পরিবহন পরিকল্পনায় ব্যাটারি রিকশার স্থান

ফাইল ছবি
মু. মোসলেহ উদ্দীন হাসান
প্রকাশ: ২৭ নভেম্বর ২০২৪ | ০০:১২
ব্যাটারিচালিত রিকশা ইস্যু ফিরে এসেছে। গত ১৯ নভেম্বর উচ্চ আদালত ঢাকা শহরে এ যান্ত্রিক রিকশা চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে রাস্তায় শুরু হয় আন্দোলন, সেই সঙ্গে সমাজমাধ্যমে পক্ষে-বিপক্ষে তুমুল আলোচনা। গত ২৫ নভেম্বর অবশ্য রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের ভিত্তিতে আপিল বিভাগের চেম্বার বেঞ্চ এক মাসের জন্য ওই নিষেধাজ্ঞা স্থগিত করেছেন।
আমরা পরিকল্পনাবিদরা বাড়ি থেকে কোনো গন্তব্য পর্যন্ত পুরো যাত্রাকে (ট্রিপ) তিন ভাগে ভাগ করি। একটা হলো মূল যাত্রা বা মূল ভাগ, যেটি সবচেয়ে বেশি সময় নিয়ে হয় এবং যার শুরু সাধারণত পাড়া-মহল্লার বাইরে বাস, মিনিবাস, মেট্রো বা সিনএনজি স্ট্যান্ড বা স্টেশনে। বাসা থেকে বাস-ট্রেন-মেট্রো স্টেশন পর্যন্ত যাত্রার অংশকে বলা হয় ‘ফার্স্ট মাইল’। আবার বাস-মেট্রো থেকে নামার পর গন্তব্য পর্যন্ত পৌঁছানোর অংশকে বলা হয় ‘লাস্ট মাইল’। যে কোনো টেকসই নগর পরিবহন পরিকল্পনা ও সিস্টেমের শর্ত হলো যাত্রার মূল অংশ হবে দ্রুতগতির গণপরিবহনে; ফার্স্ট ও লাস্ট মাইল হবে সাইকেল বা অযান্ত্রিক রিকশায় বা হেঁটে। হাঁটা বা সাইকেল চালনাকে আবার বলা হয় ‘অ্যাক্টিভ ট্রান্সপোর্ট’। কারণ এটা ব্যবহারকারীকে অ্যাক্টিভ বা সক্রিয় রাখে। ফলে শরীরচর্চার কাজও হয়ে যায়। উন্নত বিশ্বের শহরগুলোতে হেঁটে বা সাইকেলে মানুষ ৪০০ থেকে ৮০০ মিটার দূর থেকেও বাস বা মেট্রো স্টেশনে আসেন। ঢাকা শহরে রিকশার মাধ্যমে এক থেকে দেড় কিলোমিটার দূর থেকে এসেও নগরবাসীদের বাস বা মেট্রো ধরতে দেখা যায়। গতি একটু বেশি আর মূল সড়কে উঠতে বাধাপ্রাপ্ত না হওয়ায় সাম্প্রতিক সময়ে যাত্রীদের মাঝে একটু বেশি দূরত্বের পথও বাসের পরিবর্তে পুরো যাত্রা ব্যাটারি রিকশা দ্বারা সম্পন্ন করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। সুতরাং এখন যান্ত্রিক বা ব্যাটারি রিকশা এসে অযান্ত্রিক রিকশা ও বাসের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। পাড়া-মহল্লা, অলিগলিতে ব্যাটারি রিকশা প্রচলিত (এস্টাবলিশড) গতির চেয়ে দ্রুত চলছে। এর ফলে রাস্তায় চলাচলকারীরা বাহনভেদে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া (রেসপন্স টাইম) হিসাব করতে না পারায় ব্যাটারি রিকশা দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছেন। ক’দিন আগেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন ছাত্রী ব্যাটারি রিকশায় আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে গাছের সঙ্গে পিষ্ট হয়ে মারা গেছেন।
