ঢাকা বুধবার, ২২ জানুয়ারি ২০২৫

অন্যদৃষ্টি

আলু: খাওয়া ও দামের রেকর্ড 

আলু: খাওয়া ও দামের রেকর্ড 

প্রতীকী ছবি

মো. রওশন জামাল

প্রকাশ: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০১:১৮

এত উৎপাদন, এত সরবরাহ, এত সংরক্ষণ! তবুও আলুর দাম কমছে না। অথচ ২০১৮ ও ১৯ সালে নভেম্বর মাসে প্রায় ১০ লাখ টন উদ্বৃত্ত আলু ফেলে দিতে হয়েছিল। ওই দুই বছর আলুর দামও অনেক কম ছিল। এরপর আলুর দাম বেড়েছে; চাহিদাও বেড়েছে ক্রমাগত।

আলুর ‍উচ্চ বাজারমূল্য হওয়া সত্ত্বেও ভোক্তার চাহিদা কমেনি, ভক্ষণ কমেনি; বরং বেড়েছে। সবজি হিসেবে প্রায় এক কোটি টন আলু উচ্চমূল্যে ক্রয় করে খেয়ে ফেলে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশিরা। সবজি হিসেবে আলু খাওয়ার হিসাবে এটাই সম্ভবত বিশ্বে সর্বোচ্চ। ডাক্তারের সতর্কবাণী, পুষ্টিবিদের পরামর্শ, নানা রকম স্বাস্থ্যঝুঁকির আশঙ্কা জেনেও ‘আলুময়’ এক প্রাত্যহিক জীবন! 

২০২০ সালে ১০৪ লাখ টন আলু উৎপাদন হয়। উৎপাদনের দিক দিয়ে চালের পরেই আলুর স্থান। কৃষি বিভাগের প্রাক্কলন অনুযায়ী ২০৩০ সাল নাগাদ আলুর উৎপাদন ২০ মিলিয়ন টন হতে পারে। আলু আবাদের আওতায় বর্তমান জমি (৪.৮ হেক্টর) বেড়ে ২০৩০ সালে ৭.৫ লাখ হেক্টর হতে পারে। স্বল্পমেয়াদি (৬০-৯০ দিন) আলু ফসলটা আমন ধান ও বোরো ধানের মাঝখানে ফলানো যায়। 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুয়ায়ী, ২০২৪ সালে ১০৯ লাখ টন আলু উৎপাদিত হয়েছে। গত বছর এই উৎপাদন ছিল ১০৫ লাখ টন। ২০২৪ সালে প্রাক্কলিত আলুর চাহিদা ছিল ৯০ লাখ টন। জুন মাসের পর থেকেই আলুর উচ্চমূল্য থাকায় ভোক্তাকে আলু বাজেটিং করতে হয়েছে। নিম্ন আয়ের মানুষও আলু কম কিনতে পেরেছে। তারপরও নভেম্বরে এসে আলুর এত সংকট, এত দাম কেন? গবেষকরা কী বলবেন এ বিষয়ে? হিসাবে গলদ কোথায়? আলু নিয়ে নাটক কি চলতেই থাকবে বছর বছর? 

২০২২ সালে বার্ষিক মাথাপিছু আলু খাওয়ার হিসাবে বাংলাদেশ (৫৩ কেজি) ভারত (২৫ কেজি), শ্রীলঙ্কা (৮ কেজি) ও পাকিস্তানের (২৪ কেজি) চেয়ে অনেকে এগিয়ে। এশিয়ান এসব দেশে আলু মূলত সবজি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। প্রধান খাদ্য হিসেবে ইউক্রেন (১৪০ কেজি), পোল্যান্ড (৯৩ কেজি), বেলারুশ (১৬০ কেজি) বেশি আলু খায়। আলুর তরকারিপ্রিয় ভারত উপমহাদেশের মানুষ যেসব দেশে (মধ্যপ্রাচ্য, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য) বেশি, সেখানেও মাথাপিছু আলু খাওয়ার পরিমাণ বেশি নয়। সবজি হিসেবে মাথাপিছু ৫৩ কেজি আলু বিশ্বে সর্বোচ্চ এবং অস্বাভাবিক। বাঙালির আলু খাওয়ার পরিমাণ অব্যাহতভাবে বাড়ছে। 

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ভারত থেকে আলু আমদানির অনুমতি দিলেও আমদানি হয়েছে অনেক কম। মূল্য বেশি হওয়ায় ভারত থেকে আলু আমদানি করতে অনাগ্রহী ব্যবসায়ীরা। প্রধান আলু রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে (ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেন, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, বেলজিয়াম) কোনোটাই বাংলাদেশের প্রতিবেশী নয়; বরং বাংলাদেশ আলু রপ্তানির জন্য বাজার খুঁজছে। 

এ বছর কৃষক মাঠ থেকে আলু বিক্রি করেছিল ১২ থেকে ১৭ টাকা কেজি। কোল্ডস্টোরেজ কেজিতে ৭ টাকা। খুচরা বাজারে ৩৫ টাকায় বিক্রি করলে পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতার মুনাফা হওয়ার কথা। কিন্তু প্রতি কেজি আলু ৭৫ টাকা হওয়ার কারণ কী? শুধুই কি সিন্ডিকেট? যেখানে বাংলাদেশের উৎপাদন সক্ষমতা অব্যাহতভাবে বাড়ছে, সেখানে আলুর এই বাজার নৈরাজ্য চলতে দেওয়া যেতে পারে না। কৃষিপণ্যের বাজার নৈরাজ্য নিয়ে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের সক্ষমতা ও বাজার সিন্ডিকেটের দুর্বৃত্তায়নকে দোষ দেওয়া হয়। বাংলাদেশে শক্তিশালী কৃষিবাজার ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। একদিকে কৃষকের লোকসানের খবর, অন্যদিকে ভোক্তার নাভিশ্বাস। আলুর অস্থির বাজার, ফার্মিং সিস্টেম, চাহিদা ও সাপ্লাই চেইন নিয়ে ব্যাপক গবেষণার সময় এসেছে। 

পরিসংখ্যানে যতই গরমিল থাকুক, বাংলার কৃষক অন্তত ৯০ লাখ টন আলু উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করেছে। এই ৯০ লাখ টন আলু নিয়ে শক্তিশালী বাজার ব্যবস্থাপনা, কোল্ডস্টোরেজ ব্যবস্থাপনা, ভ্যালু চেইন নিয়ন্ত্রণ ও ভোক্তার দায়িত্বশীল আচরণের মাধ্যমে আলুর সংকট দূর হতে পারে।  

ড. মো. রওশন জামাল: পরিচালক, বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, সাভার, ঢাকা
roushonjamal@yahoo.com  

আরও পড়ুন

×