ঢাকা বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

সাক্ষাৎকার: সলিমুল্লাহ খান

পরিস্থিতি এখন খোলা থেকে আগুনে, আগুন থেকে খোলায়

পরিস্থিতি এখন খোলা থেকে আগুনে, আগুন থেকে খোলায়

সলিমুল্লাহ খান

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সমকালের সহযোগী সম্পাদক শেখ রোকন ও সহ-সম্পাদক ইফতেখারুল ইসলাম

প্রকাশ: ১০ আগস্ট ২০২৪ | ২২:৪৪ | আপডেট: ১১ আগস্ট ২০২৪ | ১২:৫৫

সলিমুল্লাহ খান বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের অধ্যাপক। তাঁর রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘বাংলাদেশ: জাতীয় অবস্থার চালচিত্র’, ‘বেহাত বিপ্লব ১৯৭১’, ‘আদমবোমা’, ‘স্বাধীনতা ব্যবসায়’, ‘প্রার্থনা’, ‘ঠাকুরের মাৎস্যন্যায়’, ‘উৎসর্গ’ এবং ‘গরিবের রবীন্দ্রনাথ’। প্রকাশিতব্য ‘আ মরি আহমদ ছফা’। পড়াশোনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ও যুক্তরাষ্ট্রের নিউ স্কুল ফর সোশ্যাল রিসার্চে। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৮৩-৮৪), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ (১৯৮৪-৮৬) দেশি-বিদেশি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। তাঁর পড়াশোনা আইনশাস্ত্র, ধ্রুপদি অর্থশাস্ত্র, ফ্রয়েডীয় মনোস্তত্ত্ব, দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি, ইতিহাস ও সাহিত্য বিষয়ে। তিনি ১৯৫৮ সালে কক্সবাজার জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সমকালের সহযোগী সম্পাদক শেখ রোকন ও সহ-সম্পাদক ইফতেখারুল ইসলাম।

সমকাল: অনেকে বলছেন দেশে গণবিপ্লব ঘটে গেছে, অনেকে বলছেন এটা গণঅভ্যুত্থান। এই দুটির মধ্যে ধারণাগত পার্থক্য কী?

সলিমুল্লাহ খান: বিদ্রোহ, অভ্যুত্থান আর বিপ্লবের মধ্যে পার্থক্য আছে। যদি কোনো শ্রেণি বা পেশার লোক অভ্যুত্থান বা ‘আপরাইজিং’ করেন, সেটা বিদ্রোহ। যেমন আনসার বিদ্রোহ, বিডিআর বিদ্রোহ। যখন কোনো অভ্যুত্থানে নানান শ্রেণি ও পেশার অর্থাৎ সর্বস্তরের লোকজন শরিক হন, তখন তা হয় গণঅভ্যুত্থান। একটু পেছনে যাওয়া যাক। ১৮৫৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশে একটা গণবিপ্লব ঘটেছিল। শুধু সিপাহি নন, গৃহস্থ কৃষক, এমনকি জমিদার-তালুকদাররাও তাতে যোগ দিয়েছিলেন। ইংরেজরা এটা আড়াল করার অনেক চেষ্টা করেছিলেন। তারা এই ঘটনার নাম দিয়েছিলেন ‘সিপয় মিউটিনি’ বা সিপাহি বিদ্রোহ। যেন বা শুধু সিপাহিরাই বিদ্রোহ করেছেন। পরে তারাও বাধ্য হয়ে স্বীকার করেছিলেন যে, ঘটনাটা ছিল গণবিপ্লব। গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে বিপ্লবের সম্ভাবনা থাকে। তবে গণঅভ্যুত্থান বিপ্লব হবে কিনা, সেটা নির্ভর করে অভ্যুত্থান-পরবর্তী কার্যক্রমের ওপর।

সমকাল: কোটা সংস্কার আন্দোলন কি গণঅভ্যুত্থান, না গণবিপ্লব?