ব্যাটারি রিকশার ধরন ও নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য সময়ের সঙ্গে উন্নত হয়েছে, সত্য। কিন্তু ব্যাপার হলো, এই উন্নতির ফলে যিনি ব্যাটারি রিকশার যাত্রী, তাঁর নিরাপত্তা বাড়ছে। কিন্তু পথচারী বা অন্য বাহন ব্যবহারকারীদের নিরাপত্তা ঝুঁকি রয়েই যাচ্ছে।
ব্যাটারি রিকশার পক্ষে একটি যুক্তি দেওয়া হয়– এটি পরিবেশবান্ধব। কথাটি অর্ধসত্য। কারণ এটি এমন একটি বাহনকে (অযান্ত্রিক রিকশা) প্রতিস্থাপন করছে, যা একশ ভাগ পরিবেশবান্ধব ও শূন্য কার্বন নিঃসরণকারী বাহন। ব্যাটারি রিকশা যদি কার, সিএনজি বা মোটরসাইকেলের যাত্রী টেনে নিত তাহলেও না-হয় কথা ছিল। তদুপরি ব্যাটারি রিকশার চার্জিংয়ে যে বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হয়, সেটা তৈরিতে তো কার্বন নিঃসরণ হচ্ছে। এ ছাড়া পুরোনো অব্যবহৃত ব্যাটারির অব্যবস্থাপনার কারণে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।
ইলেকট্রিক কারের প্রসঙ্গ আসতে পারে। বলা ভালো, ওই কারে ব্যবহৃত হয় লিথিয়াম ব্যাটারি। ব্যাটারি রিকশায় ব্যবহৃত হয় একেবারে প্রাথমিক প্রযুক্তির লেড আয়ন ব্যাটারি, যার ওজন বেশি ও যান্ত্রিক দক্ষতা অনেক কম। দামও অনেক কম, সন্দেহ নেই।
বিশ্বব্যাপী এখন চলছে টেকসই পরিবহন ও অ্যাক্টিভ পরিবহনের যুগ। এর মাধ্যমে পরিবেশ, সমাজ ও অর্থনীতি– এ তিনটির চাকা সুষম ও ন্যায্যভাবে চালানো যাচ্ছে। ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে যাত্রার ৬২ শতাংশই সাইকেলে হয়। তাদের সাইকেলের মধ্যে দুই চাকার যেমন আছে, তেমনি আছে মালপত্র পরিবহনে তিন চাকার সাইকেল। এই তিন চাকার সাইকেল আমাদের তিন চাকার অযান্ত্রিক রিকশার অত্যাধুনিক সংস্করণ মাত্র। নেদারল্যান্ডসে মানুষের চেয়ে সাইকেলের সংখ্যা বেশি। গত এক দশকে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি মেট্রো নেটওয়ার্কের সম্প্রসারণ হয়েছে চীনে। ভারত ২০২৯ সাল নাগাদ বিশ্বের দ্বিতীয় দীর্ঘতম মেট্রো নেটওয়ার্কের দাবিদার হতে চলছে। এসব দেশে হাঁটা বা সাইকেলের বাইরে অন্য কোনো যান্ত্রিক বাহনকে মূল শহর এলাকার স্টেশনগুলোতে কোনোভাবে গ্রাহ্য করা হয়নি। আমাদের ক্ষেত্রে প্রেক্ষিত ও বাস্তবতা বিবেচনায় হাঁটা ও সাইকেলের সঙ্গে কেবল অযান্ত্রিক রিকশাকে বিবেচনা করা যেতে পারে।
ঢাকা শহরে একটা রিকশাশুমারি করা জরুরি। এটা করলে কোন এলাকায় রিকশা-নির্ভরতা কেমন, সেটা জানা যাবে এবং তদনুযায়ী চালক ও মহাজনদের ফর্মালাইজেশনের আওতায় এনে অযান্ত্রিক রিকশাচালকদের শ্রম ও জীবিকা নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার পথ
সুগম হবে।
মু. মোসলেহ উদ্দীন হাসান: শিক্ষক, নগর ও অঞ্চল
পরিকল্পনা বিভাগ, বুয়েট
- বিষয় :
- পরিবহন