মৎস্য সম্পদ
ইলিশ সুরক্ষা অর্থনীতির স্বার্থেই জরুরি
ইলিশ মাছ
মো. মামুন হাসান
প্রকাশ: ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:৩৮
ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ। ইলিশের টেকসই উৎপাদন বৃদ্ধিতে ২০০৪ সালে ‘হিলশা ফিশারিজ ম্যানেজমেন্ট অ্যাকশন প্ল্যান’ প্রণয়ন করা হয় এবং তদনুযায়ী সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ইলিশের উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনে ইলিশের অবদান সর্বোচ্চ (প্রায় ১২%) এবং জিডিপিতে অবদান ১ শতাংশ। বিশ্বের মোট উৎপাদিত ইলিশের ৮০ শতাংশের বেশি আহরিত হয় এ দেশের নদ-নদী থেকে। শুধু তাই নয়; উপকূলীয় জেলে, মৎস্যজীবী সম্প্রদায় এবং উপকূলবাসীদের জীবন-জীবিকা নির্বাহে ইলিশের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রায় ৬ লাখ মানুষ ইলিশ আহরণে সরাসরি নিয়োজিত এবং ২০-২৫ লাখ মানুষ ইলিশ পরিবহন, বিক্রয়, জাল ও নৌকা তৈরি, বরফ উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ইত্যাদি কাজে প্রত্যক্ষ বা
পরোক্ষভাবে জড়িত।
বৈচিত্র্যময় জীবন ইলিশের। ইলিশ মূলত সামুদ্রিক মাছ হলেও প্রজননকালীন এ মাছ ডিম ছাড়ার জন্য বেছে নেয় স্বাদুপানির উজানকে। এ সময় ইলিশ দৈনিক প্রায় ৭১ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে পারে। প্রজননের উদ্দেশ্যে ইলিশ প্রায় ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার উজানে পাড়ি দিতে সক্ষম। সাগর থেকে ইলিশ যত ভেতরের দিকে আসে, ততই শরীর থেকে লবণ কমে যায়। এতে স্বাদ বাড়ে ইলিশের।
ইলিশ মাছের প্রধান প্রজনন মৌসুমে নিরাপদে ডিম ছাড়ার সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে এ বছর ১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর ২০২৪ (২৮ আশ্বিন থেকে ১৮ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ) পর্যন্ত মোট ২২ দিন সারাদেশে ইলিশ মাছ আহরণ, পরিবহন, মজুত, বাজারজাতকরণ, ক্রয়-বিক্রয় ও বিনিময় নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। দেশে ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধিকে সর্বসাধারণ, বিশেষ করে জেলে, মৎস্যজীবী সম্প্রদায় ও ইলিশের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যবসায়ী, আড়তদার, বরফকল মালিক, দাদনদার, ভোক্তাসহ সবাইকে সচেতন ও উদ্বুদ্ধ করাই উদ্দেশ্য। ২০২৪ সালে প্রধান প্রজনন মৌসুমে ইলিশ সংরক্ষণ এলাকা হিসেবে অভিযানে ৩৮টি জেলার ১৭৮টি উপজেলাকে নির্ধারণ করা হয়।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণার ফল বলছে, ১০ বছর আগে দেশের ২১টি উপজেলার নদ-নদীতে ইলিশ পাওয়া যেত। বর্তমানে ৭টি বিভাগের ৩৮টি জেলার ১৭৮টি উপজেলার আশপাশ দিয়ে প্রবাহিত নদীতে এ মাছ পাওয়া যাচ্ছে। পদ্মার শাখা নদী মহানন্দা থেকে শুরু করে মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওর এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মেদির হাওরেও ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। গবেষকরা জানিয়েছেন, একটি ইলিশ একসঙ্গে কমপক্ষে ৩ লাখ ও সর্বোচ্চ ২১ লাখ ডিম ছাড়ে। এসব ডিমের ৭০-৮০ শতাংশ ফুটে রেণু ইলিশ হয়। এর সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে, যা পরবর্তী সময়ে ইলিশে রূপান্তরিত হয়। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, বাজারে বড় আকারের ইলিশের প্রাপ্যতা (৮০০-৯০০ গ্রাম) আগের তুলনায় ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ইলিশের সর্বোচ্চ সহনশীল উৎপাদন ৭.১৮ লাখ টন নির্ধারণ করা হয়েছে।
ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ, যার উৎপাদন সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে সঠিক ব্যবস্থাপনার ওপর। জাটকা ধরা বন্ধসহ প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশকে পরিপূর্ণ ডিম ছাড়তে দিলে ইলিশের উৎপাদন কয়েক গুণ বাড়বে বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। স্যাটেলাইট ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে নদীতে কোথায় মা ইলিশ বা জাটকা আহরণ করা হচ্ছে, তা শনাক্ত করা সহজতর এবং তৎক্ষণাৎ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হবে। এ ছাড়া মাইক্রো বা ন্যানো চিপ টেকনোলজি ব্যবহার করে ইলিশের অভিপ্রয়াণ পথ নিরূপণ করা যাবে। সুতরাং আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে মা ইলিশ ও জাটকা সংরক্ষণ করে দেশের ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভবপর।
বর্তমানে ইলিশ মাছ নদীর তুলনায় সাগরে বেশি পাওয়া যাচ্ছে। সাগরের ইলিশের ল্যান্ডিং বেশি হয়– চট্টগ্রাম ফিশারি ঘাট, চরফ্যাসনের সামরাজ ঘাট, পটুয়াখালীর মহিপুর-আলিপুর, বরিশালের পোর্ট রোড, বরগুনার পাথরঘাটা, হাতিয়ার চেয়ারম্যান ঘাট, কক্সবাজার ও চাঁদপুরে বড় স্টেশন বাজার। নদীর ইলিশ বেশি পাওয়া যায় ভোলা, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, বরিশাল সদর, হিজলা ও মেহেন্দীগঞ্জ, নোয়াখালীর হাতিয়া।
সহনশীল মাত্রায় ইলিশ উৎপাদনে নানা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর মধ্যে আবাসস্থল ধ্বংস ও দূষণের কারণে ইলিশের অভিপ্রয়াণ পথ পরিবর্তন; অত্যধিক মাত্রায় জাটকা ও মা ইলিশ আহরণের ফলে পুনঃসংযোগ বা প্রবেশন প্রক্রিয়া ব্যাহত; নদীর নাব্য হ্রাসের কারণে অভিপ্রয়াণে বাধা; ইলিশ আহরণে ব্যবহৃত বিভিন্ন প্রকার জাল, নৌকা এবং নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর সংখ্যা নিরূপণ, দূষণের ফলে পানির গুণাগুণ পরিবর্তনজনিত কারণে অভয়াশ্রমগুলোর কার্যকারিতার প্রভাব নিরূপণ এবং প্রজননক্ষেত্রের পরিবেশ ও প্রতিবেশগত কার্যকারিতা নিরূপণ ও পুনর্নির্ধারণ উল্লেখযোগ্য। ফলে ইলিশ মাছের পরিভ্রমণ পথ, প্রজননক্ষেত্র, বিচরণ ও চারণক্ষেত্র (ফিডিং ও নার্সারি গ্রাউন্ড) দিন দিন পরিবর্তিত ও বিনষ্টের কারণে অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে ইলিশের উৎপাদন হ্রাস পায়। এ ছাড়া ক্রমাগত বর্ধিত জনসংখ্যার চাপ, কর্মসংস্থানের অভাব, নির্বিচারে ক্ষতিকর জাল যেমন কারেন্ট জাল, বেহুন্দি জাল, বেড় জাল, চরঘেরা জাল, মশারি জাল, পাইজান, দুটাজাল ও অপরিকল্পিভাবে যান্ত্রিক নৌযানের মাধ্যমে মাছ আহরণের উন্নত পদ্ধতি প্রবর্তন ইত্যাদি ইলিশ মাছের উৎপাদন হ্রাসের বিশেষ কারণ।
মো. মামুন হাসান: মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে কর্মরত
- বিষয় :
- মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