সলিমুল্লাহ খান: আমাদের দেশে বর্তমান কোটা বন্দোবস্ত প্রবর্তিত হয় সেই ১৯৭২ সাল থেকে। সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলন মূলত গণতন্ত্রের আন্দোলন, গণতান্ত্রিক সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। কোটা একটা উপসর্গ মাত্র। ২০০৮ সাল থেকে শুরু করে পরপর চারটা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জিতেছে বলে দাবি করেছিল। খুব সম্ভবত তারা শুধু প্রথমটাতে, ২০০৮ সালে, জিতেছিল এবং সেটাও দেশি-বিদেশি নানা সহায়ক শক্তির কারণে। যদি সত্যিকার প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতো, তাহলে অন্য কোনো দল বা জোট ক্ষমতায় আসতে পারত। এই সত্যকেও অস্বীকার করার মতলবে ক্ষমতায় আসার পর প্রথমেই তারা সংবিধান সংশোধন করেছিল। ওটা ত্রয়োদশ সংশোধনী বলে পরিচিত। নিজেদের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার জন্য তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছিল। তবে সত্যের খাতিরে স্বীকার করতে হয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাও ত্রুটিহীন ছিল না। ২০১৪, ২০১৮, ২০২৪ সালে (পরপর তিনটি নির্বাচনে) সম্পূর্ণ জালিয়াতির মধ্যস্থতায় তারা জোরপূর্বক নির্বাচনে জেতার চেষ্টা করে বিদ্যমান নির্বাচনী ব্যবস্থা ষোলআনাই ধ্বংস করে দিয়েছে। সবাই জানেন, নির্বাচন ব্যবস্থাই প্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রের ভিত্তি। নির্বাচনের মাধ্যমেই সীমিত আকারে হলেও জনগণের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। সেটাকেও যদি নস্যাৎ করে দেওয়া হয়, তাহলে সরকারের বা রাষ্ট্রক্ষমতার কোনো নৈতিক ভিত্তি বা বৈধতা থাকে না। নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের পথ যেহেতু অবরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল, কোটা সংস্কার আন্দোলনের অসিলায় জনগণ শক্তি প্রয়োগের পথ ধরে সার্বভৌম ইচ্ছার প্রকাশ ঘটিয়েছে। এটাই হলো ঘটনার গোড়া।

সমকাল: তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ত্রুটিহীন নয় কেন?

সলিমুল্লাহ খান: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে ত্রুটি ছিল, বিএনপি তা হাতেকলমে অর্থাৎ সরেজমিন প্রমাণ করেছিল। সেই ত্রুটির সুবাদেই সামরিক বাহিনী হস্তক্ষেপের সুযোগ গ্রহণ করে। সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে ২০০৭ সালে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারেও জালিয়াতির অনুপ্রবেশ ঘটে। সেই হস্তক্ষেপের দু’বছর পর ২০০৮ সালের শেষ নাগাদ অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। তারপর তারা মনে করল, চিরকাল ক্ষমতায় থাকবে। আওয়ামী লীগ সরকার হয়ে উঠেছিল একটি সম্পূর্ণ স্বৈরতন্ত্র বা টিরানি। এর সামাজিক ভিত্তি ছিল একটা অলিগার্কি বা দুর্বৃত্ত অর্থনীতি। অনেকে সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারকে ‘ফ্যাসিবাদী’ সরকার বলত। প্রকৃত প্রস্তাবে সেটা ছিল ফ্যাসিবাদের চেয়েও খারাপ। এর মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ একটা নৈতিক অধঃপতনের ইতিহাস তৈরি করেছে।

সমকাল: আওয়ামী লীগ তো আগেও ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে। এবারেরটিকে ইতিহাস বলছেন কেন?

সলিমুল্লাহ খান: ১৯৭৫ সালের ঘটনাটা ছিল এক অর্থে ট্র্যাজেডি, আর সেই মাপে বললে ২০২৪ সালের ঘটনা হলো প্রহসন বিশেষ। কারণ শেখ হাসিনা পলায়ন করেছেন। এতে নাটকের হাস্যকর উপসংহার রচিত হলো। তিনি যদি দেশে বন্দি হয়ে থাকতেন, ভবিষ্যতে তাঁর ঝাঁসির রানীর মতো ভাবমূর্তি তৈরি হলেও হতে পারত। তিনি সেই নৈতিক সাহস দেখাতে পারেননি। এর কারণ দুর্নীতিতে দেশটা কতখানি ভরে গিয়েছিল, তা তিনি জানতেন। বর্তমান অভ্যুত্থানটির ব্যাপ্তি তাই ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের চেয়েও বেশি হয়েছে। দেশে ও গ্রামে, শহর থেকে শহরে এই অভ্যুত্থান বিস্তৃত হয়েছে। যেমন ধরুন, ১৯৯০ সালের আন্দোলনে এতগুলো জেল-কারাগার ভাঙার ঘটনা ঘটেনি, যেমনটি এবার হয়েছে।

