সমকালীন প্রসঙ্গ
দুর্নীতিবাজদের বাজেয়াপ্ত অর্থ দিয়ে তিস্তা প্রকল্প হোক

মো. ফখরুল ইসলাম
মো. ফখরুল ইসলাম
প্রকাশ: ০৮ জুলাই ২০২৪ | ২৩:৫৪
গত ২১-২২ জুন ভারত সফর করেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু এবারও তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে কোনো সুরাহা হয়নি। বরং চীনের সহযোগিতায় বাংলাদেশ যে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চাইছিল, সেটাতেও অর্থায়নে আগ্রহ প্রকাশ করেছে ভারত। এর মধ্য দিয়ে মহাপরিকল্পনাটি মূলত ঝুলে গেল। সফর শেষে ঢাকায় ফিরে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে এটা স্পষ্ট– ওই মহাপরিকল্পনায় চীনের অংশগ্রহণ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। আবার ভারতের অর্থায়ন কবে, কীভাবে হবে– সেটাও স্পষ্ট নয়।
বাংলাদেশের মানুষ ভারতের প্রতি যে বহুবিধ বিষয়ে কৃতজ্ঞ, সেটা প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক ভারত সফরেও প্রকাশিত হয়েছে। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ভারত সফরে গিয়ে তিনি সংবাদমাধ্যমের কাছে হিন্দিতে বলেছিলেন, ‘হাম হামেশা আভারি হু ভারত কি ওর।’ বাংলা অর্থ– ‘আমরা সবসময়ই ভারতের কাছে কৃতজ্ঞ।’ কিন্তু তিস্তার পানি সমস্যা সমাধানের জন্য ভারত বারবার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও তা ভঙ্গ করছে।
মনে আছে, ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের আগে দুই দেশের পানিসম্পদমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির বিষয়ে দুই পক্ষ একমত হয়েছিল। মনমোহন সিংয়ের সফরেই বহু প্রতীক্ষিত তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি হওয়ার কথা থাকলেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতায় তা আটকে যায়। নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সরকার ভারতের ক্ষমতায় আসার পর তিস্তা চুক্তি নিয়ে আশার কথা শোনা গেলেও মমতার মত বদলায়নি। বরং তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘আগে নিজে খাব, পরে তো দেব’ (দৈনিক ইত্তেফাক, ৮ মার্চ ২০২১)। দীর্ঘ ১২ বছর পর ২০২২ সালে যৌথ নদী কমিশনের মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক বসেছিল। ভাবা হচ্ছিল, সেখানে তিস্তা চুক্তির এজেন্ডা চূড়ান্ত করে প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে এর একটি সফল পরিসমাপ্তি ঘটবে। বাস্তবে সেটা হয়নি।
শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় তিস্তা প্রসঙ্গ উত্থাপন করার প্রতিক্রিয়া হিসেবে গত ২৩ জুন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তার পানি ভাগাভাগি সম্ভব নয়। এ সবকিছুই এখন গোলেমেলে মনে হচ্ছে!
