ইতিহাস
সাম্প্রদায়িক সহিংসতা দক্ষিণ এশিয়ার অভিশাপ
উপালি শ্রমণ
উপালি শ্রমণ
প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২০২৪ | ০০:০৭
ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, ভাষা ও সাহিত্য, ইতিহাস ও ঐতিহ্য এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অপরূপ সুন্দর ও সমৃদ্ধ অঞ্চল দক্ষিণ এশিয়া। আমাদের এই প্রাচীন সভ্যতার প্রাচুর্যকে বারবার কলংকিত করছে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘৃণ্য অভিশাপ। এই অভিশাপ ব্রিটিশরা এ অঞ্চলে উপহার হিসেবে দিয়ে গেছে এবং তারা চলে যাওয়ার ৭৭ বছর পরও আমরা সযত্নে তা ধারণ করছি। আমাদের রাজনৈতিক ব্যক্তিরা ব্রিটিশদের দেওয়া ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ অর্থাৎ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভাজন, হিংসা, দ্বন্দ্ব তৈরি করে ক্ষমতায় থাকার মন্ত্রকে স্পষ্টতই দৃঢ়ভাবে অনুসরণ করেছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির উত্থান হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে বিভাজন আরও গভীর করেছে। সেখানে মসজিদ ভেঙে মন্দির করছে। আবার নানান উদ্ভট যুক্তিতর্ক দিয়ে বীভৎস কাজগুলোকে ন্যায্য বলে দাবি করছে। বিখ্যাত ধর্মীয় গুরু, বুদ্ধিজীবী এবং তারকারাও দুঃখজনকভাবে তা সমর্থন করছেন। একই সরকার এমন উগ্র ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের তরী বেয়ে বারবার ক্ষমতায় আসছে। এভাবে সে দেশের গণমাধ্যমে বিশাল একটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটি সম্প্রদায়কে হীন করে ধর্মীয় সহিংসতাকে যেভাবে স্বাভাবিকভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, সেটা সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার জন্যই ভয়ংকর এবং উদ্বেগজনক।
শ্রীলঙ্কায়ও সিংহলি এবং তামিলদের মধ্যে জাতিগত ও ধর্মীয় সংঘর্ষের ধারাবাহিক ইতিহাস রয়েছে। ২০০৯ সালে তামিল টাইগারদের পরাজিত করার পর সেখানে মাহিন্দা রাজাপাকসে অতিমানবীয় দেবতার পর্যায়ে চলে যান। তারপর তাঁর ভাই গোটাবায়া রাজাপাকসেও ২০১৯ সালে একই সাম্প্রদায়িক বিভাজনের নীতি অনুসরণ করেন। সিংহলি সংখ্যাগরিষ্ঠতার রক্ষক হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন এবং মুসলিম ও তামিল সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়িয়ে গোটাবায়া ক্ষমতা অর্জন করেন। তবে ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কা এক কঠিন অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়ে, যা ব্যাপক প্রতিবাদের কারণ হয়। মানুষ বুঝতে পারে, মানুষের ন্যূনতম চাহিদাগুলো মেটাতেও ব্যর্থ সরকার। সব ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর নাগরিক একত্র হয়ে পরিবর্তনের দাবি জানায়। এর মাধ্যমে তারা রাজাপাকসে সরকারের বিভাজনমূলক রাজনীতি প্রত্যাখ্যান করে। শেষ পর্যন্ত জনগণের অভ্যুত্থান এবং গণরোষে পড়ে গোটাবায়া রাজাপাকসেকে দেশ ছেড়ে যেতে হয়, যা শ্রীলঙ্কার রাজনীতির ধারায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সূচিত করে। শ্রীলঙ্কার জনগণ বুঝতে পারে, সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে কেন্দ্র করে যারা ক্ষমতায় যায়, তারা দেশের জন্য সামগ্রিকভাবে মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না। রাজাপাকসেকে ক্ষমতাচ্যুত করার প্রায় দুই বছর পর সেপ্টেম্বর মাসে শ্রীলঙ্কায় সুষ্ঠু ও মুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে এমন নেতারা ক্ষমতায় আসেন, যারা সব সম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ। ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার (এনপিপি) জয়ের মাধ্যমে শ্রীলঙ্কা জাতিগত বিভাজন থেকে বেরিয়ে এসে জাতীয় ঐক্য ও গণতন্ত্রের পথে অগ্রসর হয়েছে। শ্রীলঙ্কার এই রাজনৈতিক পরিবর্তন বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত মূল্যবান উদাহরণ হয়ে উঠতে পারে।
বাংলাদেশেও সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকে হাতিয়ার করে বারবার ফায়দা লুটেছে বিগত সরকার। তবে তারাও ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেনি। আমাদের ছাত্র-জনতা জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাদের পরাহত করেছে। এখন আগামীর বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক হোক– এটাই আমাদের কামনা। এই দেশে ভিন্ন ধর্মের বলে কাউকে সন্ত্রস্ত হয়ে বা হীনম্মন্যতায় থাকতে হবে না। এখানে কোনো প্রকার জাতিগত বৈষম্য থাকবে না। এটাই আমাদের প্রত্যয় ও প্রত্যাশা।
এই অসাম্প্রদায়িক দেশ গঠনে আমাদের প্রধান লক্ষ্য হবে সব মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তার মতোই নিজ নিজ ধর্মীয় বিশ্বাস পালনের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। আইনের শাসন সর্বতোভাবে সবার জন্য সমভাবেই প্রযোজ্য হতে হবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে গণমানুষের আস্থাভাজন হয়ে উঠতে হবে, যাতে রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থায় সব জনগোষ্ঠী ভরসা রাখতে পারে।
আমাদের তরুণ প্রজন্ম নবউদ্যমে বৈষম্যহীন দেশ গড়তে সংকল্পবদ্ধ। তারা সাম্য ও সম্প্রীতির আশা পুনরুজ্জীবিত করেছে। এখানে সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণ মনোভাব নিয়ে নিজের ক্ষুদ্র মণ্ডলে সীমিত না থেকে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে একতাবদ্ধ হয়ে এগিয়ে যেতে হবে। এখানে সরকার ও রাজনীতিবিদদের ভূমিকা মুখ্য। তাদের সৎ উপায়ে কাজ করতে হবে, যাতে মানুষ বুঝতে পারে– তারা শুধু একটি জনগোষ্ঠীর জন্য নয়, সারাদেশের সব নাগরিকের স্বার্থ রক্ষা করবে। পাশাপাশি প্রতিটি ধর্মের বক্তা এবং নেতাদের অন্য ধর্ম ও জাতির বিরুদ্ধে বিদ্বেষপূর্ণ অপপ্রচার না করার জন্য সচেতন হতে হবে। একটি অঞ্চলের সহিংস ঘটনার বিষবাষ্প যেন অন্যত্র না ছড়ায়, তার জন্য সজাগ থাকতে হবে। বরং যেখানে সহিংস ঘটনা ঘটে, সেখানে সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দ্রুততর করতে হবে। সংস্কৃতি ও মিডিয়া কর্মীদেরও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের ঐক্য সমুন্নত রাখতে হবে। মিডিয়ায় সাময়িক ভিউ বাড়ানোর জন্য সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষকে ব্যবহার করার ভয়াবহ পরিণাম আমরা অনেকবার দেখেছি। সুতরাং এ বিষয়ে বিশেষভাবে নজরদারিতে রাখতে হবে। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘৃণ্য চক্র থেকে বের হয়ে একটি সুন্দর-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হোক– এটাই আমাদের কামনা।
উপালি শ্রমণ: লেকচারার, এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়
- বিষয় :
- ইতিহাস