তৃতীয় মেরু
দেশ ভাগ, নদী ভাগ ও মওলানা ভাসানী
শেখ রোকন
শেখ রোকন
প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর ২০২৪ | ০০:২০ | আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০২৪ | ০০:২২
বাংলাদেশ-ভারত নদী-সম্পর্কের গোড়ার গলদ হচ্ছে ১৯৪৭ সালের ‘অন্যায্য’ সীমান্তরেখা। অন্যায্য কেন? যেমন বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম সংখ্যাগরীষ্ঠ মুর্শিদাবাদ জেলা ১৭ আগস্ট পর্যন্ত পাকিস্তানের অংশ ছিল। কিন্তু তারপর ভারতকে দেওয়া হয়, কারণ ওই এলাকায় গঙ্গা থেকে ভাগিরথী উৎপন্ন হয়ে কলকাতা বন্দরে গিয়েছে। ওই অঞ্চল যদি পাকিস্তানে পড়ত, তাহলে কলকাতা বন্দরের নাব্যর নিয়ন্ত্রণ ভারতের হাতে থাকত না। পরবর্তীকালে গঙ্গায় ফারাক্কা ব্যারাজ দিয়ে বাংলাদেশকে পানিবঞ্চিতও করা যেত না। একই কথা বলা চলে আসামের বৃহত্তর গোয়ালপাড়া বা সিলেটের করিমগঞ্জ সম্পর্কে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এসব অঞ্চল যদি পাকিস্তান তথা পরবর্তীকালে বাংলাদেশে পড়ত, তাহলে ব্রহ্মপুত্র বা মেঘনা নিয়ে আমাদের কপালে আজ দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ত না।
দুর্ভাগ্য, আমাদের দেশে দেশ ভাগ নিয়ে যত কম আলোচনা, দেশ ভাগের ফলে নদী ভাগ হয়ে যাওয়া নিয়ে আলোচনা তারও কম। ওই সময় ভারত ও পাকিস্তানের পূর্বাংশে যেভাবে রাজনৈতিক সীমারেখা টানা হয়েছিল, বিশ্বের কোথাও এভাবে নদী আড়াআড়ি ভাগ করে সীমান্তরেখা টানা হয় না। এ ধরনের সীমারেখার পরবর্তী সময়ের বিপদ পূর্ব বাংলার যেসব নেতা তখনই বুঝতে পেরেছিলেন, তাদের একজন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং অপরজন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
এ প্রসঙ্গে কবি ও তাত্ত্বিক ফরহাদ মজহার লিখেছেন– ‘মওলানার ভাবশিষ্য হিশাবে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জনগণকে পানির অভাবে হাহাকার করে আর পুড়ে মরতে দিতেন না– এই হলো কথা’। (ফরহাদ মজহার/ পানির ‘হক’ আদায়, পরিবেশ কিংবা এক জলদেবতার গল্প/ প্রাণ ও প্রকৃতি/ আগামী প্রকাশনী/ ফেব্রুয়ারি ২০১১)। আজকের প্রসঙ্গ অবশ্য কেবল মওলানা ভাসানী, তাঁর ৪৮তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে।
দুই.
মওলানা আবদুল হামিদ খান কীভাবে ‘ভাসানী’ হলেন? অনেকেই জানেন, ধুবরীর ভাসানচরে তিনি ১৯২৪ সালে বাঙালি মুসলিম কৃষক সম্মেলন ডাকেন। এর আনুষ্ঠানিক নাম ছিল ‘আসাম-বাংলা প্রজা সম্মেলন’। ওই সম্মেলনের পর অখণ্ড আসাম ও অখণ্ড বাংলাজুড়ে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে ‘ভাসানীর মওলানা’ হিসেবে। সেখান থেকে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী।
প্রশ্ন হচ্ছে, কোথায় এই ভাসানচর? চরবহুল ব্রহ্মপুত্রের শত শত চরের মধ্যে ওই সম্মেলনের প্রায় শত বছর পর খুঁজে পাওয়া সত্যিই কঠিন। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর এর আশপাশের প্রশাসনিক পরিচিতিও স্বভাবতই ১৯২৪ সালের চৌহদ্দিকে অনেকদূর ফেলে এসেছে।
খোঁজ-খবর করে যতদূর জেনেছি, ব্রহ্মপুত্রের ডানতীর ঘেঁষে অবস্থিত আসামের অন্যতম প্রধান জেলা শহর ধুবরী থেকে বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে একটি চ্যানেল পার হলেই যে বড় চর, এখানেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল সেই সম্মেলন। অবশ্য এখন এর নাম আর ‘ভাসানচর’ নয়। ভাসানচরের নামে তিনি ‘ভাসানী’ হয়েছিলেন; এখন সেই চর তাঁর নাম ধারণ করেই ‘ভাসানীচর’ স্বীকৃতি পেয়েছে। বলতে গেলে, মওলানা আবদুল হামিদ খান কেবল নদী থেকে নিজের নামের অংশবিশেষ তুলে আনেননি; বিপুল ব্রহ্মপুত্রও তার বুকে এভাবে ধরে রেখেছে ভাসানীকে।
তিন.
