ঢাকা বুধবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪

সমকালীন প্রসঙ্গ

কূটনৈতিক সফর নিয়ে অহেতুক রাজনৈতিক বিতর্ক

কূটনৈতিক সফর নিয়ে অহেতুক রাজনৈতিক বিতর্ক

এম হুমায়ুন কবির

এম হুমায়ুন কবির

প্রকাশ: ১৬ মে ২০২৪ | ০২:১০

ডোনাল্ড লু হলেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী। অর্থাৎ এ অঞ্চল তাঁর কর্মক্ষেত্র; সে সূত্রেই তাঁর ঢাকা আগমন। ভারত ও শ্রীলঙ্কা হয়ে তিনি বাংলাদেশে এসেছেন। তাঁর এবারের সফর ঘিরে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে যে বাদানুবাদ দেখেছি, তা নেহাতই অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর। এর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি বা ডোনাল্ড লুর সফরের সম্পর্ক রয়েছে বলে মনে হয় না। 

এটা সত্য, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে স্পষ্ট কিছু মতামত দেওয়া হয়েছিল। নির্বাচনের পরও ওয়াশিংটন তার অবস্থান স্পষ্ট করেছে। এটা নিয়ে ক্ষমতাসীন দল বা সরকারের খানিকটা অস্বস্তি থাকতে পারে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক যতটা গভীর ও বিস্তৃত; নিছক রাজনৈতিক দলের পক্ষ-বিপক্ষ অবস্থানের মাধ্যমে তা নির্ধারিত ও পরিবর্তিত হওয়ার সুযোগ নেই।

আমরা জানি, বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির গন্তব্য দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র এক নম্বরে। সেদিক থেকে ডোনাল্ড লুর সফরের সঙ্গে আমাদের রপ্তানির বিষয় জড়িত না থাকার কোনো কারণ নেই। রপ্তানি ছাড়াও কর্মসংস্থান ও বাণিজ্যের জন্যও বাংলাদেশে বিনিয়োগ প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্র সম্ভাব্য বিনিয়োগকারী হতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলার বিষয়ও আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রও বলছে, জলবায়ুর অভিঘাতে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত; তা মোকাবিলায় প্রযুক্তি হস্তান্তর ও আর্থিক সহায়তার ক্ষেত্রেও আমরা একসঙ্গে কাজ করতে পারি।   

দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বাইরেও আঞ্চলিক বিষয় ‘ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি’ যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকারে রয়েছে। তারা এ বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। আমাদের প্রয়োজন মাথায় রেখে আমরা যদি তাদের সঙ্গে কাজ করতে পারি, তবে সেখানেও লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। যেমন দুর্যোগ মোকাবিলা, আঞ্চলিক ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অন্যান্য অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হলে আমরা ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলও কাজে লাগাতে পারি।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন, মার্কিন প্রশাসন থেকে যারাই বাংলাদেশ সফর করুক না কেন, আমরা সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যেই একসঙ্গে কাজ করব। তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দুটি বিশেষ আলোচনার বিষয়ে বলেছেন: ভিসা নীতি ও র‍্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা। নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অযাচিত হস্তক্ষেপ বা প্রভাব বিস্তারের কারণে বাংলাদেশে এই ভিসা নীতি প্রয়োগ করা হতে পারে। এমনকি এরই মধ্যে বেশ কিছু ব্যক্তির ওপর এই নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে বলেও জানায় যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ঠিক কাদের ওপর এই ভিসা নীতি প্রয়োগ হয়েছে, তা আমরা জানি না। তারা কিছু ক্যাটেগরি দিয়েছিল যে, যারা এ ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকবে, তাদের ক্ষেত্রে এটা প্রয়োগ হবে। তবে প্রয়োগটা যে জনসমক্ষে হবে না– তাও তারা বলে দিয়েছিল। 

