অন্যদৃষ্টি
ও মাই গড!
প্রতীকী ছবি
এস এম সাব্বির খান
প্রকাশ: ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:০৫
চট্টগ্রামের হাটহাজারীর পুণ্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ ব্রহ্মচারী। সম্প্রতি গঠিত বাংলাদেশ সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। চট্টগ্রাম নগরীর নিউমার্কেট মোড়ের স্বাধীনতা স্তম্ভে জাতীয় পতাকা অবমাননার অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি গ্রেপ্তার হন। এ ঘটনার পরপরই প্রতিবাদ ও নিন্দা জানান ভারত এবং দেশটির শাসক দল বিজেপিসহ একাধিক সংগঠন ও রাজনৈতিক নেতারা।
এরই ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রামে চিন্ময় দাসকে আদালত থেকে কারাগারে নেওয়ার সময় প্রাণঘাতী সংঘাতের ঘটনা ঘটে। সেখানে একজন আইনজীবীর মৃত্যু হয়। ভারতের বিভিন্ন পর্যায় থেকে চিন্ময় দাসের গ্রেপ্তার ইস্যুতে প্রতিবাদ এবং তাঁর নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানানো হয়েছে। আশ্চর্যজনক ব্যাপার, এর প্রতিটি পর্যায় থেকে চিন্ময়কে সর্বাত্মকভাবে একজন হিন্দুত্ববাদী ধর্মীয় নেতা হিসেবে উপস্থাপন করে তাঁর গ্রেপ্তারের বিষয়কে সাম্প্রদায়িক এজেন্ডা হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। অথচ ধর্মীয় কোনো ইস্যুতে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন বাংলাদেশের বিধান লঙ্ঘন করে জাতীয় পতাকা অবমাননার অভিযোগে। আর ধর্মের কথাই যদি আসে, তাহলে মহাবতার শ্রীকৃষ্ণের মতাদর্শ অনুসারে বলতে হয়, সব অপরাধই অধর্ম। আর অধর্ম নাশে দুষ্টের দমনই সবচেয়ে বড় ধর্ম।
বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত এবং জাতীয় প্রতীক অবমাননা করলে দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। এ ব্যাপারে সংশোধিত একটি আইন ২০১০ সালে মন্ত্রিসভায় পাস হয়। নতুন এই সংশোধিত আইনে কারাদণ্ডের পাশাপাশি ১০ হাজার টাকা জরিমানার বিধানও রাখা হয়েছে।
একজন ধর্মগুরু বা ধর্মীয় নেতা সমাজের সর্বস্তরে সন্দেহাতীতভাবেই একজন সম্মানিত ব্যক্তি। এর মানে এই নয়– তিনি কোনো অপরাধ করলে তাঁর বিচার করা যাবে না। দেশের যে কোনো নাগরিকই রাষ্ট্রের প্রচলিত আইন-বিধানের ঊর্ধ্বে নন। তিনি কোনো অপরাধ করে থাকলে প্রচলিত আইনে তাঁকে বিচারের আওতায় এনে দণ্ড নিশ্চিত করতে হবে। আদালতে অপরাধ প্রমাণ হলে চিন্ময় দাসের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এর সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্কই নেই। বিতর্কিত পরিস্থিতি সৃষ্টির মাধ্যমে অস্থিতিশীলতা ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতা উস্কে দিতে বিষয়টিকে ধর্মীয় এজেন্ডা হিসেবে তুলে ধরার অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে।
বাংলাদেশে কি এটাই প্রথম কোনো উল্লেখযোগ্য ধর্মীয় নেতা বা ব্যক্তিকে অপরাধের দায়ে আইনের আওতায় আনার ঘটনা? মোটেই না। রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে এ দেশের একাধিক ইসলামিক নেতাকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে। তাদের একাধিক ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ডও দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়; শিক্ষার্থী নির্যাতন, বলাৎকার, ধর্ষণ, দুর্নীতি, অনিয়মের মতো অপরাধে জড়িত থাকার দায়ে এ দেশে বহু ধর্মভিত্তিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ধর্মীয় শিক্ষক ও ব্যক্তিদের আইনের আওতায় এনে বিচার করা হয়েছে। তাহলে চিন্ময় দাসকে কেন অভিযুক্ত হিসেবে তাঁর অপরাধ যাচাইয়ে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যাবে না?
ভারতের সরকার, বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তি, সংস্থা ও সংগঠন চিন্ময় দাসের নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানিয়েছেন। ভারতে কি ধর্মগুরু বা ধর্মীয় নেতাদের সাতখুন মাফ? মোটেই তা নয়। তাহলে অন্য রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে তাদের এমন অনধিকার চর্চা ও উদ্ভট অভিব্যক্তির যৌক্তিকতা কী?
চিন্ময় দাসের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বলিউডের ‘ও মাই গড’ সিনেমার কথা মনে পড়ে গেল। সিনেমাতে দেখা যায়, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত একজন নাগরিক আদালতে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেন। শেষ পর্যন্ত ভণ্ড ও কট্টর ধর্মগুরুদের মুখোশ খুলে দেওয়ার পাশাপাশি মামলা জেতেন সেই ব্যক্তি। শক্তিশালী ও আধুনিক সমাজ ব্যবস্থা, ধর্মান্ধতাবিরোধী ও সুশাসনের বার্তাবাহী সিনেমাটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। খোদ ভারত যা সিনেমায় দেখাতে পারে, বাংলাদেশে সেটা বাস্তবে ঘটতে পারবে না! ও মাই গড!
এস এম সাব্বির খান: সহ-সম্পাদক, সমকাল
- বিষয় :
- অন্যদৃষ্টি