সমকাল: আপনি একটি টিভিতে বলেছিলেন, ‘মানুষ যখন তথাকথিত উন্নয়নের প্রতীকে আক্রমণ করে, সেটা প্রথমে দুর্ঘটনা মনে হলেও এর পেছনে কারণ রয়েছে।’ আপনি কি সহিংস প্রতিবাদের নতুন ব্যাখ্যা দিতে চাইছেন?

সলিমুল্লাহ খান: এই কথা বলে আমি অকারণ সহিংসতা সমর্থন করছিলাম না। শুধু জিজ্ঞাসা করছিলাম, মানুষের ক্ষোভ সেতু ভবন, বাংলাদেশ টেলিভিশন বা মেট্রোরেল স্টেশনে গিয়ে পড়ল কেন? এসব তো জাতীয় সম্পদ। তদুপরি গত কয়েক বছর ধরে শেখ হাসিনা সরকার পদ্মা সেতু আর মেট্রোরেলকে ‘তাদের দেওয়া’ উন্নয়নের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেছে। অথচ গণপরিবহন উন্নয়ন করার জন্য দরকার ছিল একটা সামগ্রিক উন্নয়ন পরিকল্পনা। যেখানে একটা জাতীয় গণপরিবহন ব্যবস্থা দরকার, আপনি সে রকম কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন না করে উটকো একটা মেট্রোরেল ব্যবস্থার প্রস্তাব করলেন। অর্থাৎ গৌরববৃদ্ধির জন্য, হিল্লি-দিল্লির মতো আপনারও একটা মেট্রোরেল থাকবে বলে অর্থের অপব্যয় করলেন। আওয়ামী লীগ দলের লোকেরা বলছেন, এটা যখন পূর্ণ উদ্যমে চালু হবে, তাতে বড়জোর ঢাকা শহরের শতকরা ৯ জন লোকের যাতায়াতের প্রয়োজন মেটাবে। আমি নিজেও একবার মেট্রোরেলে উত্তরা থেকে ফার্মগেট গিয়েছিলাম। ফার্মগেট নামতে প্রাণ বেরিয়ে যায় যায় দশা। আপনি আগে কেন গণপরিবহনের জন্য যথোপযুক্ত, সর্বজনীন বাসসেবা চালু করবেন না? মেট্রোরেল প্রকল্পের একটি লাইনেই কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এর চেয়ে অনেক কম খরচে অনেক বেশি লোকের জন্য বাসভিত্তিক পরিবহন সেবা চালু করা সম্ভব ছিল। প্রচারণা আছে, মেট্রোরেলে ৩০ মিনিটে উত্তরা থেকে মতিঝিল যাওয়া যায়। কিন্তু এই পথ পাড়ি দিতে অন্য সব মানুষের তো তিন ঘণ্টার মতো লাগছে। এই কথা বলে আমি একমাত্র মেট্রোরেলের বিরোধিতা করছি না, পরিবহন ব্যবস্থা সম্পর্কে বিপুল অজ্ঞতা ও অবহেলার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি মাত্র।

সমকাল: শতভাগ মানুষের জন্য মেট্রোরেল করার অর্থনৈতিক সামর্থ্য থাকতে হবে না? 

সলিমুল্লাহ খান: কী পরিমাণ টাকাপয়সা বিদেশে পাচার হয়েছে তার খবর এখন তো আমরা কিছু কিছু পাচ্ছি। অতএব জানতে হবে, ঝামেলাটা অন্য কোথায়ও। অনেকে বলছেন, বর্তমানে বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার পথে দাঁড়িয়েছে। তার প্রমাণ তো আমরা মাঠে-ময়দানে কোথাও দেখছি না। বরং দেখছি ব্যাপক বেকারত্ব, অন্ধ দারিদ্র্য। বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় ৩ হাজার ডলারের কাছাকাছি। সর্বনিম্ন আয় বার্ষিক ৩ হাজার ডলার ধরলে এদেশে শতকরা ৯০ জন লোক সত্যিকার দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। এই দরিদ্র সাধারণের চোখে মেট্রোরেল ধরা পড়েছিল অত্যাচারের প্রতীক, অন্যায়ের প্রতীক হিসেবে। এটা একটা উদাহরণ মাত্র।

সমকাল: ধানমন্ডি ৩২ নম্বর পুড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপারে যুক্তি কী?

