অন্যদৃষ্টি
দুধের শিশু ডাকাতি
প্রতীকী ছবি
মাহফুজুর রহমান মানিক
প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর ২০২৪ | ০০:১০
ডাকাতির মালপত্রের সঙ্গে দুধের শিশু অপহরণের ঘটনায় নতুনত্ব আছে বটে, তবে তা জনমনে উদ্বেগ আরও বাড়িয়েছে। রাজধানীর আজিমপুর থেকে আট মাসের জাইফার এমন পরিণতিতে বৃহস্পতিবার রাত থেকেই সর্বমহলে আলোচনা দেখা যাচ্ছিল। শুক্রবার সেই রহস্য উদঘাটন করে র্যাব। শিশু ডাকাতির ১৬ ঘণ্টা পর র্যাব তাকে মুক্ত করতে সক্ষম হয়। যেখানে বলা হয়, মুক্তিপণ আদায় করতেই শিশুটিকে অপহরণ করা হয়েছিল। ‘সাবলেট’ হিসেবে অবস্থানকারী ফাতেমা আক্তার শাপলাকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। তাঁর বিরুদ্ধে শিশুটিকে অপহরণে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
ঘটনাটি নানা দিক থেকেই ব্যাখ্যা করার অবকাশ আছে। অপরাধের দিক থেকে দেখলে, ঘটনাটি অত্যন্ত লোমহর্ষক। সমকালের প্রতিবেদন মতে, রাজধানীতে দুই মাসে ৬৮টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। একইসঙ্গে
বৃহস্পতিবার রাজধানীতে শিশু জাইফা অপহরণের পাশাপাশি প্রবাসী চিকিৎসককে খুনের অঘটনও ঘটে। এসব ঘটনা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য সতর্কবার্তা। তারা নিশ্চয়ই সতর্ক হবেন। তবে খুনের ঘটনার চাইতেও আট মাসের শিশুর অপহরণ বেশি আলোচনার জন্ম দিয়েছে। যদিও কাউকে জিম্মি করে অর্থ আদায় তথা মুক্তিপণের ঘটনা নতুন নয়। তাই বলে দুধের শিশু!
বলাবাহুল্য, শিশুর সঙ্গে এ ঘটনা ঘটেছে বলেই বিষয়টিতে মানুষের এক ধরনের সহানুভূতি কাজ করছে। এই ধরনের সহানুভূতি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। কিন্তু বাস্তবে শিশু নিপীড়ন এবং নানাভাবে শিশুর সঙ্গে অপরাধের ঘটনা থেমে নেই। কিছুদিন আগেই আমি সিলেটের ছোট্ট মুনতাহা নিয়ে লিখেছি। ৫-৬ বছরের এই শিশুটির ঘটনাও ব্যাপকভাবে সামাজিক মাধ্যমে আলোচিত হয়। শিশুটিকে অপহরণ করার ছয় দিন পর লাশ হিসেবে খুঁজে পাওয়া যায়। তার আগে লিখেছিলাম, গৃহকর্মী কল্পনাকে নির্যাতনের বিষয়ে। সেটিও বহুল আলোচিত। এরপরও কিন্তু শিশু নিপীড়ন থেমে নেই। নিষ্পাপ শিশুর সঙ্গে আমরা কতটা নির্দয় আচরণ করি তার প্রমাণ ইতিপূর্বেও আমরা দেখেছি। অর্থাৎ এসব অপরাধ কোনোভাবেই কমছে না। আইন আছে সন্দেহ নেই, তবে উহার প্রয়োগ নিয়ে প্রশ্ন আছে। মানুষের দেখানো সহানুভূতিও স্পষ্ট, কিন্তু বাস্তবে শিশুদের সঙ্গে ব্যবহারে কে কতটা কোমল বা কঠোর?
শিশু জাইফাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী উদ্ধার করতে পেরেছে, এটা নিঃসন্দেহে স্বস্তির। নাহলে সিলেটের মুনতাহার পরিণতিও হতে পারতো। তাছাড়া আট মাসের শিশু হিসেবে জাইফা একেবারেই অসহায়। এই অসহায় শিশুকে জিম্মি করে যেভাবে মুক্তিপণ আদায়ের চেষ্টা হয়েছিল, সেটা কতটা ন্যক্কারজনক বলার অপেক্ষা রাখে না।
প্রিয় যে কোনো বস্তুর প্রতিই মানুষের এক ধরনের মায়া থাকে, সহজে ছাড়তে চায় না; সেখানে মানবশিশুর মূল্য যে কোনো দিক থেকেই অবর্ণনীয়। বিশেষ করে, শিশুর প্রতি মা-বাবার মায়া কোনো অর্থ দিয়ে নিরূপণ করা সম্ভব নয়। মানবশিশু মায়ের পেটে থাকা, জন্মগ্রহণ করা ও লালনপালনের মাধ্যমে দীর্ঘ পরিচর্যায় বড় হয়। শিশু অতিমূল্যবান বলেই তার বেড়ে ওঠার পথে এতটা যত্নের প্রয়োজন হয়। আদুরে পরিবেশে, নানা কষ্ট সহ্য করেও মা শিশুকে জন্ম দেন। এই প্রক্রিয়ায় মায়ের কষ্ট হয় বটে কিন্তু তাঁর মধ্যে যেই মায়া জন্ম হয়, সেই মমতার কারণেই মা শিশুকে আগলে রাখেন। তাকে হারাতে চান না। তার মুক্তিপণের অর্থ যতই হোক, মা হয়তো সেটা ব্যবস্থা করতে চেষ্টা করতেন।
মায়ের আঁচল থেকে শিশু জাইফার অপহরণ ও তাকে উদ্ধারের বার্তা স্পষ্ট। আমরা অনেকে মানুষ হলেও মানবিক হতে পারিনি। শিশুর প্রতি আমাদের সহানুভূতি প্রকাশ করার চাইতেও বাস্তবে প্রয়োগের বিষয়। বড়দের সহযোগিতায়ই কেবল শিশুর সুন্দর বেড়ে ওঠা নিশ্চিত হতে পারে।
মাহফুজুর রহমান মানিক: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, সমকাল
mahfuz.manik@gmail.com
- বিষয় :
- অন্যদৃষ্টি