ঢাকা বুধবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪

কুড়িগ্রামে নারীর কর্মক্ষেত্র বাড়ানো দরকার

কুড়িগ্রামে নারীর কর্মক্ষেত্র বাড়ানো দরকার

.

এম রশিদ আলী

প্রকাশ: ০১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:৪৪

‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’– জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম নারী ও পুরুষকে এভাবেই দেখেছেন। তবে কর্মসংস্থানে বাংলাদেশের কুড়িগ্রামের নারীরা এখনও পিছিয়ে। এমন নয় যে তারা উদ্যমহীন; বরং প্রকৃতির নিয়মেই তারা অদম্য। কেননা প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও নদীভাঙনপ্রবণ এবং দারিদ্র্যপীড়িত এ অঞ্চল। এখানে বেঁচে থাকা ও টিকে থাকার লড়াই প্রবল। আমি মনে করি, এ অঞ্চলে নারীর কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় অন্তরায় উপযুক্ত কর্মক্ষেত্রের অভাব। 

২০২১ সালের এশিয়ান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্টের দেওয়া তথ্য একটি চিত্র উন্মোচন করে। তা হলো, পোশাক খাতের ৪০ লাখ শ্রমিকের মধ্যে ৫৯.১২ শতাংশই নারী; সংখ্যার হিসাবে যা ২৩ লাখেরও বেশি। নারীর অংশগ্রহণের এই হারের পেছনে কিন্তু আমাদের ক্ষেত্র সৃষ্টির অবদান অনেকখানি। কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করা গেছে বলেই আর্থসামাজিক ভারসাম্যের চাবি নারীকে আমরা অংশগ্রহণকারী হিসেবে পেয়েছি। বর্তমান বৈশ্বিক বাজার বাস্তবতার নিরিখে পোশাক খাত যতখানি ক্ষেত্র তৈরি করেছে, সম্ভবত আর কোনো খাত এত বিস্তৃত ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে পারেনি। তবে একটি বাস্তবতা হচ্ছে, তৈরি পোশাক কারখানার অনুকূল পরিবেশের দাবি অনুযায়ী এই ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে মূলত শহরে। বিশেষত রাজধানী ও তার আশপাশে। কিন্তু গ্রাম পর্যায়ের নারীদের বৃহত্তর পরিসরে কর্মের অংশ করে তোলার অবকাশ কোথায়! পরিসংখ্যান বলছে, গ্রাম পর্যায়ে প্রায় ৮০ শতাংশ নারীর কাজ করার ইচ্ছা থাকলেও সুযোগ কম।

কুড়িগ্রামের নারী উদ্যোক্তা সিরাজুম মুনিরার গল্প বলা যায়। তিনি চার বছর ধরে ‘বাড়ি নকশি পণ্য’ নামে একটি ফেসবুক পেজের মাধ্যমে অনলাইন ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন। তাঁর ভাষ্যে আমাদের পশ্চাৎপদ গড় সমাজ বাস্তবতা উঠে এলো। তিনি মনে করেন, প্রান্তিক পর্যায়ে নারী উদ্যোক্তাদের বড় বাধা পরিবার ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ। নানা বাধার পরও নারীরা কোনো না কোনোভাবে মানিয়ে নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। মফস্বল শহরগুলোতে অনলাইনে কাজ করতে গেলে আরও বেশি সমস্যায় পড়তে হয়। সঠিক সরবরাহ ব্যবস্থাপনার অভাবে পণ্য গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দিতে বাধার মুখে পড়তে হয়। পাশাপাশি আছে কাঁচামালের সংকট। তবে পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে নতুন নতুন নারী উদ্যোক্তা ও কর্মী তৈরি হবে– এমন ইতিবাচক বিশ্বাস রয়েছে মুনিরার। 
কুড়িগ্রামের অনন্যা মহিলা উন্নয়ন সংস্থার পরিচালক আলেয়া বেগমের ভাষ্য, ‘আমাদের গ্রামে অনেক নারী আছে, যারা কাজ চায়। কিন্তু কুড়িগ্রামে কাজ দেওয়ার মতো সুযোগ কি আর আছে? যদি কোনো পোশাক কারখানা অথবা উৎপাদনমুখী প্রতিষ্ঠান থাকত কিংবা সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে দেশে-বিদেশে তৈরি করা পোশাক ও হস্তশিল্প পণ্য সরবরাহের সুযোগ থাকত, তবে বহু নারী উৎপাদনমুখী কর্মী হয়ে উঠত।’ 

কুড়িগ্রামের জলবায়ু নিয়ে আক্ষেপ রয়েছে এর অধিবাসীদের মধ্যে। দুর্যোগপ্রবণ এলাকা হওয়ায় দারিদ্র্যের প্রভাবে এখানে নারীর জীবনে প্রারম্ভিক বাধা হিসেবে আবির্ভূত হয় বাল্যবিয়ে। পরবর্তী সময়ে এর শিকার মেয়েরা নানা আর্থসামাজিক সমস্যার সম্মুখীন হয়। এ ছাড়া পারিবারিক সম্পদ নারীর মাঝে সুষম বণ্টিত হয় না। পারিবারিকভাবে সম্পদের সমান ভাগ থেকে যেমন বঞ্চিত হয়, একই বঞ্চনার ধারাবাহিকতা বজায় থাকে নানান বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানেও। তবে ব্যতিক্রমও রয়েছে। অনেক নারী সেইসব ব্যতিক্রমের সুবাদেই পায়ের নিচে শক্ত মাটি পাচ্ছে। ঋণ পাচ্ছে, ব্যবসা করছে। এই ধারার উদ্যোগ কুড়িগ্রামে সামান্যই।
কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক নুসরাত সুলতানা। তাঁর অভিমত, ‘বাংলাদেশের মধ্যে কুড়িগ্রাম একটি উর্বর জায়গা। এখানে শুধু পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করলেই কৃষিসহ বিবিধ খাতে নারীর কর্মক্ষেত্র তৈরি করা সম্ভব।’ তাঁর মতানুসারে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধের জন্য একটি ব্যতিক্রমী উদ্যোগ হতে পারে পরিবারপ্রধানদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। এটি নিশ্চিত হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই এই গর্হিত সামাজিক সাপ অনেকটাই ফণা নামাবে। তিনি বলেন, ‘সেই লক্ষ্যে কাজ করছি আমরা। পাশাপাশি মেয়েদের সরকারিভাবে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হচ্ছে।’
উন্নত সমাজ গড়ে ওঠে নারী-পুরুষের যৌথ প্রচেষ্টায়। উন্নত বিশ্ব এর উদাহরণ। নারীর কাজে যেমন উৎসাহ দেওয়া প্রয়োজন, তেমনি নারীর সুষ্ঠু ও সুন্দর কর্মক্ষেত্র তৈরির দায়িত্বও নিতে হবে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলসহ সবাইকে, যার যার জায়গা থেকে। কুড়িগ্রামে নারীর সরকারি-বেসরকারি কর্মক্ষেত্র তৈরি হোক, এই প্রত্যাশা রাখছি।

এম রশিদ আলী: উন্নয়নকর্মী, কুড়িগ্রাম
 

whatsapp follow image

আরও পড়ুন

×