সলিমুল্লাহ খান: একই ধরনের একটি প্রশ্ন বিদেশি সাংবাদিকরা মুহাম্মদ ইউনূসকে করেছিলেন। পত্রিকায় পড়লাম। তিনি বলেছেন, ‘আমাকে জিজ্ঞেস না করে শেখ মুজিবের কন্যাকে জিজ্ঞেস করুন।’ আবদুল কাদের সিদ্দিকীও বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনা এক নয়।’ কথাটা একেবারে অযৌক্তিক নয়। তবে শেখ হাসিনা তো নিজ ক্ষমতার বৈধতা দাবি করেছেন তাঁর পিতার কথা বলে, পরিবার-পরিজনের করুণ মৃত্যুর দোহাই দিয়ে। ‘আমি বঙ্গবন্ধুর কন্যা, আমার বাবা এই দেশটা স্বাধীন করে দিয়েছেন। আমি জাতির পিতার কন্যা; সুতরাং আমাকে আপনাদের ভোটের মুখাপেক্ষী হতে হবে না।’ এই ভাবের মধ্য দিয়ে তিনি প্রকৃতপক্ষে রাজতন্ত্র কায়েমের দাবিই তুলে ধরেছিলেন। সবিনয়ে নিবেদন করি, শেখ সাহেবও একই ভুল করেছিলেন। বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা প্রথম বিপর্যস্ত হয়েছিল ১৯৭৩ সালে। খন্দকার মুশতাক আহমদ তো শেখ সাহেবের দলেরই নেতা। তিনি ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে যখন পরাজিত হলেন তখন ভোট গণনায় জালিয়াতির মাধ্যমে তাঁকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়। শেখ সাহেব নিঃসন্দেহে অনেক বড় মাপের জাতীয় নেতা ছিলেন, তাই তাঁর ভুলগুলোও ছিল একটু বড় মাপের।
লোকে বলে, শেখ হাসিনা যদি ১৪ জুলাই তারিখের বক্তৃতাটা না দিতেন, কিংবা দিতেন ভিন্নভাবে, হয়তো তাঁকে এ রকম চরম পরিণতি বরণ অর্থাৎ পলায়ন করতে হতো না। কিন্তু তিনি আগে অপরাধ যা যা করেছেন তাঁর দোষে, তাঁর পাপে শশব্যস্ত পলায়নের চেয়ে ভালো আর কিছু করার উপায় তাঁর ছিল না।

সমকাল: এখন তাহলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াল?

সলিমুল্লাহ খান: আহমদ ছফার একটা কথার সারমর্ম বলি। যে মানুষকে প্রতিদিন পরের কথা ধার করে চিন্তা করতে হয়, পরের কথায় ওঠবস করতে হয়, সে মানুষকে একবার আগুন থেকে খোলায়, আবার খোলা থেকে আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়। বাংলাদেশ এখন স্বৈরতন্ত্রের খোলা থেকে অজানাতন্ত্রের আগুনে পড়েছে। আল্লাহ মালুম, এই খোলা থেকে আমরা আবার কোনো আগুনে না পড়ি! পড়লে যে পুড়তে হয়, সে কথা কে না জানে!

সমকাল: আপনার সম্পাদিত একটি গ্রন্থের নাম ‘বেহাত বিপ্লব ১৯৭১’। এবারের গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে সেটা কতটা প্রাসঙ্গিক?

