ্য পরিস্থিতি আঁচ করে আগেই অস্ত্রাগার থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের মধ্যে অস্ত্র ও গোলা-বারুদ বণ্টনের নির্দেশ দিয়েছিলাম। যশোর থেকে ওই খবর আসার পর প্রতিরোধের আয়োজন করি। পরদিন ২৬ মার্চ ঝিনাইদহের সব প্রবেশপথে গাছ কেটে ব্যারিকেড দেওয়া হয়। শহরের বিভিন্ন এলাকায় বাঙ্কার ও ট্রেঞ্চ খনন করি। আমার অবস্থান ছিল বিষয়খালী। সেখানকার একটি কালভার্টের দু’পাশেই ট্রেঞ্চ খনন করে বস্তা দিয়ে ঢেকে ওপরে আলকাতরার ঢালাই দেওয়া হয়। ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ থেকে কিছুটা উত্তরে গাড়াগঞ্জে এক সেতুতে একই রকম ট্রেঞ্চ খনন করা হয়। এপ্রিলের ২/৩ তারিখে আমাদের সঙ্গে প্রথম যুদ্ধে দুই জায়গাতেই পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। আমরা কমান্ডার ছাড়া পাকিস্তানি সেনার সবাইকে খতম করে তাদের অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র দখল করি। তাদের কমান্ডার ছিল একজন কর্নেল। তাকে গ্রেপ্তার করে চুয়াডাঙ্গায় দায়িত্বরত মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর কাছে পাঠিয়ে দিই।
সমকাল: আপনি তো তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকেও ভারতে পৌঁছে দিয়েছিলেন।
মাহবুব উদ্দিন আহমদ: তাঁরা ২৭ মার্চ ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে পৌঁছে গিয়েছিলেন মাগুরায় এমএনএ সোহরাব হোসেনের বাড়ি। সেখান থেকে ডিঙি নৌকা দিয়ে মধুমতী নদী পার হয়ে ঝিনাইদহ আসেন। ২৯ মার্চ রাতেই আমার কাছে বার্তা আসে। খুব সকালে একটি গাড়ি পাঠাই। সেই গাড়িতে তারা স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আজিজ সাহেবের বাড়ি যান। সেখানে কিছু কাপড়চোপড় কিনে আমার গাড়িতে করেই তাদের মেহেরপুর সীমান্তে নিয়ে যাই। আমার সঙ্গে বন্ধু তৌফিক-ই-ইলাহীও ছিলেন। সীমান্তবর্তী একটি কালভার্টে তাদের বসিয়ে রেখে আমি ও তৌফিক ভারতে ঢুকে বিএসএফের এক ক্যাপ্টেনের সঙ্গে কথা বলি। তাঁকে নিয়ে এসে আমরা তাজউদ্দীন ও আমীর-উল ইসলাম সাহেবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই এবং তাঁর সঙ্গে আমরা সবাই বিএসএফ ক্যাম্পে গিয়ে গোলক মজুমদার ও কর্নেল চক্রবর্তীর সঙ্গে দেখা করি। তারা তাজউদ্দীন আহমদ ও আমীর-উল ইসলাম সাহেবকে কলকাতা নিয়ে যান।
সমকাল: মুজিবনগরে শপথ অনুষ্ঠানের আয়োজন সম্পর্কে বলুন।
মাহবুব উদ্দিন আহমদ: ১৩ এপ্রিল যশোর ক্যান্টনমেন্টের পথে বড়বাজার এলাকায় পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ হয়। সেখানে ওদের কিছু সৈন্য মারা গেলেও আমাদেরও অনেক হতাহত হয়। পরে গ্রামের ভেতর দিয়ে আমরা ঝিনাইদহে ফিরে আসি। ১৬ এপ্রিল মেহেরপুরের নেতাই এলাকায় চলে যাই। সেখান থেকে বৈদ্যনাথতলায় গিয়ে শুনি, একটা অনুষ্ঠান হবে। তৎকালীন ছাত্রনেতা রাজ্জাক ভাই সেখানে এসেছিলেন; লোকজনকে জাতীয় সংগীত রিহার্সেলের কথা বলে গেছেন। রাতে নেতাই থেকে পরদিন ১৭ এপ্রিল আবার বৈদ্যনাথতলায় যাই সকাল ৯টা-সাড়ে ৯টার দিকে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে অংশ নিতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলীসহ সব নেতা এলেন বেলা ১১টার দিকে। সঙ্গে দেশি-বিদেশি বহু সাংবাদিক।
সমকাল: অস্থায়ী রাষ্ট্রপতিকে গার্ড অব অনার প্রদানের দায়িত্ব পেলেন কীভাবে?
মাহবুব উদ্দিন আহমদ: ওখানে জাতীয় সংগীত পরিবেশনা, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের পরিচিতি, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠের পর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতিকে গার্ড অব অনার প্রদানের বিষয়টি আসে। এই গার্ড অব অনার প্রদানের কথা ছিল মেজর আবু ওসমান সাহেবের। কিন্তু তিনি প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে অনুষ্ঠানস্থলে আসতে দেরি করেন। তখন দায়িত্বটা আমার ওপর আসে।
সমকাল: আপনার তখনকার অনুভূতি কেমন ছিল?
মাহবুব উদ্দিন আহমদ: সেটা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়; ভীষণ আবেগ কাজ করছিল তখন। আমার কাছে মনে হচ্ছিল, আমাদের একটা পতাকা হয়েছে, সংবিধান আছে, স্বতন্ত্র ভূখণ্ড আছে, একটা সরকারও গঠিত হলো, আর এই গার্ড অব অনারের মধ্য দিয়ে পুরো বিশ্বকে দেখিয়ে দিলাম– আমাদের একটা সেনাবাহিনীও আছে। আমার মনে হয়েছে, গার্ড অব অনার আমাদের রাষ্ট্রকে পূর্ণতা দিল। এটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠতম মুহূর্ত।
সমকাল: আপনি তো সেনাবাহিনীর লোক ছিলেন না।
মাহবুব উদ্দিন আহমদ: আমি পুলিশ বাহিনীর সদস্য হলেও তৎকালীন সেনাপ্রধান আতাউল গনী ওসমানী ওই অনুষ্ঠানের আগে আমাকে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের (ইপিআর) ক্যাপ পরিয়ে ক্যাপ্টেন পদ দিয়েছিলেন। যুদ্ধকালে আমাকে মেজর পদেও প্রমোশন দেওয়া হয়। গার্ড অব অনারে পুলিশের সঙ্গে ইপিআর সদস্যরাও অংশ নিয়েছিলেন।
সমকাল: শেষ প্রশ্ন, আপনি যে স্বপ্ন নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন, তা কি পূরণ হয়েছে?
মাহবুব উদ্দিন আহমদ: আমি যুদ্ধে গিয়েছি কিছু পাওয়ার জন্য নয়; মাকে ভালোবেসে, মায়ের ওপর অত্যাচারের প্রতিবাদে। আমি মনে করি, বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ড এবং পরবর্তী দীর্ঘ সময় দেশ পাকিস্তানি ধারায় শাসিত না হলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন বহু আগেই বাস্তবায়িত হতো। বর্তমান সরকার চেষ্টা করছে বঙ্গবন্ধুর ধারায় দেশটির সার্বিক উন্নয়ন ঘটাতে।
সমকাল: মুজিবনগর দিবসের প্রাক্কালে আমাদের সময় দেওয়ায় আপনাকে ধন্যবাদ।
মাহবুব উদ্দিন আহমদ: সমকালকেও ধন্যবাদ।
- বিষয় :
- সাক্ষাৎকার