রাজনীতি
নতুন গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ার পথ
জয়দ্বীপ রায়
জয়দ্বীপ রায়
প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর ২০২৪ | ১৩:১৪
৫ আগস্টের ক্ষমতার পালাবদলকে বিপ্লব বা গণঅভ্যুত্থান—আমরা যাই বলি না কেন—জনগণের কাছে এর মানে ছিল উদার গণতান্ত্রিক চিন্তাভিত্তিক নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির সূচনা। উদার গণতান্ত্রিক চিন্তা এই শিক্ষা দেয় যে বল প্রয়োগ বা দমন নয়; বরং যুক্তি, বুদ্ধি, নৈতিকতা ও আদর্শের মাধ্যমে রাজনীতি দিয়ে রাজনীতিকে মোকাবিলা করতে হবে।
উন্নয়নের নামে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার রাষ্ট্রকে কিছু স্বার্থান্বেষী অরাজনৈতিক ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর ইচ্ছা পূরণের যন্ত্রে পরিণত করেছিল; দেশকে সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও নৈরাজ্যে ডুবিয়ে দিয়েছিল। এ অবস্থা ঐতিহ্যবাহী দল হিসেবে আওয়ামী লীগকেই হেয় করেছিল। যতদূর জানি, স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত বহু মুক্তিযোদ্ধাও বিগত শাসন আমলে ছাত্রজনতার ওপর ছাত্রলীগের নির্লজ্জ কর্মকাণ্ডে লজ্জিত। আমি ব্যক্তিগতভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারাবাহিক ভাঙা কলের গান বা জাবর কাটা লুটেরা পুঁজিবাদী, সুবিধাবাদী ও পরিবারতান্ত্রিক চর্চার রাজনীতির সাথে একমত নই। বিশ্ববিদ্যালয়ে একমুখী বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার অধিকার ও গণতান্ত্রিক ছাত্র আন্দোলন করার সময়, বিশেষ করে ৯৬-এ আওয়ামী লীগের শাসন আমলে, আমরা সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের নেতাকর্মীরা বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নিপীড়ন–নির্যাতনের শিকার হয়েছি। তবে তা বলে তাদের ভুল রাজনীতির প্রতিবাদ করতে গিয়ে আমরা তাদের নিষিদ্ধ করার দাবি তুলিনি। তাদের ফ্যাসিবাদী অপসংস্কৃতি অন্যরাও অনুসরণ করুক, তা চাই না আমরা।
একটি দেশে কতজন মানুষ একটি সত্যকে লালন করছে তা দিয়ে এর সঠিকতা নির্ধারিত হয় না। কয়েক শ বছরের পুরোনো ইউরোপের গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণের সংগ্রাম এই সত্যই তুলে ধরে যে সত্যিকারের আদর্শ আজ হোক কাল হোক, পথ দেখাবেই। কোপার্নিকাস, ব্রুনো ও গ্যালিলিও বিভিন্ন সময় বলেছিলেন, "পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘুরে।" এই সত্যের জন্য তাদের জীবন বিপন্ন হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মানবসমাজ এই সত্যের পথ ধরেই এগিয়েছে ও আধুনিকতার বাতাবরণে সভ্য হয়েছে।
দুঃখজনকভাবে, বাঙালি জাতি সেই জাতিসমূহের অন্তর্ভুক্ত যারা যে কোনো অর্জনকে নিজের বলে কুক্ষিগত করার মানসিকতা থেকে মুক্ত নয়। এই প্রবণতা শিল্পবিপ্লব সম্পন্ন করতে ব্যর্থ অনুন্নত দেশগুলোর মানুষের মধ্যে বেশি প্রচলিত। এটাও মানতে হবে যে, পিছিয়ে পড়া জাতি ভাঙতে পারে, কিন্তু গড়তে গেলে তাদের প্রজ্ঞার অভাব দেখা দেয়। এই প্রবণতা বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক দলের মধ্যেই কম-বেশি রয়েছে, তবে আওয়ামী লীগের মধ্যে এটি অত্যন্ত প্রকট, যা জাতি বিভিন্ন সময়ে প্রত্যক্ষ করেছে। ক্ষমতায় গেলে ক্ষমতা ছাড়ার ইচ্ছা তাদের হয়ই না। গণতন্ত্রের স্বার্থে এক্সিট প্ল্যান বলে তাদের অভিধানে কিছু নেই বললেই চলে। অন্যদিকে যারা জনগণকে সাথে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে স্বৈরতন্ত্র উৎখাত করেছে, তারাও আবার সেই স্বৈরতন্ত্রই কায়েম করার চেষ্টা করেছে।
প্রশ্ন হচ্ছে: আমরা কি যে তিমিরে ছিলাম সেই তিমিরেই থাকবো? কখনও জাতি হিসেবে প্রকৃত আলোর মুখ দেখবো না? আমাদের খেটে খাওয়া গ্রামীণ মানুষ, যাদের পূর্বপুরুষ বছরের পর বছর একই কৃষি কাজ করছে রাষ্ট্রীয় প্রণোদনা না পেয়ে, তাদের মুক্তির জন্য কিছুই করবো না? আমরা যারা মধ্যবিত্ত আছি, তারা সারাজীবন স্বার্থপরতার ভাবনাতেই ডুবে থাকব? কৃষক-শ্রমিকের ট্যাক্সের টাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিনামূল্যের শিক্ষা পেয়ে লুটেরা ধনিক শ্রেণীর স্বার্থরক্ষা করবো? তাদের তাবেদারি করবো? ন্যূনতম অর্থে একটি সহনশীল, ন্যায় বিচার ও তুলনামূলক সাম্যের সমাজের জন্য নিজের জীবনকে নিবেদিত করবো না?
