ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা

বন্যা নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুনর্বাসন শুরু জরুরি

বন্যা নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুনর্বাসন শুরু জরুরি

.

মো. জসীম উদ্দিন

প্রকাশ: ৩০ আগস্ট ২০২৪ | ০০:০৮

প্রলয়ঙ্করী বন্যায় দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ১২টি জেলায় প্রায় ৬০ লাখ মানুষ পানিবন্দি। পুরোদমে চলছে ত্রাণ কার্যক্রম। কোনো কোনো অঞ্চল থেকে বন্যার পানি নেমে যাচ্ছে; কোথাও কোথাও পানি বাড়ছে বা নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। বন্যার পানি হয়তো দু-তিন সপ্তাহের মধ্যেই নেমে যাবে। কিন্তু এর প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। কারণ ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রাম বা পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু উপজেলার বাসিন্দাদের কাছে এটি ইতোমধ্যে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা হিসেবে অভিহিত।

এ দেশের জনগণ বন্যা, ঘূর্ণিঝড় অসীম সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করে থাকে। এবারও চলছে ছাত্র-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত গণত্রাণ সংগ্রহ ও বিতরণ, যা এর আগে কমই দেখা গেছে। এবারের বন্যায় যেমন সুশৃঙ্খলভাবে ত্রাণসামগ্রী, আর্থিক সহায়তা সংগ্রহ ও বিতরণ সম্পন্ন হচ্ছে, তা ভবিষ্যতের জন্য অনুকরণীয় হয়ে থাকবে।
এ কথা অনস্বীকার্য, বন্যায় শুধু ঘরবাড়ি তলিয়ে যায়নি; ছন্দপতন ঘটেছে জীবন চলার প্রক্রিয়ায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাজার, স্কুল, মাছের ঘের ও পুকুর, গবাদি পশুসহ জীবন-জীবিকার সহায়ক উপাদান। সুতরাং মানবিক বিপর্যয় রোধে দ্রুততম সময়ে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি।

প্রথমত, বাজার, রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য ভৌত অবকাঠামো সংস্কারের কাজ দ্রুততম সময়ে শুরু করতে হবে। দ্বিতীয়ত, মানুষের জীবন-জীবিকা, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুনরুদ্ধারে কিছু পদক্ষেপ প্রয়োজন হবে।

ক. এ মুহূর্তে মানুষের হাতে নগদ অর্থ নেই। বানভাসি মানুষ তাদের জীবিকা চালাতে যে কাজটি বন্যার আগে করছিল, এখন তা থেকে আয় সেভাবে নেই; বরং ব্যয়ের খাতগুলো একই রয়েছে। অনেকের মাছের ঘের, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগির খামার, সবজি ও ফসলের ক্ষেত তলিয়ে গেছে। কারও ছোট দোকানটির সব পণ্য বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। এ রকম আরও অনেক জীবিকা হারিয়ে দুশ্চিন্তা ও অনিশ্চয়তায় দিনাতিপাত করছে লাখো মানুষ। তাদের অনেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়েছেন। তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আবারও সচল করতে নতুনভাবে অর্থ সরবরাহ জরুরি। এ জন্য ঋণ প্রদানকারী সংস্থা অথবা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কেউ আগে ঋণ নিয়ে থাকলে এবং তা সম্পূর্ণ বা আংশিক অপরিশোধিত থাকলে আগের ঋণ স্থগিত করে নতুনভাবে আর্থিক সহায়তা দিতে হবে। ঋণ বা অনুদান অথবা ঋণ ও অনুদান সংমিশ্রণে অর্থায়ন প্রক্রিয়াটি শুরু হতে পারে।
খ. বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর কৃষি ও অন্যান্য কাজ পুনরায় শুরুর ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা প্রয়োজন। এর মধ্যে প্রথমেই বিভিন্ন শস্য ও সবজি বীজ সংগ্রহের ব্যবস্থা করতে হবে। সবজি বীজ সরবরাহ এবং দ্রুততম সময়ে আমন চাষের প্রস্তুতির জন্য ট্রে-তে বীজ রোপণ করার প্রযুক্তি সরবরাহ করা জরুরি। কৃষি যন্ত্রপাতির জোগান দেওয়া ও মাছ চাষের পুকুরগুলো পুনরায় উপযুক্ত পরিবেশে ফিরিয়ে আনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গোখাদ্যের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণও আবশ্যক।
গ. বন্যা-পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন রোগবালাইয়ের উপদ্রব হবে। এ জন্য প্রাথমিকভাবে বিভিন্ন জায়গায় স্বাস্থ্য ক্যাম্প স্থাপন করে নিবিড় স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া দরকার। প্রবীণ, প্রতিবন্ধী, অন্তঃসত্ত্বা ও শিশুদের পৃথক ব্যবস্থায় সেবার আওতায় আনতে হবে। বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের আওতায় প্রবীণ কেন্দ্র, অন্তঃসত্ত্বা ও শিশুদের জন্য নিরাপদ কেন্দ্র স্থাপন করা যেতে পারে। এসব কাজে তরুণদের সম্পৃক্ত করা যায়।