সলিমুল্লাহ খান: ‘বেহাত বিপ্লব’ বইটির একটা ইতিহাস আছে। আহমদ ছফা ১৯৭৭ সালে একটা ছোট্ট বই লিখেছিলেন। নাম ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক জটিলতা’। বইটি প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। কারণ সেকালের সামরিক (জিয়াউর রহমান) সরকারের আমলে বইটি বেআইনি কায়দায় বাজেয়াপ্ত করা হয়। বইটির পুনর্মুদ্রণ উপলক্ষে ২০০৭ সালে ‘বেহাত বিপ্লব’ গ্রন্থের জন্ম। আহমদ ছফা ওই সময়ে লিখেছিলেন, হতে পারে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ফল অপরে আত্মসাৎ করেছে। আমরাও মনে করি, ১৯৭১ সালের যে অঙ্গীকার সেটাকে শেখ হাসিনা সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নামে একান্ত বিকৃতই করেছিলেন। সেই পরিস্থিতি থেকে মুক্তিই ছিল এবারের গণঅভ্যুত্থানের লক্ষ্য। দুঃখের মধ্যে, এখন পর্যন্ত এটারও বেহাত হওয়ার সম্ভাবনা পনেরো আনা। ‘বেহাত বিপ্লব’ শব্দবন্ধটি আহমদ ছফা নিজে এস্তেমাল করেননি, এটা আমাদের ব্যাখ্যা। কথাটা আমি ইংরেজি ‘প্যাসিভ রেভুলিউশন’ থেকে ধার নিয়েছিলাম। এই শব্দবন্ধের প্রণেতা ইতালির দার্শনিক আন্তনিয়ো গ্রামসি নিজেও এটা ধার নিয়েছিলেন অষ্টাদশ শতাব্দীর এক ইতালীয় সাংবাদিকের দপ্তর থেকে।

সমকাল: এবারের গণঅভ্যুত্থান বেহাত হওয়ার আশঙ্কা পনেরো আনা কেন?

সলিমুল্লাহ খান: এর উত্তর দেওয়া কঠিন। ১৯৭১ দিয়েই না হয় ব্যাখ্যা করি। ওই মুহূর্তে আমাদের মানুষের মনের আকাঙ্ক্ষা ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক সুবিচার। এই তিনটি আকাঙ্ক্ষাই ১৯৭২ সালের পর থেকে একে একে পরাস্ত হতে থাকে। দেশ আবার সেই পুরাতন আমলাতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় ফিরে যায়। পাকিস্তান যুগের সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের পুনরুত্থান ঘটে। একাত্তর বিপ্লবের মূল নায়করা, গৃহস্থ-কৃষক, ছাত্র ও যুবসমাজ, রাষ্ট্রক্ষমতার স্বাদ পান নাই। সমাজেও সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। বরং বৈষম্য বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। এতদিনে তা নতুন নতুন শিখর স্পর্শ করেছে। এবারও তাই গণঅভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কা ষোলোআনা। আমি সম্পূর্ণ আশা ছেড়ে দিতে চাই না বলেই ষোলোকে পনেরোতে নামিয়েছি।
সম্প্রতি ট্রটস্কিপন্থি বলে পরিচিত বিলেতি-পাকিস্তানি চিন্তাবিদ তারেক আলি মাধ্যমান্তরে একটা খোলা চিঠি প্রকাশ করেছেন। সেখানে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের ছাত্রদের উচিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ক্ষমতায় শতকরা ৫০ ভাগেরও বেশি আসন দাবি করা। যারা বিপ্লবী আন্দোলন পরিচালনা করতে পারেন, তারা কেন উপদেষ্টা পরিষদের নেতৃত্বে থাকবেন না? আমাদের মতে, এহেন দাবি খুবই যৌক্তিক। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তব অবস্থায় মনে হয়, এটা অবাস্তব প্রমাণিত হতে চলেছে।

সমকাল: যে শিক্ষার্থীরা সরকার উৎখাতের মতো কঠিন কাজটা করতে পেরেছেন, তাদের প্রাণশক্তির উৎস কোথায়?

সলিমুল্লাহ খান: উনিশশ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সর্বস্তরের জনগণ অংশগ্রহণ করেছিলেন। সেখানে চালিকাশক্তি ছিলেন আদতে ছাত্ররা, পরে সৈনিকরা এতে যোগ দেন। এবারও সেটাই ঘটেছে প্রকারান্তরে। তাই বলি, ছাত্রদের প্রাণশক্তির আসল উৎস ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। সেই সাম্য, মানবিক মর্যাদা আর ন্যায়বিচারের দাবি। ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, আমাদের লক্ষ্য মানুষে মানুষে সমতা তৈরি করা, বৈষম্য কায়েম করা নয়। এই কারণে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নামটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। যে সংবিধানের মূলমন্ত্র সামাজিক সুবিচার, সেখানে ৫০ বছর পরও ৩০ শতাংশ কোটা ‘মুক্তিযোদ্ধাদের নাতিপুতি’দের জন্য বরাদ্দ রাখা স্ববিরোধী নয় কি?