ভাসানচরের কৃষক সম্মেলন ছিল কুখ্যাত ‘লাইনপ্রথা’ বাতিলের দাবিতে। তৎকালীন আসাম সরকার প্রবর্তিত এই আইনের কারণে মূলত কৃষক বাঙালি জনগোষ্ঠী কিছু নির্দিষ্ট ‘লাইন’ বা সীমারেখার বাইরে বাকি আসামে চলাফেরা করতে পারত না। এছাড়া তারা চাষযোগ্য ভূমি প্রস্তুত ও চাষাবাদ করলেও সেখানে তাদের আইনি অধিকার ছিল না। ভাসানচর সম্মেলনের পর তিনি জনপ্রিয়তম নেতা হয়ে ওঠেন আসাম ও বাংলার কৃষক সমাজের মধ্যে।
১৯৩৭ সালে প্রথমবারের মতো আসাম প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন। প্রথম অধিবেশনেই আসাম গণপরিষদে ‘লাইনপ্রথা বিরোধী’ বিল উত্থাপন করেন। ১৯৪০ সালে আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি হওয়ার পর থেকে আসামকে, বিশেষত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল যেমন বৃহত্তর গোয়ালপাড়া ও বৃহত্তর সিলেট জেলাকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্তির জন আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকেন। একইসঙ্গে আসামের বিভিন্ন অঞ্চলে বাঙালিদের সংগঠিত করতে থাকেন। যে কারণে ১৯৪৬ সালে আসামের সাধারণ নির্বাচনে তাঁর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ তিনটি আসন ছাড়া বাকি সব আসনে জয়লাভ করে। (আসামের ‘বঙ্গাল খেদা’ ও মওলানা ভাসানী/ আজাদ খান ভাসানী/ দেশ রূপান্তর, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯)।
১৯৪৭ সালের ৩-৪ মার্চ বাংলা-আসাম সম্মেলনে মওলানা ভাসানী বাংলা ও আসামকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তির দাবি করেন। তিনি ১০ মার্চ ‘আসাম দিবস’ পালনের ঘোষণা করেন। ১০ মার্চের সভাস্থল থেকেই ভাসানীকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করা হয়। সিলেটের গণভোটে সফলতার পর পাকিস্তানে যোগদানের প্রশ্নে মওলানা ভাসানী ধুবড়ী, গোয়ালপাড়া, নওগাঁও প্রভৃতি জেলায়ও গণভোট চান। ফের নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার হয়ে ১৯৪৭ সালের ১৪-১৫ আগস্ট দেশ ভাগের সময় তিনি কারাগারে বন্দি ছিলেন। সেপ্টেম্বরে তাঁকে মুক্তি দিয়ে ব্রহ্মপুত্র তীরের ধুবরীতে এনে পাকিস্তানগামী নৌকায় তুলে দেওয়া হয়। (আসামের ‘বঙ্গাল খেদা’ ও মওলানা ভাসানী/ আজাদ খান ভাসানী/ দেশ রূপান্তর, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯)।
কেবল ভাসানচর থেকে ভাসানী হওয়া নয়; মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর রাজনৈতিক জীবনের বড় বড় বাঁকের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে নদী। দেশ ভাগের পর আসাম থেকে নদীপথে পূর্ববাংলার টাঙ্গাইলে ফিরেছিলেন তো বটেই; ১৯৪৯ সালে তাঁর প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতীকও ছিল নদীপথের বাহন নৌকা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি টাঙ্গাইল থেকে ভারত গিয়েছিলেন নদীপথেই। আর তাঁর জীবনের শেষ রাজনৈতিক কর্মসূচি ছিল ফারাক্কা লংমার্চ।
চার.
১৯৭৬ সালের ১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চে রাজশাহী মাদ্রাসা ময়দান থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাট পর্যন্ত হাজার হাজার মানুষ যোগ দেয়। সেখানে আহমদ ছফাও যোগ দিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে এ ঘটনা নিয়ে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি মওলানার নাম দিয়েছিলেন ‘জলদেবতা’। সেদিন রাজশাহীর মাদ্রাসার ময়দান থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাট পর্যন্ত কর্মসূচিটি কেবল নদীর পানির অধিকারের জন্য বিশ্বের প্রথম লংমার্চ ছিল না; শুরুর আগের জনসমাবেশে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, সেটি বাংলাদেশ তো বটেই, বিশ্বেও নদী অধিকারের প্রশ্নে ‘বটম লাইন’ হয়ে আছে। অনেকের স্মৃতিকথায় দেখা যায়, তিনি বলেছিলেন– মাতৃদুগ্ধে যেমন শিশুর অধিকার, নদীর ওপর তেমন মানুষের অধিকার।
পাঁচ.
প্রশ্ন হচ্ছে, মওলানা ভাসানী কেন ১৬ মে লংমার্চ আহ্বান করেছিলেন? কেন ১৭ মে বা ১৫ মে নয়। সূত্র খুঁজতে গিয়ে দেখেছি, দুই বছর আগে ১৯৭৪ সালের ১২-১৬ মে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দিল্লি সফরে গিয়েছিলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠকের পর ১৬ মে যে যৌথ বিবৃতি প্রকাশ হয়েছিল, এর ১৮ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল– ‘দুই পক্ষ তাদের প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে যে, ফারাক্কা প্রকল্প চালুর আগেই পারস্পরিক গ্রহণযোগ্য পরিমাণ প্রবাহ বণ্টনের ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছবে’।
পরবর্তী ইতিহাস আমাদের জানা। কিন্তু এই সংকটের বীজ কীভাবে দেশ ভাগের সময়ই রোপিত হয়েছিল, জানতে হলে মওলানা ভাসানীর নদীচিন্তা সম্পর্কে জানতে হবে। আর মজলুম জননেতা মওলনা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর আদর্শ সামনে রেখে যারা রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছেন, তাদের উচিত হবে নদী নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তোলায়ও মনোযোগ দেওয়া। সাম্প্রতিক বাংলাদেশে নদীর চেয়ে বেশি ‘মজলুম’ আর কী আছে?
শেখ রোকন: লেখক ও নদী গবেষক
skrokon@gmail.com