যে কোনো দেশের ভাবমূর্তির ক্ষেত্রেই মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞার নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। সে কারণে বাংলাদেশ সরকারও বিষয়টি নিয়ে আলোচনাকে অগ্রাধিকারে রেখেছে। আর র‍্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা যে কারণে দেওয়া হয়েছিল, সেই মানবাধিকার বিষয়ে দৃশ্যমান অগ্রগতি ছাড়াই তারা তা উঠিয়ে নেওয়ার কথা ভাববে না। তবে এ ক্ষেত্রেও আলোচনার অবকাশ তো রয়েছেই।  

আমি মনে করি, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বহুমাত্রিক দিক থেকে দেখতে হবে। দু-একটি জায়গায় মতপার্থক্য থাকলেই যে সম্পর্কে টানাপোড়েন ঘটবে, ব্যাপারটি তা নয়। আমাদের কিছু বিষয়ে তাদের পর্যবেক্ষণ আছে। যেমন– গত মাসে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়, সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওই প্রতিবেদনকে ‘ত্রুটিপূর্ণ’ বলেছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। অর্থাৎ এ বিষয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। কিন্তু মতপার্থক্য ধরে বসে থাকলে হবে না। বরং তাদের সঙ্গে যেসব বিষয়ে ঐকমত্য রয়েছে, সেগুলোর দিকে মনোযোগ দিয়ে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়াই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর যদিও এটি যুক্তরাষ্ট্র থেকে বড় কোনো কর্মকর্তার প্রথম সফর, বর্তমান সরকার টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায়। ফলে যুক্তরাষ্ট্র যেমন বর্তমান সরকারকে চেনে, তেমনি বর্তমান সরকারের জন্যও যুক্তরাষ্ট্রকে ‘ডিল’ করা নতুন কিছু নয়। সে জন্য সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ অস্বাভাবিক নয়। কিছু বিষয়ে মতানৈক্য রেখেই ঢাকা-ওয়াশিংটন ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব বলে আমি মনে করি। 

আর আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকট নিজেদেরই সমাধান করা উচিত। বিদেশি কেউ এসে আমাদের সমস্যার সমাধান করে দেবে– এ চিন্তা ঠিক নয়। সে জন্য এমন কারও সফর ঘিরে উত্তেজনা তৈরি করার কিছু নেই। যদিও নির্বাচনের আগে ডোনাল্ড লু দুই দফায় বাংলাদেশে এসেছিলেন। ওই সফরগুলোতে নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারকে নানা পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। খেয়াল করার বিষয়, এবার ডোনাল্ড লুর সফরে সেই অর্থে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত বৈঠকও নেই। 

বস্তুত ডোনাল্ড লু বাংলাদেশে আসার আগেই ১০ মে তাঁর সফর সম্পর্কে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল। সেখানে ঢাকা সফরে সরকারি কর্তাব্যক্তি, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়টি যেমন বলা হয়, তেমনি জলবায়ু সংকট মোকাবিলা, বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক ও সহযোগিতা নিয়ে আলোচনার বিষয়ও গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করা হয়। ডোনাল্ড লুর দু’দিনের সফরে তারই প্রতিফলন দেখা গেছে। 

আগেও বলেছি, অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্ক এখন বিস্তৃত ও গভীর। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এই সম্পর্ক এ ধরনের সফরগুলোয় কাজে লাগাতে হবে। রপ্তানি, রেমিট্যান্স, বিনিয়োগ প্রভৃতি বিষয় ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র যে বাংলাদেশে ‘টাইম-টেস্টেড’ বন্ধু– কভিড অতিমারির সময়ও সেটা আরেকবার প্রমাণ হয়েছে। করোনা ভ্যাকসিন দিয়ে যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি সহায়তা করেছে, যুক্তরাষ্ট্র তার প্রথম সারিতে। রোহিঙ্গা ইস্যুতেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। আগামী দিনেও ডিজিটাল অর্থনীতি, জলবায়ু পরিবর্তন ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজে তাদের আগ্রহ অবশ্যই রয়েছে। ডোনাল্ড লুর সফরে সেই ইঙ্গিতই স্পষ্ট।

এম হুমায়ুন কবির: যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত

whatsapp follow image

আরও পড়ুন

×