আন্তর্জাতিক
আসাদের পতন আরব অঞ্চলে যে বার্তা দেয়
ফাইল ছবি
রামি জি খৌরি
প্রকাশ: ১১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:০০
সিরিয়ার বিদ্রোহী শক্তি ত্বরিত হামলা চালিয়ে দুই সপ্তাহের কম সময়ের মধ্যে দেশটির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। ৮ ডিসেম্বর তারা সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ঢুকে পড়ে এবং বাশার আল-আসাদের শাসনের অবসান ঘোষণা করে। বিদ্রোহীদের এই লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে সিরিয়ায় আল-আসাদ পরিবারের অর্ধশতাব্দীর শাসনের সমাপ্তি ঘটেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি এবং ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্রের উদ্ভবের পর থেকে এই ঘটনাকে আধুনিক আরব অঞ্চলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক মোড় হিসেবে দেখা উচিত। ১৯৫০-এর দশকে সামরিক গোড়াপত্তনের পর থেকে আরবের স্বৈরশাসকদের উত্তরাধিকারের সঙ্গে এটি ছেদ ঘটিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে আরব সমাজে স্বৈরশাসকরা আধিপত্য চালিয়েছে এবং অঞ্চলটি তাদের হাতে ধ্বংস হয়েছে।
অনেকে যথাযথভাবে আল-আসাদের পতন উদযাপন করে। আবার কেউ কেউ সিরিয়ায় স্থানীয় ও বহিরাগত বহু শক্তির জড়িত থাকার কারণে দেশটিতে পরবর্তী সময়ে কী হতে যাচ্ছে, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। সিরিয়ার জনগণ স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ জীবন চায়। আর তাদের সঙ্গে যেন সম্মান দিয়ে আচরণ করা হয় এবং তাদের কথা শোনা হয়। আমাদের উচিত দেশটিতে একটি নতুন ও স্থিতিশীল অবস্থা নিয়ে আসতে সদয় হয়ে তাদের পাশে থাকা। আর পশ্চিমা বিশ্লেষণের মূর্খতা তথা লম্বা দাড়ির নেপথ্যে ষড়যন্ত্রতত্ত্ব রয়েছে– এ প্রবণতা বন্ধ করা।
সিরিয়ার প্রশাসন ও গৃহযুদ্ধের ধ্বংসাত্মক কাহিনি কী দাঁড়াবে, তা নিয়ে এখন কথা বলা গুরুত্বপূর্ণ।
আসাদের শাসনে সিরিয়া যেমন অনন্য ছিল না, একইভাবে তা স্থানীয় কিছু পাশবিক ব্যক্তির মতোও ছিল না। বরং এটি উত্তরাধিকারসূত্রে বিশৃঙ্খল, নীতিহীন আরব রাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের একটি উদাহরণ। আঞ্চলিক শক্তি, পরাশক্তি ও বিভিন্ন বেসরকারি গোষ্ঠীর সহায়তায় অর্ধশতাব্দী ধরে এ অঞ্চলকে তারা ধ্বংস করেছে এবং এর জনগণকে হেয় করেছে। আল-আসাদের সরকার ছিল আরব অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারকারী সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী সামরিকভিত্তিক শাসন। এ ক্ষেত্রে তাদের বিদেশিরা সমর্থন দিয়েছে এবং পরিবারসূত্রে তারা ছিল স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের উত্তরাধিকার। পরিবারটি সিরিয়ার জনগণ, অর্থনীতি ও জাতীয় অখণ্ডতা ধূলিসাৎ করে দিয়েছে।
সিরিয়ার অভিজ্ঞতা অন্যান্য আরব স্বৈরাচারের সব দুর্বল বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে, যা ব্যাপকভাবে বহাল। এগুলো অবশ্যই আমাদের সমাজ থেকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে মূলোৎপাটন করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে প্রকৃত বহুত্ববাদের অভাব ও বিশ্বাসযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জবাবদিহি। আর এখানে উচ্ছৃঙ্খল শাসনের অধীনে সামরিক ও পুলিশি বর্বরতা, ব্যাপক কারাদণ্ড, নির্যাতন ও মৃত্যু। এ ছাড়া কেন্দ্রীভূত অর্থনৈতিক পরিকল্পনা, যা উচ্চবিত্তদের মধ্যে দুর্নীতির জন্ম দেয় এবং সমগ্র ভূমিতে জীবনমানের ভয়াবহ বৈষম্য। আর নাগরিক ও রাষ্ট্রের মধ্যে কোনো কাঠামোগত সংযোগ নেই, যা এমন নীতি তৈরি করতে পারে যা শাসিতদের সম্মতি ও ইচ্ছাকে প্রতিফলিত করে।
