সাতক্ষীরা
বারবার কেন খোলপেটুয়া নদীর বাঁধ ভাঙন?
.
বিউটি খাতুন
প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর ২০২৪ | ০০:১৫
সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি উপজেলার ত্রিমোহিনীতে খোলপেটুয়া নদীর বাঁধ বারবার ভাঙনের শিকার হয়। নদীটি সরাসরি বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। হালকা বর্ষণ হলেও সমস্যায় পড়তে হয় শ্রীউলা ও প্রতাপনগর ইউনিয়নের মানুষকে। কয়েক বছর আগে এই নদীটির বাঁধ ভয়াবহ ভাঙনের শিকার হয়। কপোতাক্ষ নদের কল কল ধ্বনির মতো শোঁ শোঁ বেগে পানি চলে আসে। প্রায় ঘণ্টাখানেকের মধ্যে শ্রীউলা ইউনিয়নের ২২টি গ্রাম পানিতে তলিয়ে যায়। মানুষ জীবন বাঁচাতে কেউ চলে যায় পার্শ্ববর্তী উপজেলার আত্মীয়ের বাড়িতে। কেউ ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। গরু-ছাগল নিয়ে বেকায়দায় পড়ে মানুষ। কেউ বাড়িতে বসে কান্নায় ভেঙে পড়ে, কারও জিনিসপত্র পানিতে ভেসে চলে যায়। তখন আমরা খাবারের জন্য হাহাকার দেখেছি। কেউ নৌকায় জিনিসপত্র নিয়ে অজানায় রওনা দেয়, যেন যাওয়ার ঠাঁই নেই। আবার কেউবা আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে আশ্রয় নেয়। ১৫ জুলাই থেকে টানা ১৫ দিন শ্রীউলা ইউনিয়নের গ্রামের মানুষ যে ভোগান্তিতে পড়ে, তা অবর্ণনীয়।
প্রতিদিন রাত সাড়ে ৩টা ও বিকেল ৪টার দিকে প্রতিটি বাড়িতে নদীর মতো জোয়ার-ভাটা হতে থাকে। গ্রামের কাঁচাঘরগুলোর ৬০-৭০ শতাংশ ভেঙে মাটির সঙ্গে মিশে যায়। গভীর রাতে যখন হঠাৎ ঘর ভাঙার আওয়াজ কানে চলে আসে, তখন পাশের বাড়ির মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে যায়। বিষাক্ত সাপের উৎপাত বেড়ে যায়। অনেকে ভাবে, মৃত্যু যেন দ্বারপ্রান্তে চলে এসেছে। গাছপালা ভেঙে পড়ে, জমির ফসল নষ্ট হয়, ঘর ভেঙে যায় এবং মানুষ খাবার ও পানি সংকটে ভোগে। অনেকের মৃত্যুও হয়। মাড়িয়ালা গ্রামের জোয়াদ্দারপাড়ায় বসবাসরত মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মাজেদের লাশ মৃত্যুর পাঁচ দিন পর পানিতে ভেসে ওঠে। পানি দূষিত হওয়ায় ডায়রিয়ায় ভোগে পুরো পরিবার। পায়নি বিশুদ্ধ পানি, পায়নি কোনো ভালো চিকিৎসা। অধিকাংশ নারী বলেন, সন্তানের মুখে একমুঠো ভাত তুলে দেওয়ার মতো জ্বালানোর উনুন নেই, সবই পানিতে থইথই। চারদিক থেকে মাইকে শোক সংবাদের আওয়াজ শুনি। এ সংকটে মানুষের মৃত্যু। আহ কী করুণ দৃশ্য!
প্রথমে ভাঙনের পরিমাণ ছিল অল্প। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকার কারণে শ্রীউলা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সরকারি অধিক অর্থের বাজেটের আশায় বিষয়টি ধামাচাপা দিয়ে রাখে। ফলে ভাঙনের পরিমাণ থেমে থাকেনি। ছয় হাত থেকে ভেঙে ছয়শ হাতে পরিণত হয়। ভাঙনের পরিমাণ এভাবে যত বাড়তে থাকে একদিক থেকে জনগণের কান্না, অন্যদিকে চেয়ারম্যানের আনন্দ! তারা অবশ্য লোক দেখানো অনেক কাজ করেছেন। কখনও এক কোদাল মাটি ঝুড়িতে করে মাথায় নিয়ে ভাঙনে ফেলছে, আবার কখনও লুঙ্গি, গামছা পরে সেখানে নামছে। জনগণ যখন দেখল, আমাদের ঠাঁই নাই তখন কয়েকশ স্থানীয় মানুষ মিলে নিজেদের শ্রম দিয়ে আপাতত বাঁধ নির্মাণ করে। কিন্তু বারবার ভাঙন হতে দেখা যায়। এটি স্থানীয় জনগণের একার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই পানি উন্নয়ন বোর্ড, জেলা প্রশাসক ও সরকার উদ্যোগ নিলে আশাশুনির খোলপেটুয়া নদীতে মজবুত বাঁধ নির্মাণ হবে।
প্রায় দুই মাস আগেও খোলপেটুয়া নদীর বাঁধ ভাঙে। এবার সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার আনুলিয়া ইউনিয়নের কাকবসিয়া গ্রামের খোলপেটুয়া নদীর বেড়িবাঁধে ভয়াবহ ভাঙন দেখেছি আমরা। এতে তিন ইউনিয়নের প্রায় ৫০ হাজার মানুষ দুর্ভোগে পড়ে। কাকবসিয়া গ্রামের খেয়াঘাটসংলগ্ন প্রায় ৩০০ ফুট বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একই স্থান থেকে গত তিন বছরে তিনবার ভেঙেছে। যখনই ভাঙে, তখন পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা পরিদর্শন করার পর সেই স্থানে মাটি দিয়ে যায়। আগে থেকে তেমন কোনো কাজ তারা করে না। এভাবে সাময়িক ব্যবস্থা নিয়ে বাঁধের সুরক্ষা সম্ভব নয়। এলাকাবাসী স্থায়ী সমাধানের যে স্বপ্ন দেখছেন, তা জরুরি ভিত্তিতেই বিবেচনা করা জরুরি।
বিউটি খাতুন: উন্নয়নকর্মী, সাতক্ষীরা
- বিষয় :
- সাতক্ষীরা