ঢাকা বুধবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪

উন্নয়ন

ওয়ান বাংলাদেশ থেকে নাম্বার ওয়ান বাংলাদেশ

ওয়ান বাংলাদেশ থেকে নাম্বার ওয়ান বাংলাদেশ

খুরশিদ আলম

খুরশিদ আলম

প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২০২৪ | ০০:০৮ | আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০২৪ | ০০:০৯

বাংলাদেশে এখন বিভিন্ন ধর্ম-মত-শ্রেণি- পেশা, নৃগোষ্ঠী ও সংস্কৃতির লোকের বসবাস। কিন্তু এখানে বিভিন্ন ধরনের সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর মধ্যে হানাহানি, খুনোখুনি, দখল, চাঁদাবাজি, খণ্ডযুদ্ধ, ভাঙচুর, জ্বালাও-পোড়াও, মব ভায়োলেন্স, ঘৃণা-বিদ্বেষ, মামলাবাজি, নির্যাতন, অবিচার, কোন্দল, বাগ্‌যুদ্ধ লেগেই আছে। এগুলো সমাজে নানাবিধ সামাজিক দূরত্ব এবং অগ্রগতির পথে বাধা সৃষ্টি করছে। তাই সবার আগে এসব দূর করে একটি একক বা ওয়ান বাংলাদেশ গড়ার প্রস্তুতি নিতে হবে, যেখানে থাকবে না সামাজিক পরিচয়গত কোনো বৈষম্য। তবে কীভাবে তা অর্জন করা যাবে– একটি বড় প্রশ্ন। 
সামাজিক বৈষম্য প্রকট হয়ে ধরা পড়ে যখন দেশে কোনো সংকট দেখা দেয়। রাষ্ট্রের প্রথম কাজ হবে বিভিন্ন গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের মধ্যে কোনো প্রকার সামাজিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হতে না দেওয়া। যেমন কোনো একটি বিষয়ে যেন এক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অন্য গোষ্ঠী বৈষম্যমূলক আচরণ বা অসম্মানের অভিযোগ করতে না পারে। সবাই একে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান দেখাবে এবং সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে। মিলেমিশে থাকার চেষ্টা করবে। ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং সামাজিক বৈষম্য দূর করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র কোনো রকম পক্ষপাতিত্ব করবে না। তাহলে বিভিন্ন রকমের সামাজিক দূরত্ব দূর করা সহজ হবে। একটি সমাজের মধ্যে বিভিন্ন রকমের বৈষম্য থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তা সব সময় সর্বনিম্নে রাখা সম্ভব যদি সেই সমাজকে পরিকল্পিতভাবে পরিবর্তনের লক্ষ্যে এগিয়ে নেওয়া যায়। সব সময় সম্প্রীতি বজায় রাখার চেষ্টা করতে হবে। সামাজিক বৈষম্য নজরে আসার সঙ্গে সঙ্গে তা দূর করার চেষ্টা করতে হবে। অর্থনৈতিক বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে মাঝে মাঝে সামাজিক মর্যাদা, অনুভূতি, ক্ষোভ, মনঃপীড়ার মতো বিষয় আরও বেশি মূল্যবান হয়ে ওঠে। 

রাষ্ট্রের সব সমস্যার সমাধানে জনগণকে যুক্ত করতে হবে। বেশির ভাগ সময় দেখা যায়, জনগণকে শুধু উপকারভোগী হিসেবে দেখা হয়। তখন একেকজন একেকটি কথা প্রচার করে; ছড়ানো হয় নানা গুজব। এভাবে এটি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে টানাপোড়েন তৈরি করে। এর বেশির ভাগ তাদের মধ্যে সত্যি সত্যি না ঘটলেও একজন আরেকজনের প্রতিপক্ষ হিসেবে তৈরি করে। এভাবে সমাজে শেষ পর্যন্ত অশান্তি তৈরি হয়। 

রাষ্ট্রকে তাই রাজনৈতিক সমঝোতা বা সমন্বিত প্রয়াসে সদা প্রস্তুত থাকতে হবে। কোনোভাবে এক পক্ষ যেন আরেক পক্ষকে প্রতিপক্ষ হিসেবে তৈরি করে না ফেলে। অতীতের সব বৈষম্য বিবেচনায় নিয়ে নতুনভাবে ওয়ান বাংলাদেশ গড়ার পথে এগিয়ে যেতে হবে। ওয়ান বাংলাদেশ গড়ার  ক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতা থাকবে, তার দিকে নজর রাখতে হবে। যেমন–
খাদ্য নিরাপত্তা: বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা এমন একটি বিষয়, যা কোনোভাবে হালকা করে দেখার সুযোগ নেই। দেশের এমন কিছু অঞ্চল আছে, যেখানে অনেক লোক খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে থাকে। আবার কিছু পকেট এরিয়া আছে, যেখানে কোনো কোনো সময় অনেক লোক খাদ্য সংকটে ভোগে। তাই রাষ্ট্রকে সব সময় এসব বিষয় মোকাবিলা করতে হবে শক্ত হাতে।        
বাসস্থান: একইভাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কিছু লোক বাসস্থানের অভাবে কষ্টে থাকে। এমনকি ঢাকা শহরে ফুটপাতসহ বিভিন্নভাবে দিন যাপন করে। তাই প্রতিটি মানুষের জন্য বাসস্থান নিশ্চিত করতে হবে। দেশের কিছু লোক যদি ঘরে থাকে; কেউ যদি 
কোনো আশ্রয় না পায়; তাহলে সে দেশ কোনো মর্যাদা পাবে কি?
অর্থনৈতিক বৈষম্য: বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে বৈষম্য রয়েছে, এ বিষয়ে জরিপ চালিয়ে তা দূর করার ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পোরে। তেমনি জনগোষ্ঠীর কোনো একটি অংশ যদি যথেষ্ট আর্থিক সুবিধা না পায় তখন তারা অন্যদের সঙ্গে একটি দ্বন্দ্বে জড়িয়ে যাবে।  

