ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারি ২০২৫

সকল মতের সমাবেশ, চেতনায় বাংলাদেশ

সকল মতের সমাবেশ, চেতনায় বাংলাদেশ

কাজী জহিরুল ইসলাম 

কাজী জহিরুল ইসলাম 

প্রকাশ: ০২ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:৫৭

মেয়েটির নাম অরোর, ছিপছিপে গড়ন, বেশ লম্বা, নাকটা যথেষ্ট খাড়া, গায়ের রং তেলতেলে কালো। আমি বেশ ভূমিকা করে বিনয়ের সঙ্গেই, কৌতূহল দমন করতে না পেরে অসভ্যতাটা করলাম। তোমার এথনিসিটি কী? ও ঝটপট জবাব দেয়, আমি রুয়ান্ডিজ। আমি বলি, তোমার জাতীয়তা তো আমি জানিই। জানতে চাইছিলাম এথনিসিটি। ও আবারও বলে, আমি রুয়ান্ডিজ। নাছোড়বান্দা আমি আবারও প্রশ্ন করি, হুতু, না তুতসি? ও তৃতীয়বারের মতো বলে, আমি রুয়ান্ডিজ। এবার জবাবটা দিয়েই ভিড়ের মধ্যে মিশে যায়; আমার আশপাশে আর দাঁড়ায় না। আমার আরেক রুয়ান্ডিজ সহকর্মী, সে অবশ্য পুরুষ, ওয়েলার্স; ওকে একদিন ধরি– ওয়েলার্স, তোমার উচ্চতা, নাক-মুখের গড়ন দেখে আমি অনুমান করছি তুমি তুতসি। আমি কি ঠিক বলেছি? ওয়েলার্সও অরোরের মতো একই কথা বলে, আমি রুয়ান্ডিজ। যেহেতু ও সরাসরি আমার অধীনেই কাজ করে এবং পুরুষ সহকর্মী, ওকে একটু চেপে ধরাই যায়। অরোরের বিষয়টা ওকে খুলে বলি এবং জানতে চাই, তোমরা দু’জনই কেন নিজেদের জাতিগত পরিচয় গোপন করছ? এখনও কি সেই ভয় তাড়িয়ে বেড়ায়? ও বলে, আমরা সেসব ভয়াবহ দিনের কথা জাতীয়ভাবেই বিস্মৃত হয়েছি। একসময় রুয়ান্ডায় হুতু, তুতসি নামে দুটো জাতির মানুষ বসবাস করত; আজ আর তারা নেই। এখন রুয়ান্ডায় একটি জাতিই বসবাস করে। তারা সবাই রুয়ান্ডিজ। আমাদের আর কোনো পরিচয় নেই।

হুতু-তুতসির দ্বন্দ্ব অনেক প্রাচীন। ১৯৯৪ সালের ৬ এপ্রিল সন্ধ্যায় তানজানিয়ার দারুস সালাম থেকে ফিরছিলেন রুয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট জুভেনাল হাভিয়ারিমানা। একই প্লেনে তাঁর সঙ্গে ছিলেন বুরুন্ডির প্রেসিডেন্ট সাইপ্রিয়েন তারিয়ামিরা। কিগালি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের মুহূর্তে, রাত ৮টা ২০ মিনিটে দুটি মিসাইলের আক্রমণে বিধ্বস্ত হয় বিমান। হুতু সম্প্রদায়ের দুই প্রেসিডেন্ট একসঙ্গে নিহত হন। প্রেসিডেন্ট হত্যার দায় গিয়ে পড়ে তুতসি গেরিলাদের ওপর। ব্যস, শুরু হয়ে যায় তুতসি নিধন। শিশুকাল থেকে একসঙ্গে বেড়ে উঠেছে, একই স্কুলে পড়েছে, প্রাণের বন্ধু। কিন্তু তুতসি হওয়ার অপরাধে অবলীলায় বন্ধুর গলায় ছুরি চালিয়ে দিচ্ছে আরেক বন্ধু। বন্ধুর তুতসিকন্যাকে ধর্ষণ করে হত্যা করছে; স্বামী তার তুতসি স্ত্রীকে হত্যা করছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে চেকপোস্ট বসিয়ে হত্যা, গির্জায় ঢুকে হত্যা, বিদ্যালয়ে ঢুকে হত্যা। কাগেরা নদীর জল তুতসি-রক্তে লাল। এভাবে ১০৪ দিন পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যাপক হস্তক্ষেপে ১৯ জুলাই শান্ত হয় হুতু রক্তের ঝড়। বন্ধ হয় রুয়ান্ডার এই জাতিগত সংঘাত। ওরা বলে, ‘১০০ দিনে ১ মিলিয়ন তুতসি নিধন’।

