ঢাকা শুক্রবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪

‘শর্ত প্রযোজ্যের’ বেড়াজালে বিজ্ঞাপনের আসল জগত!

‘শর্ত প্রযোজ্যের’ বেড়াজালে বিজ্ঞাপনের আসল জগত!

প্রতীকী ছবি

আবেদীন পুশকিন, কমিউনিকেশন প্রফেশনাল

প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর ২০২৪ | ১৫:২৪ | আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০২৪ | ১৫:৫৫

কয়েকদিন আগে তীব্র গরমে বাইরে বের হয়ে মনে হলো একটা সানগ্লাস কেনা দরকার! কোথাও হয়তো যাচ্ছিলাম, যাওয়ার পথেই ফুটপাতের পাশে এক হকারকে পেয়ে গেলাম, কার্টে সানগ্লাস আর ঘড়ি সাজিয়ে নিয়ে বসে আছেন। দরকার যেহেতু, কার্টের পাশে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ সানগ্লাস পছন্দ করলাম। বেশ কয়েকটা সানগ্লাস দেখার পর একটা নেব বলে মনে মনে ঠিক করলাম। হকারকে জিজ্ঞাসা করতেই তিনি একদম শোরুমের দাম বলে ফেললেন। 

আমার পছন্দ করা সানগ্লাসের দিকে বিরস বদনে তাকিয়ে হকার বললেন, ‘১২শ’ ট্যাকা দামের সানগ্লাস, আসল রেবেন। আপনার জন্য ১ হাজার রাখা যাইবো।’ আমি নাছোড়বান্দার মতো কিছুক্ষণ দামাদামি করলাম। শেষতক আমাদের মধ্যে দেড়শ টাকায় সমঝোতা হলো। সানগ্লাস নিয়ে হাঁটা দেব এমন সময় হকার বললেন- ‘একদম পানির দরে আসল রেবেন পাইলেন মামা!’

ব্যবসা করার জন্য মানুষ অনেক কিছুই করে। কেউ ছাড় দেয়, কেউ ফ্রি দেয়। নানারকম কথার ডালি সাজিয়ে বসে বিক্রেতারা। তবে, ঠিক কোন পণ্য বা অফারটি আমার জন্য নিয়ে আসা হয়েছে তা জানতে যেমন বিজ্ঞাপন প্রয়োজন; তেমনি বিজ্ঞাপনের সঙ্গে ছোট্ট করে একটি স্টার চিহ্ন দিয়ে লেখা ‘শর্ত প্রযোজ্য’ সম্পর্কেও আমাদের ভালোভাবে জেনে নেওয়া দরকার। 

কিছুদিন আগে এ রকম একটি বিড়ম্বনার ভেতর দিয়ে গিয়েছিলাম। একটি টেলিকম প্রতিষ্ঠান আনলিমিটেড ইন্টারনেটের অফার নিয়ে এসেছে। ইন্টারনেট তো প্রতি মাসেই কেনা লাগে, বিজ্ঞাপন দেখে খুশি হয়ে অ্যাপে ঢুকলাম। দেখি ওই অফারের খরচ, মেয়াদ, ইন্টারনেট স্পিড সবই নির্দিষ্ট করে দেওয়া। শুধু কতটুকু ইন্টারনেট ব্যবহার করা যাবে এটা তুলে দিয়ে এই অফারকে আনলিমিটেড ঘোষণা দেওয়া, আর গুলিস্তানে দাঁড়িয়ে ‘একশ টাকায় একের মাল’ বলে রদ্দি গছিয়ে দেওয়া বিষয়টি একই রকম। পার্থক্য শুধু এটুকুই যে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঘামতে থাকা হকারটির কথা আমাদের বিশ্বাস হয় না; অথচ সাহেবরা যেহেতু এসি রুমে বসে কোট-টাই পরে ‘শর্ত’ বসাচ্ছেন, বোধহয় তাতেই গ্রাহকের মঙ্গল! 

একবার একটি জাতীয় দৈনিকের অর্ধেক পাতাজুড়ে এয়ারকুলার ফ্রি পাওয়া যাবে এমন বিজ্ঞাপন দেওয়া হলো। তবে তা পেতে নিচে শর্ত হিসেবে দেওয়া ছিল, প্রায় লাখ টাকার কেনাকাটা করা লাগবে। এই অফারটি পাবেন মাত্র একজন ভাগ্যবান ক্রেতা, বাকিরা পাবেন ৫০০ টাকার গিফট ভাউচার। যে উপহার মাত্র একজন ক্রেতা পাবেন তার জন্য পত্রিকার অর্ধেক পাতা বরাদ্দ। আর বাকি যারা লাখ টাকার পণ্য কিনে ৫০০ টাকার গিফট ভাউচার পাবেন তাদের জন্য বরাদ্দ- একদম নিচের দিকে, এককোণায় অত্যন্ত ছোট হরফে লেখা একটি মাত্র লাইন। এতে করে আসলে দায় এড়ানো গেল! ক্রেতাদের বলা যাবে, বিজ্ঞাপনে তো দেওয়া ছিল, আপনার চোখে পড়েনি। 

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের নিজেদের সুবিধা মতো এই শর্ত বসানোর চেষ্টা করে। শর্ত দেওয়ায় অসুবিধার কিছু নেই। প্রতিষ্ঠান নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেই অফার দেবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে শর্তের এই বিষয়গুলো এমন জায়গায় দেওয়া হয়, যেখানে কোনোভাবেই ক্রেতাদের চোখ যাবে না। আবার চোখ গেলেও, লেখার আকার এতো ছোট যে তা পড়া যাবে না। অর্থাৎ শর্তগুলো যেন গ্রাহকদের নজর এড়িয়ে যেতে পারে তার সব রকম ব্যবস্থাই সেখানে থাকে। তাহলে এই ‘শর্ত’ দেওয়ার মানেটা কি?

আধুনিক এই সময়ে এসে ফোন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সব রকম পোস্টের ওপর-নিচ, ডান-বাম, পত্রিকা, বিলবোর্ড; সব জায়গা ছেয়ে আছে বিজ্ঞাপনে। কিন্তু সেখানে ‘শর্ত প্রযোজ্যের’ জায়গাটা আরেকটু পরিষ্কার করে তুলে ধরা গেলে, ক্রেতাদের জন্য সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হতো। প্রতিষ্ঠানের প্রতি ক্রেতাদের বিশ্বাস ও আস্থাও হয়তো আরও কিছুটা বাড়ত। 

প্রতিষ্ঠানের পণ্য বা সেবা তো ক্রেতাদের ব্যবহারের জন্যই। শর্তগুলো তাদের পরিস্কার ভাষায় জানাতে, কী এমন ক্ষতি!
 

whatsapp follow image

আরও পড়ুন

×