নৃ-মুখ
দোষারোপের রাজনীতি বন্ধ করুন আগে
জোবাইদা নাসরীন
জোবাইদা নাসরীন
প্রকাশ: ১১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:০৩
বাংলাদেশ কোন দিকে যাচ্ছে– এ প্রশ্নই হয়তো সবার মনে কমবেশি উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। কেউ কেউ সামাজিক মাধ্যমে হাহুতাশ করছেন; আর কেউ ভয়ে মুখ খুলছেন না– পাছে কী তকমা লাগে! তকমার কারবারিরা চারপাশে ওত পেতে আছেন। জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত লড়াকু অবস্থানে ছিলেন এমন অনেকেরও দাঁত কিড়মিড় অবস্থা। নানা বিভক্তি, আড়াআড়ি কানে বাজে। নানা রটনা, গুজবও আছে।
সবকিছু ছাপিয়ে এখন আমরা আছি ভারত-বাংলাদেশের জনগণের তীব্র রেষারেষির হিড়িকে। বলা বাহুল্য, এর মূলে রয়েছে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা। ৫ আগস্ট আওয়ামী শাসনের পতনের দিন থেকেই দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভাস্কর্য ও মাজার ভাঙার পাশাপাশি সংখ্যালঘুর ওপর আক্রমণের ঘটনা ঘটে। সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, দেশের মোট ২৯টি জেলায় সংখ্যালঘুদের মন্দির ভাঙচুরসহ হামলা, হুমকি, ভীতি প্রদর্শন, লুটপাটের অভিযোগও ওঠে।
বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনা নতুন নয়। বিশেষ করে বিগত কয়েকটি জাতীয় নির্বাচনের পর ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা আমরা দেখেছি। এবার ব্যতিক্রম, নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘুদের আন্দোলন। এবারই তৈরি হয়েছে সনাতনী জাগরণ মঞ্চ, যার নেতৃত্বে আছেন পুরোহিত তথা ধর্মগুরুরা। দেশে এতদিন সব সংখ্যালঘুর সংগঠনরূপে পরিচিত ছিল ‘হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ’। এবার এর নেতারা প্রতিবাদ করতে পারেননি। তাদের অনেকেরই বিগত সরকার ও সরকারি দলের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক ছিল। অনেক নেতার বিরুদ্ধেই হয়েছে হত্যা মামলা। তাই এদের অনেক নেতাই ভয়ে বাড়ি থেকে বের হতে পারছেন না। এ পরিপ্রেক্ষিতে পুরোহিত, ঠাকুরদের নেতৃত্ব সামনে এসেছে। তারা এই প্রথমবারের মতো খোলাখুলি ‘হিন্দু’ পরিচয় নিয়েই প্রতিবাদে নেমেছেন।
এটাও বলা দরকার, সংবিধানের সংস্কার নিয়ে যে কয়েকটি বিষয় ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে শোরগোল ফেলেছে সেগুলোর অন্যতম হলো, সংবিধানের মূলনীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বিসর্জন। এটিই সম্ভবত অমুসলিমদের পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। ফলে শুধু ভারতকে গালমন্দ করলেই বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সমস্যার সমাধান হবে– এমনটা ভাবা কঠিন।
বাংলাদেশে এমন পরিস্থিতির সুযোগ বর্তমান ভারত সরকারের চরিত্রগত কারণেই নেওয়ার কথা। তার প্রভাব দুই দেশের সম্পর্কে পড়াটাও স্বাভাবিক। যদিও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ‘সব ঠিকঠাক হচ্ছে’– এমন বার্তাই আসছিল। দুই দেশের সম্পর্ক যে ‘ঠিক’ নেই– তা স্পষ্ট হয়ে উঠল ‘রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে সনাতনী জাগরণ মঞ্চের নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তার, পরের দিন চট্টগ্রামে আইনজীবী হত্যাকে কেন্দ্র করে সারাদেশে উত্তেজনা এবং আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলা ও পতাকার অবমাননায়। গ্রেপ্তারের পর চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের পক্ষে কোনো আইনজীবীকে দাঁড়াতে না দেওয়া ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে বড় কাভারেজ পাচ্ছে। সেখানকার সংবাদমাধ্যমে দেখলে যে কারও মনে হবে, দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ হয়তো আসন্ন।
এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ হলো, চলমান উত্তেজনায় দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চিঠি চালাচালি করছে, নিন্দা প্রকাশ করছে; কিন্তু কোনো দেশের সরকারই সংখ্যালঘুদের সঙ্গে বৈঠক কিংবা আলাপ-আলোচনা করছে না।
এ মুহূর্তে বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারের করণীয় কী? মনে রাখতে হবে– ভারতে যারা সংখ্যাগুরু, তারাই বাংলাদেশে সংখ্যালঘু এবং বাংলাদেশের সংখ্যাগুরুরা ভারতে সংখ্যালঘু। তাই ভারতে সংখ্যালঘু নিপীড়নের কোনো ঘটনা ঘটলে সেটির প্রভাব পড়ে বাংলাদেশে। একই রকম বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নিপীড়নের ঘটনা ঘটলে সেটির প্রভাব পড়বে ভারতে। এটি গত ৫৩ বছর ধরেই কমবেশি ঘটছে। তাই বিষয়টি যতটা কূটনৈতিক, তার চেয়ে বেশি সংবেদনশীলতার, মানবিক ধর্মচর্চার। তাই এ ক্ষেত্রে দুই সরকারকেই মানুষে মানুষে ভেদাভেদের যত উপাদান তৈরি হয়েছে, সেগুলো নিয়ে কথা বলতে হবে। সেগুলো কীভাবে দূর করা যায়, তা আলোচনায় আনতে হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার থেকে আমরা একমাত্র পদক্ষেপ দেখেছি দেশের অভ্যন্তরে ভারতের অপপ্রচার ঠেকানোর ক্ষেত্রে জাতীয় ঐক্য তৈরির চেষ্টা হিসেবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে একটি ঐক্যের ছবি সামাজিকমাধ্যম ও সংবাদমাধ্যমে প্রচার করতে। কিন্তু বিভেদের অন্যান্য কারণ বহাল রেখে শুধু ‘ঐক্য’ প্রচার করে কি দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদের রেখা মুছে দেওয়া যাবে?
বিভেদগুলো আমরা ক্রমশ বাড়িয়ে তুলেছি। মুখে ঐক্য, বাস্তবে বিভেদ মোকাবিলার ভাবনা নেই– এমন অবস্থান কার্যত কোনো কাজে আসবে না। প্রয়োজন দুই দেশেরই ধর্মীয় চরমপন্থাকে নিয়ন্ত্রণ এবং সংখ্যালঘুদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত সংলাপ করা। তাই দায়িত্ব দুই দেশকেই নিতে হবে। বাংলাদেশকে তার রাজনৈতিক দর্শন এবং কৌশল ঠিক করতে হবে। আপাতদৃষ্টে একে অন্যকে ঠেকাতে ব্যস্ত। কিন্তু শুধু আন্যের ঘাড়ে দোষ চাপানোর রাজনীতি যে এক পর্যায়ে বুমেরাং হয়, তা তো আওয়ামী লীগের পরিণতি দেখেই সবার শেখার কথা। দায়িত্ব নিতে হয় এবং তা নিতে হবে।
জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
zobaidanasreen@gmail.com
- বিষয় :
- রাজনীতি