সমকাল: মানবিক মর্যাদা বোঝার কোনো মাপকাঠি আছে?

সলিমুল্লাহ খান: নাগরিকের মানবিক মর্যাদা বোঝার একটা নির্দেশক বাকস্বাধীনতা। কোন শাসন ব্যবস্থা কতটুকু শক্তিশালী, তার একটা প্রমাণ নাগরিকরা সরকারকে নিয়ে কতটা মশকরা করতে পারে– এই মাপকাঠিতেও মাপা যায়। কোনো ব্যঙ্গ কবির ব্যঙ্গোক্তিকে গদিনশীন সরকার কতটুকু মেনে নিতে পারে, তা দেখেও সেই সরকারের নৈতিক শক্তি কতখানি পাকা তা মাপা যায়। সদ্য ক্ষমতাচ্যুত সরকারের সময় সব ধরনের প্রতিষ্ঠান সব ধরনের রসবোধ বা হিউমার হারিয়েছিল, সেখানে তোষামোদ বড় একটা জায়গা করে নিয়েছিল। ছাত্রদের ‘রাজাকার’ অভিধা ব্যঙ্গার্থেই ব্যবহৃত হয়েছিল। তারা প্রধানমন্ত্রীকে ঠাট্টা করার জন্যই এই শব্দটা ছুড়ে দিয়েছিলেন। অথচ সরকার ও তার প্রচারযন্ত্র তা বাচ্যার্থে গ্রহণ করেছিল।

সমকাল: গণতন্ত্রও তো ছিল মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার।

সলিমুল্লাহ খান: কথাটা ঠিক। মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার ছিল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা। জনগণই তাদের ইচ্ছা অনুসারে রাষ্ট্র গঠন করবে আর তাদের অধিকার বজায় রেখে সরকার রাষ্ট্র পরিচালিত হবে। কিন্তু ১৯৭২ সালের সংবিধানে গণতন্ত্র মাত্র আকাঙ্ক্ষা হিসেবেই বিরাজ করেছিল, সরেজমিন বাস্তবায়িত হয়নি। আকাঙ্ক্ষা আর বাস্তবায়িত সত্য এক জিনিস নয়, এক হয়ও না। বরং ১৯৭২ সালে গৃহীত সংবিধানের মধ্যেই স্বৈরতন্ত্রের সব উপাদান বিরাজমান থাকায় বকলম চতুর্থ সংশোধনী একদলীয় শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন সহজ ও সম্ভব হয়েছিল। কোনো রাষ্ট্র যদি সত্যিকার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয়, তাহলে সে ধর্মের ভিত্তিতে কেন, জাতির ভিত্তিতেও নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য বা পার্থক্য করতে পারে না। বাংলাদেশে নামে গণতন্ত্র হলেও, কাজে কায়েম হয়েছিল স্বৈরতন্ত্র। আর এক্ষণে অভ্যুত্থানের পর যা এই মুহূর্তে চলছে, তার নাম মবোক্রেসি অর্থাৎ বিদ্রোহী জনতার শাসন। প্রাচীন গ্রিসে এই অবস্থাকেই বলা হতো ‘ডেমোক্রেসি’ বা গণতন্ত্র। গ্রিক মহাশয় আরস্তুর মতে এটাই নিকৃষ্টতম রাষ্ট্রব্যবস্থা। এখন আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে, মবোক্রেসি থেকে আধুনিক গণতন্ত্র বা ডেমোক্রেসিতে-নিয়মতান্ত্রিক সরকারে যাওয়া। নতুন সরকারের কাছে আমরা সেটাই আশা করব।

সমকাল: আপনাকে ধন্যবাদ।

সলিমুল্লাহ খান: আপনাদেরও ধন্যবাদ।

আরও পড়ুন

×