সামাজিক বৈষম্য: বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সামাজিক বৈষম্যই শুধু নয়; একই সম্প্রদায়ের মধ্যেও বৈষম্য থাকে, যা অনেক সময় বাইরে থেকে বোঝা যায় না। আন্তঃসম্প্রদায়ের মধ্যে বৈষম্য দূর করা যেমন কঠিন, তেমনি একই সম্প্রদায়ের মধ্যে যে বৈষম্য থাকে, তা দূর করা আরও কঠিন। সমাজ গবেষণা এটি নিশ্চত করে, অর্থ, শিক্ষা ও ক্ষমতাগত বৈষম্য দূর করতে পারলে তা অল্প সময়ের মধ্যে অনেকটা কমে আসে। এর পরিমাণগত পরিমাপ কীভাবে করা যেতে পারে তার কতগুলো পরিমাপ পদ্ধতি রয়েছে। তবে যেটি তাৎপর্যপূর্ণ, সেটা বাহ্যিকভাবে ধরা পড়ে। অর্থাৎ আলাদা নৃগোষ্ঠীর মধ্যে বৈষম্য দূর করা অনেক কঠিন। কারণ এটি বাহ্যিকভাবে মানুষকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করে এবং তার সঙ্গে অন্যান্য বৈষম্য থাকে। সামাজিক বৈষম্য বিভিন্নভাবে হতে পারে। যেমন– আচার-আচরণ, পোশাক-আশাক, খাদ্যাভ্যাস, পছন্দ-অপছন্দ, ভাষা, পেশা, বসবাসের ধরন, রুচি ইত্যাদি। এর অনেকটাই সহজে কমিয়ে আনা সম্ভব। আবার কিছু তত সহজে সম্ভব নয়।         

ধর্মীয় পছন্দ-অপছন্দ: এটি এমন একটি বিষয়, যা কমিয়ে আনা অনেক কঠিন। পছন্দ শুধু নয়, এ ক্ষেত্রে একে অন্যকে বিশ্বাস করাও একটি বিষয়। এ দূরত্ব ঘুচিয়ে আনা অনেক কঠিন। এখানে সম্প্রদায়ের মধ্যকার দূরত্ব দূরীকরণে অনেক পদ্ধতি ব্যবহার করতে হয়, বিশেষ করে বিভিন্ন সামাজিক দূরত্ব (বোগারদাসের স্কেল) মাপার স্কেল ব্যবহার করতে হয়।     
শিক্ষাগত বৈষম্য: বিভিন্ন সম্প্রদায়, ভৌগোলিক এলাকা, ধর্মীয় গোষ্ঠী, নৃগোষ্ঠী, নারী-পুরুষের মধ্যে বিভেদ থাকে। এ বিভেদ দূর করার জন্য নিয়মিত পরিমাপ এবং তারপর প্রতিকারের ব্যবস্থা করা জরুরি।
এভাবে প্রতিটি এককের মধ্যে কিছু বৈষম্য দূর করতে হবে। এই পরিচয়গত বৈষম্য যদি না থাকে তাহলে পরস্পর পরিপূরক হিসেবে কাজ করবে। তখন সবার মিলিত শক্তি একটি একক দেশ গড়ার ক্ষেত্রে ভীষণ কাজে লাগবে। বর্তমান বাংলাদেশের উন্নয়নে এ শক্তি ভীষণভাবে কাজে লাগবে। সবার প্রয়াস তখন একটি অন্য রকম বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। 
এ জন্য যেসব কাজ করতে হবে তা হচ্ছে– ১. জনসংখ্যা একটি সম্পদ; কিন্তু এর সঠিক ব্যবহার করতে হবে। ২. জমিকে সঠিকভাবে ব্যবহারের পরিকল্পনা করতে হবে; ৩. পানি সঠিকভাবে ব্যবহারের পরিকল্পনা করতে হবে; ৪. হাওর সঠিকভাবে ব্যবহারের পরিকল্পনা করতে হবে। ৫. সমুদ্র ও সৈকত সঠিকভাবে ব্যবহারের একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে হবে এবং ৬. শিল্প-কারখানা গড়ে তুলতে হবে। 
এভাবে পরিচালিত হলে সে দেশটি কেন নাম্বার ওয়ান বা প্রথম সারির একটা দেশ হবে না? বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশ পিছিয়ে গেছে। কিন্তু অপার সম্ভাবনার দেশ শেষ হয়ে যায়নি। এ দেশের মানুষের যে প্রাণশক্তি আছে, যা প্রাকৃতিক ও সামাজিক দুর্যোগেও কাবু করতে পারে না। যত দুর্যোগ আসুক, মানুষ ফিরে দাঁড়ায়। এখানে মানুষ অন্যায় দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তার চেয়ে বেশি শক্তি নিয়ে ঘুরে দাঁড়ায়। তাই বাংলাদেশের সমাজ বিকাশের দর্শন হওয়া উচিত ‘ওয়ান বাংলাদেশ থেকে নাম্বার ওয়ান বাংলাদেশ’। এখন সবার দাবি হওয়া উচিত– ওয়ান বাংলাদেশ থেকে নাম্বার ওয়ান বাংলাদেশ চাই।

ড. খুরশিদ আলম: সমাজবিজ্ঞানী ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ; চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল রিসার্চ (বিআইএসআর) ট্রাস্ট
khurshedbisr@gmail.com

whatsapp follow image

আরও পড়ুন

×