ঢাকা মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারি ২০২৫

রাজনৈতিক বন্দোবস্ত

ছাত্র সংগঠনগুলোকে অপরায়নের পুরোনো বৃত্ত ভাঙতে হবে

ছাত্র সংগঠনগুলোকে অপরায়নের পুরোনো বৃত্ত ভাঙতে হবে

ইফতেখারুল ইসলাম

ইফতেখারুল ইসলাম

প্রকাশ: ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:১২

রোববার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ‘জাতীয় ছাত্র সংহতি সপ্তাহ’ পালনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে মতবিনিময় সভার আয়োজন করে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের প্রতিনিধি উপস্থিত থাকলেও জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ও বামপন্থি ছাত্র সংগঠনগুলো ছিল না। এর কারণ হিসেবে ছাত্র ইউনিয়নের চবি শাখার সভাপতি সুদীপ্ত চাকমা সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ছাত্রশিবির কোনো কর্মসূচিতে উপস্থিত থাকলে তারা সেখানে যুক্ত হবেন না। তবে অনুপস্থিতির ব্যাপারে ছাত্রদলের কোনো নেতার মন্তব্য চোখে পড়েনি। 

উপস্থিত ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে ইসলামী ছাত্রশিবির ছাড়াও ছিল জাতীয় নাগরিক কমিটি, ছাত্র অধিকার পরিষদ, ইসলামী ছাত্র মজলিস, বিপ্লবী ছাত্র পরিষদ, ইসলামী ছাত্র আন্দোলন, স্টুডেন্ট’স অ্যালায়েন্স ফর ডেমোক্রেসি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা ও অধিকার রক্ষা পরিষদ।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক তর্ক ও আলাপে সাধারণত ছাত্রশিবিরের রাজনীতি নিয়ে গঠনমূলক কোনো আলোচনা ও বাহাস চোখে পড়ে না। সম্ভবত সচেতনভাবেই বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়। এর প্রধান কারণ কী? অথচ নয়া রাজনৈতিক বন্দোবস্ত কায়েম করতে গেলে সংগঠনটি নিয়েও বোঝাপড়া দরকার। 

আমরা দেখি, রাজনৈতিক বোঝাপড়ার প্রশ্নে আমাদের দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে ব্যর্থই হয়ে আসছে। যেমন আওয়ামী লীগ মূলত ফ্যাসিবাদের চর্চা, সাংস্কৃতিক বিভাজন ও লুটেরা গোষ্ঠীর রাজনীতি করেছে এবং বিএনপি মূলত লুটেরা গোষ্ঠীর কায়দায় রাজনীতি করতে গিয়ে কর্তাসত্তা হিসেবে দাঁড়াতেই পারেনি। আবার জামায়াত-শিবিরও যে ধরনের রাজনীতি দিতে চেয়েছে, তাও মূলত বিভাজন ও অপরায়নের রাজনীতি। ফলে স্বাধীনতা-পরবর্তী পাঁচ দশকে কোনো দলই রাজনৈতিক ও দার্শনিকভাবে জনগণের জন্য কল্যাণধর্মী বন্দোবস্ত হাজির করতে পারেনি। 

এখন জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নয়া রাজনৈতিক বন্দোবস্ত কায়েমের পরিসর তৈরি হয়েছে। সে ক্ষেত্রে তরুণদের অবস্থান কী হওয়া জরুরি, সেটি এক গুরুতর প্রশ্ন। পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যুক্ত বিপুল তরুণ রাজনৈতিক কর্মীর আগামী দিনে কী ভূমিকা হওয়া যুক্তিযুক্ত, সেটিও গুরুত্বপূর্ণ মামলা। এসব প্রশ্নের মোকাবিলা ও মীমাংসা ছাড়া নয়া রাজনৈতিক বন্দোবস্ত কায়েম অসম্ভব। 

