সমাজ
বাল্যবিয়ে অবসানে যা করতে হবে
.
মোছা. শ্যামলী খাতুন
প্রকাশ: ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:১০
সালেহা আক্তার (ছন্দনাম) কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুরের মেয়ে। সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী। বাবা-মা তেমন লেখাপড়া জানেন না। ‘সময় থাকতে কন্যা পাত্রস্থ করা’র প্রচলিত ভাবনা থেকে তারা সালেহার বিয়ের আয়োজন করেন। তবে সালেহা এই বিয়েতে রাজি নয়। উপায়ান্তর না পেয়ে সে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়; এক পর্যায়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে পড়ে। তারা বাল্যবিয়ের বিপদ সম্পর্কে বাবা-মাকে বুঝিয়ে সালেহাকে তাদের কাছে ফিরিয়ে দেয়।
সালেহা বেঁচে গেল ঘটনাচক্রে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে পড়ে। কিন্তু এ রকম কত সালেহাকে প্রতিদিন বাল্যবিয়ের শিকার হয়ে অকালে সংসারের যূপকাষ্ঠে নিজেকে বলি দিতে হচ্ছে কিংবা এ অভিশাপ থেকে বাঁচতে বাড়ি থেকে পালাতে গিয়ে এমনকি পাচারের শিকার হতে হচ্ছে, তার কি কোনো হিসাব আছে?
জাতিসংঘ শিশু সংস্থা-ইউনিসেফের চাইল্ড ম্যারেজ রিপোর্ট ২০২০ বলেছে, ওই বছর বাংলাদেশে ৫১ শতাংশ নারীর বিয়ে হয়েছিল তাদের শৈশবে। এখানে ৩ কোটি ৪৫ লাখ নারীর বিয়ে হয়েছে তাদের বয়স ১৮ বছর হওয়ার আগে এবং ১ কোটি ৩ লাখ নারীর বিয়ে হয়েছে তাদের বয়স ১৫ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৮ বছরের কম বয়সে বিয়ের হার ২০০৬ সালে ছিল ৬৪ শতাংশ, ২০১২ সালে ৫২ শতাংশ এবং ২০১৯ সালে ৫১ শতাংশ। গত ১০ বছরে বাল্যবিয়ে কমার যে হার দেখা যাচ্ছে, তা দ্বিগুণ হলেও ২০৩০ সালে বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের হার হবে প্রায় ৩০ শতাংশ। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের হার দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ।
বাল্যবিয়ে একটি অভিশাপ, কারণ তা মেয়েদের শৈশব কেড়ে নেয়। তার শিক্ষা, বিনোদন, মতপ্রকাশসহ নানা মানবাধিকার খর্ব করে এবং তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেয়। এর ফলে পুরুষদের মধ্যে দ্বিতীয় বিয়ে বেড়ে যায়, যৌতুক প্রথা উস্কানি পায়, অনাকাঙ্ক্ষিত জনসংখ্যা বেড়ে যায়।
ইউনিসেফের গবেষণা বলে, ১৮ বছরের আগে বিয়ের পিঁড়িতে বসা মেয়েদের অন্যদের তুলনায় পারিবারিক সহিংসতার শিকার হওয়ার ঝুঁকি বেশি। তাদের বেশির ভাগই স্বামী দ্বারা যৌন সহিংসতার শিকার হয়। বাল্যবিয়ের ফলে যদি কোনো কিশোরী সন্তানের মা হয়, তার গর্ভাবস্থা এবং প্রসবকালীন ঝুঁকি বেড়ে যায়। সেই সন্তানটিও স্বাস্থ্যগত ও মানসিক দিক থেকে ক্ষতির সম্মুখীন, এমনকি বঞ্চিত হয় শিক্ষা ও কর্মের সুযোগ থেকে।
বাল্যবিয়ের শিকার প্রধানত হয় গরিব পরিবারের মেয়েরা। কন্যাদায় থেকে দ্রুত মুক্তির তাড়া তো আছেই, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার ঘটনা এবং অনিয়ন্ত্রিত নারী-পুরুষ সম্পর্ক বেড়ে যাওয়ায় সমাজের দুর্বল অংশের অভিভাবকরা কিশোরী মেয়ের বিয়েকে সমাধান মনে করেন। বাল্যবিয়ে নিরোধ আইনে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, একটি মেয়ে ১৮ বছর বয়সের কমে বিয়ে করলে তার জন্য অভিভাবকদের শাস্তি হবে; ছেলেদের জন্য তা ২১ বছর। আইনে বাল্যবিয়ে যে করবে এবং বাল্যবিয়ে যে দেবে এবং তাদের সহযোগী– তিন পক্ষের জন্যই সাজার বিধান রয়েছে। যদি কোনো কাজি বাল্যবিয়ে নিবন্ধন করেন, তিনিও আসবেন শাস্তির আওতায় এবং সেই কাজির লাইসেন্স বাতিল করার কথাও আইনে উল্লেখ আছে। তারপরও জাতি এই সামাজিক মহামারি থেকে মুক্তি পাচ্ছে না।
অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা বাল্যবিয়ে কীভাবে ত্বরান্বিত করে, তার প্রমাণ হলো কভিড-পরবর্তী সময়ে বাল্যবিয়ের ভয়াবহ চিত্র। ইউএনএফপির একটি সমীক্ষা থেকে জানা যায়, অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও কভিড-১৯ মহামারি এবং সে সময় আরোপিত লকডাউন সাধারণ মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থাকে বিপর্যস্ত করেছে। ফলে স্বল্প আয়ের পরিবারের শিশুদের স্কুলে পড়া এক প্রকার বিলাসিতা হয়ে দাঁড়ায়। ফল– বাল্যবিয়ের ঘটনার আশঙ্কাজনক বৃদ্ধি।
বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। তবে আইন সম্পর্কে যথেষ্ট গণসচেতনতা তৈরি না হলে তা কার্যকারিতা হারাবে। দারিদ্র্য নিরসন কার্যক্রমের গতি বৃদ্ধির পাশাপাশি নারী শিক্ষার প্রসার কীভাবে রাষ্ট্রিক-সামাজিক, এমনকি পারিবারিক আয়-উন্নতিতে অবদান রাখে, সে সচেতনতাও জরুরি। তবে এসবের সঙ্গে যদি খোদ কিশোর-কিশোরীদেরই বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে সক্ষম করে তোলা হয়, তাহলে এই অভিশাপমুক্তির সম্ভাবনা নিকটবর্তী হবে। নিজেদের ভেতর নেতৃত্ব ও দায়িত্ববোধ গড়ে উঠলে বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে এই কিশোর-কিশোরীরা নিজেদের মতপ্রকাশ করতে সাহস পাবে, প্রতিবাদ করতে পারবে। তারা অভিভাবক ও শিক্ষকদের সহযোগিতায় নিজেদের ও অন্যদের বাল্যবিয়ের ঝুঁকি কমাতে কাজ করতে পারবে।
মোছা. শ্যামলী খাতুন: শেল্টার হোম ইনচার্জ, মুক্তি নারী ও শিশু উন্নয়ন সংস্থা, কুষ্টিয়া
- বিষয় :
- সমাজ