আমি মনে করি, তিস্তা সমস্যার সমাধান তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি দিয়েই করতে হবে। তার আপাতত কোনো বিকল্প নেই। কারণ চীনের সঙ্গে তিস্তা পুনরুজ্জীবন ও সংরক্ষণ সংক্রান্ত প্রকল্পের একটি সফল বাস্তবায়ন করতে হলে ভারতের বিশেষ সহযোগিতা প্রয়োজন।
প্রধানমন্ত্রী মোদি ২০১৯ সালের ৫ অক্টোবর বলেছেন, দ্রুততম সময়ে তিস্তা চুক্তি করা হবে। প্রধানমন্ত্রী মোদি কি এ বিষয়ে মমতার সঙ্গে পরামর্শ করে বলেছিলেন? কারণ ২০১৭ সালে আমরা দেখেছি কেন্দ্রকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তোয়াক্কা করেন না। ২০২১, ২০২২ ও আজ ২০২৪ সালে উভয় দেশের অমীমাংসিত সমস্যাগুলো সমাধানে একটি বড় সুযোগ এলেও তিস্তা প্রসঙ্গ নিয়ে নানা বাগড়া বসানো হয়েছে।
এই দফায় বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক গত ২২ জুন শেষ হয়েছে। বৈঠকের পর যৌথ ঘোষণায় দুই দেশের অনেক চুক্তির ব্যাপারে সমঝোতা হয়েছে। কিন্তু ৩৩ বছর ধরে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে যে আশা, সেটা আবারও অবহেলায় ফাইলবন্দি হিসেবে থেকে গেছে।
তিস্তার ব্যাপারে ২০২২ সালে কোনো আশ্বাসও দেওয়া হয়নি। ২০২৪ সালে এজেন্ডাতেই বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত নেই। যে আশ্বাস আগের দুই যৌথ ঘোষণায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দিয়েছিলেন। এবার এ বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি। এ বিষয়ে নানা ধরনের তথ্য শুনে মনে হচ্ছে, তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার উভয়ের গভীর অনিচ্ছার মধ্যে তিস্তা ইস্যু নিয়ে টালবাহানা করা হয়েছে এবং হচ্ছে।
আগেও কয়েকটি নিবন্ধে উল্লেখ করেছি, চীনের সঙ্গে তিস্তা পুনরুজ্জীবন ও সংরক্ষণ সংক্রান্ত প্রকল্পের সফল বাস্তবায়ন করতে গেলেও ভারতের বিশেষ সহযোগিতা প্রয়োজন। কিন্তু তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে দেশটির কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের দ্বন্দ্ব সেটার পথে উভয়ের গভীর অনিচ্ছার মধ্যে পর্যবসিত তিস্তা ইস্যু নিয়ে বারবার টালবাহানা করে কালক্ষেপণ করাটা বন্ধুত্বের অংশ হতে পারে না।
এখন আমাদের কৃতজ্ঞচিত্তে বারবার ব্যর্থ হয়ে আর কোনো শুকনো দাবি না করে বিকল্প উপায়ে অটল থাকা উচিত। চীনের সঙ্গে তিস্তা পুনরুজ্জীবন ও সংরক্ষণ সংক্রান্ত প্রকল্পের মাধ্যমে বিকল্প উপায় খুঁজে বের করেছিল বাংলাদেশ।
কথা হচ্ছে, বিকল্প যে পরিকল্পনা করা হয়েছে, সেটাতেই নিবিষ্ট থাকতে সমস্যা কোথায়? তিস্তার চরাঞ্চলে জলাধারে বর্ষার পানি ধরে রেখে মাছ চাষ ও সারাবছর সেচ কাজের ব্যবস্থা আমাদেরকেই করতে হবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, এ জন্য যে অনেক অর্থ দরকার, সেটা কোথায় পাব? ভারত যদি অর্থায়ন করেও, সেটা কবে কীভাবে? আর ভারতের কাছ থেকে ন্যায্য পানি না পেয়ে অর্থায়নের প্রস্তাবে সাড়া দেওয়া কতটা উচিত হবে? আরও গভীরভাবে ভেবে ভারতের অর্থায়নের প্রস্তাবে সাড়া দেওয়া বা না দেওয়ার বিষয়টি সুরাহা করা উচিত। কারণ, আমাদের নিজস্ব অর্থায়নের অভাব নেই। দিকে দিকে মেগা দুর্নীতিবাজদের কুক্ষিগত করা অর্থসম্পদ বাজেয়াপ্ত করার দাবি খোদ ক্ষমতাসীন মহল থেকেই শোনা যাচ্ছে। তাহলে তিস্তা পুনরুজ্জীবন প্রকল্প নিয়ে চীন-ভারতের ঠান্ডা লড়াইয়ের মধ্যে না গিয়ে আমাদের নিজস্ব অর্থায়নের তহবিল সংগ্রহ করা হোক। চাউর হওয়া দু-চারজন মেগা দুর্নীতিবাজের বাজেয়াপ্ত করা অর্থ দিয়েই তিস্তা পুনরুজ্জীবন ও সংরক্ষণ প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন করতে দোষের কী?
ড. মো. ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের প্রাক্তন ডিন
fakrul@ru.ac.bd
- বিষয় :
- সমকালীন প্রসঙ্গ