একটা বিষয় খেয়াল করা দরকার, জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে তরুণরা স্রেফ আওয়ামী লীগকে উৎখাতের জন্য মাঠে নামেনি। এর লক্ষ্য ছিল কেবল ফ্যাসিবাদ গুঁড়িয়ে দেওয়া নয়, বরং পুরোনো রাজনৈতিক বন্দোবস্তও উপড়ে ফেলা। সে জন্য সর্বস্তরের তরুণরা লড়াইয়ের মাঠে একই কাতারে শামিল হয়েছিল। ছাত্রদল, ছাত্রশিবির, ছাত্র ইউনিয়ন, হেফাজতে ইসলাম, মাদ্রাসার শিক্ষার্থীসহ বাম-ডান সবাই ছিল। সবাই প্রাণ বাজি রেখে লড়েছে। এ ক্ষেত্রে তরুণরা পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলোর গতানুগতিক গণ্ডি ভেঙে ফেলেছিল। একটি সফল গণঅভ্যুত্থানের পর তরুণদের প্রতিনিধিত্বকারী ছাত্র সংগঠনগুলো অপরায়নের পুরোনো বৃত্তে আটকে থাকবে কেন? তরুণদের নয়া রাজনৈতিক বন্দোবস্ত কায়েমে নতুন বাস্তবতায় নতুন করে ভাবতে হবে। অতীতের বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে সবাইকে সংঘবদ্ধ হয়ে লড়তে হবে। 

বিদ্যমান বাস্তবতায় পুরোনো রাজনৈতিক বন্দোবস্ত নিয়ে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পুনর্গঠন সম্ভব নয়। তাই নয়া রাজনৈতিক বন্দোবস্ত কায়েম করতে গেলে তরুণদের পুরোনো বন্দোবস্তের বাইরে এসেই নতুন পরিসরে সংগঠিত হতে হবে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পুরোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত তরুণ রাজনৈতিক কর্মীদের তাই নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। এ ক্ষেত্রে তরুণরা যদি আগামী দিনের রাজনৈতিক সম্ভাবনা উপলব্ধি করতে পারেন, তাহলে তাদের নয়া রাজনৈতিক বন্দোবস্তে হাত দিতে হবে। বর্তমানে ছাত্রদল, ছাত্রশিবির, ছাত্র ইউনিয়নসহ সর্বস্তরের তরুণ রাজনৈতিক কর্মীর নিজেদের পুনর্গঠনে এটাই দুর্দান্ত সুযোগ। এ মুহূর্তে ছাত্র সংগঠনগুলো নতুন পরিসরে একতাবদ্ধ হয়ে রাজনীতির মাঠে হাজির হতে পারে।

এ ক্ষেত্রে দুটি প্রশ্ন তোলা জরুরি। এক. মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা যাই থাকুক; স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে মাঠে থেকেছে। এরই মধ্যে ভোটের রাজনীতিতেই দলটির অবস্থান তৈরি হয়েছে। শুধু তাই নয়, আওয়ামী লীগ, বিএনপি উভয় দলই জামায়াতের সঙ্গে আন্দোলন বা নির্বাচনী জোট বেঁধে রাজনীতিও করেছে। তাহলে ছাত্রদল ও ছাত্র ইউনিয়ন কোন যুক্তিতে ছাত্রশিবিরের রাজনীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে? জাতীয় রাজনীতিতে জামায়াত যদি সক্রিয় থাকতে পারে, তাহলে ক্যাম্পাসে কেন ছাত্রশিবির রাজনীতি করতে পারবে না? এসব প্রশ্ন যুক্তি ও প্রজ্ঞা দিয়ে মীমাংসা করা না গেলে আগামী দিনে তরুণদের পুনর্গঠন করা কতটা সম্ভব?  
জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদী বয়ান যেমন চুরমার হয়ে গেছে, তেমনিভাবে ছাত্রশিবিরকে অপরায়নের কৌশলও দুর্বল হয়ে পড়েছে। এখন নতুন পরিসরে নয়া রাজনৈতিক বন্দোবস্তের ক্ষেত্রে সর্বস্তরের তরুণদের একই কাতারে যোগ দেওয়া জরুরি। এই বার্তা দেশের সর্বস্তরের তরুণ রাজনৈতিক কর্মীদের জন্যও প্রযোজ্য। 

ইফতেখারুল ইসলাম: সহসম্পাদক,
দৈনিক সমকাল
iftekarulbd@gmail.com

আরও পড়ুন

×