জামাল আবদেল নাসের ১৯৫২ সালের মিসরীয় বিপ্লবের মধ্য দিয়ে আরবে ধ্বংসাত্মক সামরিক সরকারের গোড়াপত্তন করেছিলেন। ১৯৬৭ সালে আরব সেনাবাহিনীর কাছে ইসরায়েলের পরাজয়ের পরে তা আরও দ্রুতগতিতে বিস্তার লাভ করে। বাশার আল-আসাদের বাবা হাফিজ আল-আসাদ আরব সেনা কর্মকর্তা ছিলেন। তাদের সেনা দলটি পরবর্তী দুই দশকে বিভিন্ন আরব দেশে ক্ষমতা দখল করে এবং অঞ্চলগুলো থেকে জনবসতি উচ্ছেদ করতে অগ্রসর হয়।
এই স্ব-আরোপিত সেনা কর্মকর্তারা তাদের কয়েক দশকের শাসনামলে যুদ্ধ চালাতে বা কার্যকরভাবে শাসন করতে সক্ষম হননি। ফলে ১৯৯০-এর দশক থেকে কিছু ধনী তেল উৎপাদনকারী ছাড়া বেশির ভাগ আরববাসী উপযুক্ত শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, চাকরি, পর্যাপ্ত খাদ্য, পানি, বিদ্যুৎ এবং অন্যান্য মৌলিক প্রয়োজনীয় সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
দমনপীড়নের মাধ্যমে আরব সরকারগুলো তাদের নাগরিকদের নিষ্ক্রিয়, কণ্ঠহীন, নপুংসক ভোক্তায় পরিণত করেছে, যাদের অনেকেই দেশত্যাগ করতে চায় বা করছে। দমনপীড়ন তাদের নাগরিকদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ, ভয় ও হতাশার জন্ম দিয়েছে। তারা দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থায় যোগদানের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করে অথবা তাদের নিজেদের রাষ্ট্রকে ইসরায়েল বা বিদেশি শক্তির কাছ থেকে বিপদের মুখে রক্ষা করতে এবং বেঁচে থাকার জন্য গঠন করে ছোট ছোট উপজাতীয়, ধর্মীয় বা মতাদর্শিক গোষ্ঠী।
সিরিয়ায় যা ঘটেছে, তা গোটা আরবে স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে জেগে ওঠার আহ্বান হওয়া উচিত। এ অঞ্চল দীর্ঘকাল এই বাস্তবতা সহ্য করতে পারে না– আরব রাষ্ট্র সাংবিধানিক বা নির্বাচনী উপায়ে তার নিজ জনগণ দ্বারা বিশ্বাসযোগ্যভাবে বৈধতা পায়নি।
আমি অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় ধরে আরব সমাজ, নাগরিকদের অভিজ্ঞতার দৈনন্দিন জীবনের ঘটনার সাক্ষী। আর আমি এই উপসংহারে পৌঁছেছি– আরব বিশ্বের একটিও স্থিতিশীল রাষ্ট্র, প্রকৃত সার্বভৌমত্ব, নাগরিকত্ব, টেকসই ও ন্যায়সংগত মানব উন্নয়নের চারটি মূল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়নি।
সিরিয়া প্রত্যেক সাধারণ নাগরিকের স্বাধীনতা ও মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকার অদম্য ইচ্ছা নিয়ে যে সংকেত বিশ্বে তুলেছে, তা হারানো আমাদের জন্য হবে বোকামি। যদি আমরা জনগণকে ব্যর্থ করে দেওয়া বিদ্যমান রাষ্ট্র ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা মেনে নিই, তাহলে আমরাও আরবদের সঙ্গে যা করা হয়েছে তার অস্বীকার করা হবে।
রামি জি খৌরি: আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব বৈরুতের বিশিষ্ট ফেলো; আলজাজিরা থেকে ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম
- বিষয় :
- আন্তর্জাতিক