এরপর ক্ষমতায় আসেন তুতসি প্রেসিডেন্ট পল কাগামে। তিনি ক্ষমতা গ্রহণ করেই বলেন, আর নয় হত্যা, আর নয় প্রতিশোধ। আজ থেকে আমরা কেউ হুতি নই, কেউ তুতসি নই; আমরা রুয়ান্ডিজ। এই জাতীয় ঐক্য রুয়ান্ডাকে আজ দারিদ্র্যের অতল অন্ধকার থেকে অনেক ওপরে টেনে তুলেছে। সবচেয়ে বড় কথা, আইনের শাসন দারুণভাবে উপস্থিত। কেউ ট্রাফিক আইন ভাঙে না। থানায় মামলা নেই বললেই চলে। দেশটি প্রায় অপরাধশূন্য। আফ্রিকায় যে এত সুন্দর একটি দেশ গড়ে উঠেছে, দেখে আমি অবাক।

বাংলাদেশে এখন এ রকম একটি জাতীয় ঐক্য দরকার। শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকারকে হটানোর জন্য গত জুলাই মাসে সেই ঐক্য গড়ে উঠেছিল। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর মাঝে মাঝেই সেই ঐক্যে ফাটল দেখা দিচ্ছে। আর তখনই সেই ফাটল থেকে সাপের মতো মাথা তুলছে দেশবিরোধী শক্তি। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য আমাদের এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য। সম্প্রতি দেশের সবচেয়ে বড় দুটি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করে এই ঐক্যের কথা বলেছেন। এখন সরকারের দায়িত্ব হলো ঐক্য গড়ার প্রক্রিয়াকে একটি সাংগঠনিক কাঠামো দেওয়া। দেশের সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একজন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে আমরা যেমন অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেছি, তেমনি এমন আরেকজনের নেতৃত্বে আমরা একটি ‘জাতীয় নাগরিক ঐক্য’ গঠন করব। হতে পারে ড. কামাল হোসেনের মতো কোনো বর্ষীয়ান মানুষ। প্রথমে ১০০১ সদস্যের একটি জাতীয় কমিটি হবে। সেই কমিটিতে সকল রাজনৈতিক দলের, সকল মতের, সকল ধর্মের, সকল সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতারা থাকবেন। জাতীয় কমিটিতে সকল জেলা ও বিভাগের প্রতিনিধি থাকবেন। বিভাগীয় প্রতিনিধিদের নেতৃত্বে আবার বিভাগীয় কমিটি থাকবে। সেসব কমিটি সংশ্লিষ্ট জেলার প্রতিনিধি থাকবেন। তাদের নেতৃত্বে জেলা কমিটি হবে, সেখানে সব উপজেলার প্রতিনিধি থাকবেন। তাদের নেতৃত্বে উপজেলা কমিটি হবে, সেখানে সব ইউনিয়নের প্রতিনিধি থাকবেন। এভাবে গ্রাম পর্যায়ে, পৌর এলাকার ওয়ার্ড পর্যায়ে জাতীয় নাগরিক ঐক্যের কমিটি হবে। প্রবাসীদের মধ্যেও দেশভিত্তিক, এমনকি শহরভিত্তিক কমিটি হবে। সব কমিটি এবং সদস্যের নাম একটি ওয়েবসাইটে থাকবে, যাতে সদস্যরা ওয়েবসাইটে ঢুকেই নিজেদের নাম এবং ছবি দেখতে পায়। এতে সবাই উৎসাহ পাবে, জাতীয় ঐক্যের সঙ্গে একাত্ম বোধ করবে। এই ঐক্যের ভিত্তি হবে দল-মত, জাত- ধর্ম নির্বিশেষে সবার ওপরে বাংলাদেশ। আমরা এই ঐক্যের একটা মূল স্লোগানও ঠিক করতে পারি– ‘সকল মতের সমাবেশ, চেতনায় বাংলাদেশ’। জাতীয় ঐক্যের সঙ্গে দেশের কবি-সাহিত্যিক-লেখক-সাংবাদিক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীদের যুক্ত করতে হবে। তাদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে দেশের স্বার্থ ও সমৃদ্ধির পক্ষে গান, কবিতা, প্রবন্ধ ইত্যাদি রচনা করার জন্য। শিল্পীদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে সেই সব গান গাওয়ার জন্য। সারাদেশের মানুষকে দল-মতের বিভেদ ভুলে এক ‘বাংলাদেশ’-এর পতাকাতলে দাঁড় করাতে হবে। জাতীয় ঐক্যের জাতীয় কমিটি আসুক এই ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যেই, যাতে আমরা এ বছর, ২০২৪ সালে সব বিভেদের ঊর্ধ্বে উঠে নতুনভাবে বিজয় দিবস উদযাপন করতে পারি।

কাজী জহিরুল ইসলাম: লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক
 

আরও পড়ুন

×