বিপ্লবের পর আমাদের জনআকাঙ্ক্ষা হচ্ছে: যারা বছরের পর বছর রাষ্ট্রক্সমতা কুক্ষিগত করে রেখে স্বৈরতন্ত্র কায়েম করেছে, রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছে এবং নিজের দল আওয়ামী লীগকেও বিরাজনীতিকরণের সিন্ডিকেটে যুক্ত করেছে, তাদের বিচার হওয়া প্রয়োজন। তবে এর অর্থ এই নয় যে বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ ও আওয়ামী সমর্থক, যারা স্বাধীনতার বিষয়ে সৎ আবেগ ও যুক্তির আলোকে বিশ্বাস পোষণ করেন, তাদের চিন্তা ও বিশ্বাসকে উপড়ে ফেলে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীলতার স্থায়ী ঘূর্ণাবর্তে ঠেলে দিতে হবে।
রাজনীতিবিজ্ঞানশাস্ত্র এই বিষয়ে যুক্তি দেখায় যে কোনো একটা স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা কখনও গোটা পার্টির সকল কর্মী ও জনগণের মধ্যে অবস্থিত তার সমর্থক দিয়ে সংঘটিত হয় না। বরং কিছু অসৎ ও প্রচণ্ড সুবিধাবাদী মানুষরূপী অমানুষরাই সিন্ডিকেট বা বলয় সৃষ্টি করে রাষ্ট্রীয় শক্তি, যেমন পুলিশ, ডিবি, র্যাব ইত্যাদি দিয়ে এই (অপ)কর্মযজ্ঞ চালায়।
এর দায় পুরো দলের নিম্নস্তরের কর্মীদের ওপর চাপালে বরং জাতির ক্ষতি বেড়ে যায়। কারণ প্রকৃত অপরাধীদের সঙ্গে নিরীহ মানুষকেও দমন করতে গেলে তা সমাজকে অস্থির করে তোলে। এ প্রক্রিয়া ওউ নিরীহ মানুসদের মধ্যে একপ্রকার প্রতিশোধপরায়নতাও তৈরি করে, তারা সুবিধাজনক সময়ে এ জিঘাংসা কার্যকরেও মরিযা হয়ে ওঠে। এহেন রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির পুনরাবৃত্তি হতে থাকলে এবং এভাবে দমন কর্মকাণ্ডে মগ্ন হয়ে থাকলে বাংলাদেশ একবৃত্তেই ঘুরপাক খাবে, আদৌ এগুবে না, সতুন কিছু সৃষ্টি হবে না। এটাই আজকের বিশ্ববাস্তবতায় আমাদের বিজ্ঞানভিত্তিক যুক্তিবোধ নির্দেশ করে।
অনেক ত্যাগের বিনিময়ে আমরা এই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র পেয়েছি। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশদের কাছ থেকে মুক্ত হয়ে আবার পাকিস্তানিদের কাছ থেকেও মুক্ত হয়েছি। বারবার আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি, কিন্তু বারবারই আমাদের হতাশাগ্রস্ত হতে হয়েছে। তাই কবি বলেছেন, "ভাত দে হারামজাদা, না হলে মানচিত্র খাবো।" স্বাধীনতার পর কৃষকদের অবস্থা নিয়ে কবি জসীমউদ্দীন বলেছিলেন, "চাষি তোর সোনার খেতে রবির ফসল ফলে, তোর ছাওয়াল খাবার বেলা নুন লঙ্কা মাগে।"
তাই একই রাজনৈতিক সংস্কৃতি যাতে বাংলাদেশের জনমানুষের মনে আবারও হুমকি, নৈরাজ্য ও হতাশার জন্ম না দেয় এবং দেশের প্রতি বিতৃষ্ণা সৃষ্টি না করে, এ জন্য সব রাজনৈতিক দলসহ জাতিকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে—এমনটাই আমরা প্রবাসী প্রগতিশীল দেশপ্রেমিক শক্তি মনে করি।
জয়দ্বীপ রায়: ইমারসিভ টেকনোলজি গবেষক, ব্রডকাস্টার ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
- বিষয় :
- রাজনীতি