গণঅভ্যুত্থানের ছাত্র নেতৃত্ব মাঠের রাজনীতিতে কেমন করবে?
হাসান মামুন
হাসান মামুন
প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২০২৪ | ০০:১৪ | আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০২৪ | ০০:১৪
গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দানকারী ছাত্ররা রাজনৈতিক দল গঠন করবে কিনা– সে আলাপ উঠেছিল আগস্টের মধ্যভাগেই। তাদের হাতে নতুন দল গঠিত হওয়াকে স্বাভাবিক বলেও মনে করা হচ্ছিল। এ অঞ্চলে আগেও গণঅভ্যুত্থান হয়েছে– ঊনসত্তরে এবং স্বাধীন বাংলাদেশে নব্বইয়ে। তবে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট ও ধরন একেবারে আলাদা। গতানুগতিক নেতৃত্ব ছাড়াই এবং কোটা সংস্কারের মতো দাবি ঘিরে গড়ে ওঠা আন্দোলন দ্রুত রূপ নেয় গণঅভ্যুত্থানে। এতে শেষতক হাসিনা রেজিমের পতন ঘটলে যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়, তাতে আন্দোলনে নেতৃত্ব দানকারী ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ থেকে তিনজন যোগ দেন।
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে দেওয়া প্রথম ভাষণেই বলেছিলেন, ছাত্ররা তাদের ‘প্রাথমিক নিয়োগকর্তা’। গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিরাও উপদেষ্টা পরিষদ গঠনে ভূমিকা রেখেছিলেন। এ প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিল সেনাবাহিনী। ইতোমধ্যে এ সরকারের ১০০ দিনেরও বেশি অতিবাহিত। আর উপদেষ্টা পরিষদের ‘পারফরম্যান্স’ নিয়ে জনপরিসরে চলছে আলোচনা। ফ্যাসিবাদী শাসন হটিয়ে দায়িত্ব নিয়েছেন বলে বড় প্রত্যাশার চাপ রয়েছে তাদের ওপর। উপদেষ্টা পরিষদে অন্তর্ভুক্ত ছাত্রনেতাদের ভূমিকা আবার পৃথকভাবে মূল্যায়িত হচ্ছে।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছিল বড় নাজুক পরিস্থিতিতে। সে কারণেও হয়তো সুবিবেচনার ছাপ অনেক ক্ষেত্রেই পড়েনি। উপদেষ্টা পরিষদে তিন ছাত্রনেতার যোগদানও ‘সুপরিকল্পিত’ ছিল বলে মনে হয় না। তবে সিনিয়র সিটিজেনদের সঙ্গে সদ্য স্নাতকদের সরকার পরিচালনায় অংশগ্রহণ উভয় পক্ষের জন্যই নতুন অভিজ্ঞতা। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকার পরিচালনায় তাদের কর্মকাণ্ড সবার মনোযোগ কেড়েছে। বরাবরই তরুণদের ভূমিকায় আস্থাশীল মুহাম্মদ ইউনূস তাদের ওপর বিশেষভাবে নির্ভর করছেন– এটাও স্পষ্ট। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সিংহভাগ অবশ্য রয়ে গেছে পরিবর্তিত ময়দানে; অন্যান্য রাজনৈতিক দল যেখানে সক্রিয়। সরকারের সঙ্গে সে অংশের সম্পর্ক সহযোগিতা ও সমালোচনার। দিন যত যাচ্ছে; সরকারের কাজে তাদের আপত্তি বেড়ে যাওয়াও লক্ষণীয়। তবে উপদেষ্টা পরিষদে থাকা সহযাত্রীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের কারণে আবার সেটি বেশি বাড়ছে না। সবকিছুর পরও সরকার তো প্রাথমিকভাবে তাদের ইচ্ছাতেই গঠিত। এর সাফল্য তাদেরই সবচেয়ে বেশি চাইবার কথা।
গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী নির্বাচন ও নতুন ধারায় দেশ পরিচালনায় ছাত্রদের বিশেষ আগ্রহ থাকাও অস্বাভাবিক নয়। আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্ব থেকে ক্রমে স্পষ্ট হয়েছে, এতে নেতৃত্ব দানকারী ছাত্রদের রয়েছে বিশেষ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি। হাসিনা সরকার পতনের পাশাপাশি তারা চেয়েছে ‘নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত’। ফ্যাসিবাদ পুনরুত্থানের কোনো সুযোগ তারা রাখতে চাইছে না। এ জন্য সংবিধান সংশোধনেও আগ্রহী। সরকারও অন্যান্য ক্ষেত্রের পাশাপাশি সংবিধান সংস্কারে কমিশন গঠন করেছে, যার সুপারিশ মিলবে ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে। সেসব নিয়ে আবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসবে সরকার। এরই মধ্যে খবর– জানুয়ারিতে গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দানকারীদের পক্ষ থেকে একটি রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করবে। তাদের ভেতর থেকে ‘জাতীয় নাগরিক কমিটি’ গঠনের সময়ও এ নিয়ে কিছু কথাবার্তা উঠেছিল। এর পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘সমন্বয় কমিটি’ গঠনের সময়ও কম আলোচনা হয়নি। গণঅভ্যুত্থানের চেতনায় তারুণ্যনির্ভর দল গঠনের প্রয়োজনীয়তা ও সম্ভাবনার কথা তখন ভালোভাবেই বলা হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বিভিন্ন জেলায় গিয়ে ছাত্র-নাগরিক জমায়েতে আলোচনার সময়ও নতুন দল গঠনের তাগিদের কথা শোনা গিয়েছিল। অবশেষে জানা গেল, সরকারে যোগদানকারী একজন উপদেষ্টার নেতৃত্বে ছাত্রদের রাজনৈতিক দলটি আসবে জানুয়ারি কিংবা ফেব্রুয়ারিতে। নির্বাচনে অংশগ্রহণের লক্ষ্য নিয়েই দলটি আত্মপ্রকাশ করবে। এ অবস্থায় জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ‘প্রেশার গ্রুপ’ হিসেবেই থেকে যাবে বলে জানানো হচ্ছে।
এ দুটি প্ল্যাটফর্ম থেকে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কমিটি গঠনের কাজ চলমান। নতুন দল গঠনে এ প্রক্রিয়ার ভূমিকা থাকবে। অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজ থেকে এসে অনেকেই এতে যোগ দেবেন বলে ধারণা। তাদের সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা এবং নির্বাচনী এলাকা ধরে সম্ভাব্য প্রার্থী নিয়ে ভাবনাচিন্তাও চলছে বলে জানা যায়। উপদেষ্টা পরিষদের কেউ এতে যোগ দিলে তিনি আগে পদত্যাগ করবেন। এটাকে যাতে সরকারের সহায়তায় গঠিত ‘কিংস পার্টি’ মনে না হয়, সে জন্যই এমন চিন্তা। বহুল আলোচিত ওয়ান-ইলেভেনের পর একাধিক কিংস পার্টি গঠনের উদ্যোগ মাঠে মারা গিয়েছিল। ‘দুই নেত্রীকে মাইনাস’ করার পরিকল্পনাও কার্যত সফল হয়নি। গণঅভ্যুত্থানের তোড়ে তাদের একজন অবশ্য এখন দেশের বাইরে। গুরুতর অভিযোগে তাঁর বিচারের কার্যক্রমও শুরু হয়েছে। আরেক নেত্রী এখন মুক্ত হলেও খুব অসুস্থ। তবে তাঁর পুত্র তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি রাজনীতিতে বলিষ্ঠভাবে উপস্থিত। জামায়াতে ইসলামীও ক্রমে শক্তি সঞ্চয় করছে। এ অবস্থায় গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দানকারীদের ভেতর থেকে নতুন দল হলে সেটা রাজনীতিতে ভিন্ন মাত্রা যোগ করবে বৈ কি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে বলা হচ্ছে, প্রচলিত কোনো দলই গণঅভ্যুত্থানের চেতনা সঠিকভাবে ধারণ করছে না। পরিবারতন্ত্র উচ্ছেদ, দলে গণতন্ত্র চর্চা, বিভাজন ও পাল্টাপাল্টির বদলে তারা ‘দায় ও দরদের রাজনীতি’ কায়েমের কথা বলছে। তা সত্ত্বেও বিভিন্ন প্রশ্নে তাদের মধ্যে বোঝাপড়া এখনও অসম্পূর্ণ মনে হয়। ছাত্রনেতাদের মধ্যে আছে বিভিন্ন চিন্তাধারার উপস্থিতি। কিছু মতভিন্নতা নিয়েও অবশ্য তারা একই দলভুক্ত হতে পারে। পঁচাত্তর-পরবর্তীকালে বিএনপি গঠনের সময়ও বিভিন্ন চিন্তাধারার মানুষকে এক ছায়াতলে আসতে দেখা গিয়েছিল। সেটিকেও কিংস পার্টি বলে অভিহিত করা হতো। তবে লক্ষণীয়, চরম প্রতিকূলতায়ও দলটি টিকে ছিল এবং এখন রাজনীতির মাঠে তারা প্রবলভাবে উপস্থিত। ভিন্ন পরিস্থিতিতে গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দানকারী ছাত্রদের ভেতর থেকে তেমন আরেকটি দল উঠে দাঁড়াতে পারবে বলে মনে করা হচ্ছে। বিএনপি থেকে পৃথক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হয়ে তারা আবির্ভূত হতে পারবে বলে অনেকের ধারণা।
এমনও বলা হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকারে যোগ না দিয়ে ছাত্ররা পারত একটি কার্যকর প্রেশার গ্রুপ হিসেবে মাঠে থাকতে; ক্রমে রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে। অচেনা, অস্থির সময়ে সরকার পরিচালনার মতো কাজে যুক্ত হয়ে তারা এরই মধ্যে সমালোচিতও হয়েছে কিছুটা। তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য এটা ইতিবাচক হয়নি বলে মনে করা হচ্ছে। তবে চটজলদি নেওয়া অবস্থান সংশোধন করে এগোনোর প্রয়াসও তাদের মধ্যে লক্ষণীয়। সে জন্যই বোধ করি গুরুত্ব পাচ্ছে উপদেষ্টার পদ ছেড়ে রাজনৈতিক দল গঠনে নেমে পড়ার বিষয়টি। জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা একটি সরকার উৎখাতে যে ছাত্রদের ভূমিকা ছিল অসাধারণ; মাঠের রাজনীতিতে নেমে তারা কেমন করে, সেটা দেখার অপেক্ষায় এখন সবাই। এই ইস্যুতে বাড়বে আলোচনা; প্রক্রিয়াটি নিয়ে নতুন প্রশ্নও উঠবে। ‘নির্বাচনের রোডম্যাপ’ও হয়তো এসে যাবে এর মধ্যে। এ ক্ষেত্রে তাদের অভিমতও কম গুরুত্ব পাবে না। ভবিষ্যতে যারাই সরকার গঠন করুক; ছাত্র ও তারুণ্যনির্ভর নতুন দল মাঠে থাকলে রাজনীতিতে এর প্রভাব পড়বেই। তাদের কাছ থেকে বাস্তবতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ভূমিকাও প্রত্যাশিত। এ অঞ্চলের মানুষের ধারাবাহিক সংগ্রামের মর্ম ধারণ করেই যেন আগামীর বাংলাদেশ দাঁড়ায়– সে লক্ষ্যে অটল থেকেই তাদের এগোতে হবে।
হাসান মামুন: সাংবাদিক, বিশ্লেষক
- বিষয় :
- সমকালীন প্রসঙ্গ