ঘ. বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিটেশনে নজর দিতে হবে। বন্যায় বিনষ্ট টিউবওয়েল ও টয়লেট দ্রুততম সময়ে প্রয়োজনীয় সংস্কার এবং বিশুদ্ধ ও নিরাপদ পানি সরবরাহ ব্যবস্থা পুনরায় চালু করতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা এনজিওগুলোকে ঋণ বা অনুদান কার্যক্রম নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
ঙ. বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার সব গবাদি পশু ভ্যাকসিনেশনের আওতায় আনা জরুরি। গোখাদ্যের ঘাটতি মেটাতে আশু পরিকল্পনা প্রয়োজন। কৃষি কর্মকাণ্ডে উৎপাদন চক্র স্বাভাবিক রাখতে বিভিন্ন ধরনের আর্থিক ও অ-আর্থিক সেবা দ্রুততম সময়ে গ্রহণের উদ্যোগ নিতে হবে। বীজ, সার, কীটনাশক প্রভৃতি সরবরাহ নিশ্চিত করে স্বল্প সময়ে বন্যার ক্ষতি পূরণ করতে হবে।

বন্যার সময়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ত্রাণসামগ্রী নিয়ে এগিয়ে এসেছে মানুষ। বন্যা-পরবর্তী সময়েও ছাত্র-জনতাসহ সব প্রতিষ্ঠান পুনর্বাসন কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে আসবে বলে আশা করা যায়। তবে উপর্যুক্ত কাজগুলো করতে গিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয় ঘটাতে হবে।
ড. ফখরুদ্দীন আহমদ পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকাকালীন ২০০৬ সালে উত্তরবঙ্গে ‘মঙ্গা নিরসনে সমন্বিত উদ্যোগ’ শিরোনামে কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলেন। কর্মসূচি বাস্তবায়নে ছিল পিকেএসএফের সহযোগী সংস্থাগুলো। মঙ্গাপীড়িত পাঁচটি জেলার ৩৫টি উপজেলার ২১২টি ইউনিয়নে ১৯ লাখ পরিবারকে এ কর্মসূচির আওতায় এনে ৫ লাখ ১২ হাজার পরিবারকে নিবিড় সেবা দেওয়া হয়। একই কায়দায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার জনগোষ্ঠীর আয়বর্ধক কর্মকাণ্ড পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি তাদের ঘরবাড়ি, দোকানপাট, স্যানিটেশন ব্যবস্থা, টিউবওয়েল সংস্কারসহ বিভিন্ন কাজের চাহিদা নিরূপণ করে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে পুনর্বাসন করে তাদের সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।

ড. মো. জসীম উদ্দিন: উন্নয়নকর্মী

 

আরও পড়ুন

×